হারুন আল রশীদ
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। সেই হিসাবে এই বছর জাতীয় সংসদের বয়স ৫০ পার হয়েছে। দুই বছর আগে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়সও ৫০ অতিক্রম করেছে। তবে আজকের বাংলাদেশ ও জাতীয় সংসদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ও গণপরিষদসহ আরো অনেক কিছু। এসবের মধ্যে গণপরিষদের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। মূলত এই পরিষদের ৩৪ জন সদস্যের নিরলস পরিশ্রমের ফসল আজকের সংবিধান। তারা মাত্র ৯ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিতে পেরেছিলেন, যা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ২০ বছরের বেশি সময়েও দিতে পারেনি। এই সংবিধানের হাত ধরেই ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছিল জাতীয় সংসদের যাত্রা।
স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ঢাকাসহ আরো বেশ কিছু শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে শত শত নিরীহ মানুষকে। এই আক্রমণ শুরুর অল্প কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। তবে এই ঘটনার আগ মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি ছিল এই রকম : 'এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা-কিছু আছে তা-ই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।'
২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে মানুষের ওপর আক্রমণ চালালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। এসব নেতার মধ্যে অনেকেই ৩০ মার্চের মধ্যে কলকাতায় জড়ো হন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তারা ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করেন। এই সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে শপথ গ্রহণ করে। এই সরকারে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতির পদ দেওয়া হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতির এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদসহ আরো কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র এবং আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, এম মনসুর আলীকে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন গণপরিষদ সদস্য এম ইউসুফ আলী। এ ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এবং এই ঘোষণাবলে গণপরিষদ ও মুজিবনগর সরকার বৈধ বলে বিবেচিত হয়।
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক দলিল। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গণপরিষদ এবং আজকের সংবিধান ও সংসদ। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণপরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর কয়েকটি বিধান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং বাকিগুলো মূল সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের আইন হিসেবে কার্যকর ছিল।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। এরপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরের দিন ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি করেন।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ছয় দফায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী।
গণপরিষদ গঠন
রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এই আদেশে গণপরিষদকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ঘোষণা করা হয়। আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গণপরিষদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এবং দুটি উপনির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীন অযোগ্য ঘোষিত হননি, তাদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে।
উল্লিখিত সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে মৃত্যুবরণ, শপথগ্রহণ না করা এবং গণপরিষদ আদেশ অনুযায়ী সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়ায় ৬৬টি আসন শূন্য ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। এদের মধ্যে ৪০০ জন সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাপের এবং বাকি দুজন ছিলেন নির্দলীয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনেই শাহ আব্দুল হামিদ স্পিকার ও মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে গণপরিষদ ছিল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ওপর গণপরিষদের কোনো ধরনের নির্ভরশীলতা ছিল না। সাধারণত সংসদ বা আইনসভায় কোনো বিল পাশ হলে তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয়। সম্মতি প্রদানের আগে রাষ্ট্রপতি চাইলে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু গণপরিষদে গৃহীত সংবিধান বিল পাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণের কোনো বিধান গণপরিষদ আদেশে রাখা হয়নি। সহজ কথায়, জনগণের জন্য সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণপরিষদ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন।
খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল সংবিধান প্রণয়নের জন্য ড. কামাল হোসেনকে (ঢাকা-৯, জাতীয় পরিষদ) সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন :
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ-১৭, জাতীয় পরিষদ),
তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা-৫, জাতীয় পরিষদ),
খন্দকার মোশতাক আহমেদ (কুমিল্লা-৮, জাতীয় পরিষদ),
এ এইচ এম কামারুজ্জামান (রাজশাহী-৬, জাতীয় পরিষদ),
এম আবদুর রহিম (দিনাজপুর-৭, প্রাদেশিক পরিষদ),
আবদুর রউফ (রংপুর-১১, জাতীয় পরিষদ),
মো. লুৎফর রহমান (রংপুর-৪, জাতীয় পরিষদ),
আবদুল মমিন তালুকদার (পাবনা-৩, জাতীয় পরিষদ),
আবু সাইয়িদ (পাবনা-৫, জাতীয় পরিষদ),
মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (রাজশাহী-৩, জাতীয় পরিষদ),
এম আমীর-উল ইসলাম (কুষ্টিয়া-১, জাতীয় পরিষদ),
বাদল রশীদ (কুষ্টিয়া-৪, জাতীয় পরিষদ),
খন্দকার আবদুল হাফিজ (যশোর-৭, জাতীয় পরিষদ),
মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (বাকেরগঞ্জ-৩, জাতীয় পরিষদ),
শওকত আলী খান (টাঙ্গাইল-২, জাতীয় পরিষদ),
মো. হুমায়ুন খালিদ (টাঙ্গাইল-৩, জাতীয় পরিষদ),
আছাদুজ্জামান খান (যশোর-১০, প্রাদেশিক পরিষদ),
এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ (ময়মনসিংহ-৬, জাতীয় পরিষদ),
আবদুল মমিন (ময়মনসিংহ-১৩, জাতীয় পরিষদ),
শামসুদ্দিন মোল্লা (ফরিদপুর-৪, জাতীয় পরিষদ),
শেখ আবদুর রহমান (খুলনা-২, প্রাদেশিক পরিষদ),
ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ (ঢাকা-২০, প্রাদেশিক পরিষদ),
আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী (সিলেট-৫, জাতীয় পরিষদ),
অধ্যাপক খোরশেদ আলম (কুমিল্লা-৫, জাতীয় পরিষদ),
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (কুমিল্লা-৪, জাতীয় পরিষদ),
দেওয়ান আবু আব্বাছ (কুমিল্লা-৫, জাতীয় পরিষদ),
হাফিজ হাবিবুর রহমান (কুমিল্লা-১২, জাতীয় পরিষদ),
মো. আবদুর রশীদ (নোয়াখালী-৮, জাতীয় পরিষদ)
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (সিলেট-২, প্রাদেশিক পরিষদ),
নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৬, জাতীয় পরিষদ),
মুহাম্মদ খালেদ (চট্টগ্রাম-৫, জাতীয় পরিষদ)
বেগম রাজিয়া বানু (নারী আসন, জাতীয় পরিষদ)।
ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল (বাকেরগঞ্জ-১৫, প্রাদেশিক পরিষদ),
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৩৪ সদস্যের ৩৩ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
কমিটির বৈঠক
১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সংবিধান প্রণয়নে জনগণের সকল অংশের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। সেজন্য বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, যে-কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ৮ মের মধ্যে কমিটির কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিটি দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৯৮টি প্রস্তাব পায়। এসব প্রস্তাব কমিটির সভায় যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামানের মুখে শুনেছি, কমিটির বৈঠকগুলো হয়েছে তেজগাঁওয়ে গণপরিষদ ভবনে, বর্তমানে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। খসড়া প্রণয়নে কমিটিকে সহযোগিতা করেছিলেন গাথরি নামের এক আইরিশ লোক। লোকটির পুরো নাম দুজনের কেউই মনে করতে পারেননি। গাথরি ব্রিটিশ আইনসভার খসড়া আইনপ্রণেতা (ড্রাফটসম্যান) ছিলেন। কমিটি প্রথমে সংবিধানের ইংরেজি পাঠ তৈরি করেছে। এরপর সেই পাঠকে বাংলায় রূপ দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামানের বন্ধু নিয়ামুল বশিরও এই কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি গণপরিষদের সহকারী বিতর্ক সম্পাদক ছিলেন।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ১৯৭২ সালের ১৭ থেকে ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১০ থেকে ২৫শে মে পর্যন্ত অনেকগুলো বৈঠক করে। এসব বৈঠকে প্রতিটি খসড়া বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে কিছু কিছু দফার ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৫ মের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব দফাকে একত্রিত করে একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করা হয়। ৩ জুন কমিটির সভায় ওই খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করা হয়। এরপর সভায় খসড়া সংবিধানের দফাওয়ারি আলোচনা শুরু হয়। ১০ জুন কমিটি খসড়াটি অনুমোদন করে।
খসড়া সংবিধান অনুমোদনের আগে কমিটির সদস্যদের মধ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলামের মুখে শুনেছি, বিভিন্ন বৈঠকের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
২০১০ সালে সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাৎকারে কামাল হোসেন আমাকে বলেছিলেন, সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে। এই অনুচ্ছেদটির ব্যাপারে কমিটির সদস্যের কয়েক জনের আপত্তি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তুলে ধরলেন ১৯৫৪ সালের অভিজ্ঞতা। তিনি আমাদের বলেছেন, তোমরা বলছো উন্নত দেশে এ ধরনের আইন নেই। কিন্তু আমার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তাতে এমন একটি আইনের প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতার কথা আমরাও জানি। আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানের আইনসভায় রীতিমতো ঘোড়ার মতো সংসদ সদস্য কেনাবেচা হতো। প্রতিদিনই সংসদে সদস্যদের দর পরিবর্তিত হতো। এটা তো গণতন্ত্র হতে পারে না। সেজন্যই তখন আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ গ্রহণ করেছিলাম।
আমীর-উল ইসলামের মুখে শুনেছি অন্য বিতর্কের কথা। তিনি বলেছেন, আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। এ বিষয়ে আমার ঘোর আপত্তি ছিল, কারণ শাপলার কোনো মেরুদণ্ড নেই। আমি বলেছি, জাতীয় ফুল হবে এমন একটি, যার সঙ্গে বাঙালির চরিত্রের মিল আছে, যার শিরদাঁড়া সোজা থাকবে। এক্ষেত্রে আমার পছন্দের ফুল ছিল রজনিগন্ধা। কিন্তু আমার সহকর্মীরা জানালেন, রজনিগন্ধা বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় না। শেষ পর্যন্ত বিতর্ক এড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিল্পী কামরুল হাসানের মত গ্রহণ করা হলো। তিনি জানালেন, শাপলা ফুল জাতীয় ফুল হতে পারে। কারণ এটি আঁকতে সুবিধা।
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম দুটি অনুচ্ছেদ হলো ৫৯ ও ৬০। দুটিই স্থানীয় সরকারবিষয়ক। দুটি অনুচ্ছেদই আমীর-উল ইসলামের কাছ থেকে এসেছিল। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার যদি না থাকে এবং এতে যদি জনগণের অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে দেশ একটি কেন্দ্রনির্ভর আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অনেক বিতর্ক শেষে স্থানীয় সরকার বিষয়ক অনুচ্ছেদ দুটি গৃহীত হয়। এ জাতীয় দুটি অনুচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১০ জুনের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, খসড়া সংবিধানটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার আগে আইনের পেশাদার ড্রাফটসম্যান এবং বাংলার ভাষাবিদদের দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হবে। এর আলোকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলী আহসান ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলামকে সদস্য করে একটি ভাষা বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। এই কমিটি খসড়া সংবিধানের ভাষা পরীক্ষানিরীক্ষা করে।
ভাষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জিত খসড়া সংবিধান ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। কমিটি ওই দিন থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন বৈঠকে পরিমার্জিত সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে এবং এরপর তা গণপরিষদে উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
খোন্দকার আবদুল হকের লেখা সংসদীয় রীতি ও পদ্ধতি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি মোট ২৯টি বৈঠক করেছিল। কিন্তু এর সমর্থনে কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তবে ১২ অক্টোবর পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘…প্রায় ৭২ দিন আমাদের এই কমিটির সদস্যরা কাজ করেছেন, চিন্তা করেছেন, আলোচনা করেছেন…।’ এ থেকেই কেউ কেউ মনে করেন, কমিটি মোট ৭২টি বৈঠক করেছিল।
গণপরিষদে সংবিধান বিল
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। স্পিকার শাহ আবদুল হামিদের মৃত্যুজনিত কারণে এদিন অধিবেশনের শুরুতে ডেপুটি স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহকে স্পিকার এবং মোহাম্মদ বায়তুল্লাহকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করা হয় । এরপর বেলা ১১টার দিকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনসহ সংবিধান বিল গণপরিষদে উত্থাপন করেন। কমিটর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিলটির ওপর ৩০ অক্টোবরের মধ্যে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন। তবে তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।
কমিটির প্রতিবেদনে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ছয় জন সদস্যের বিরুদ্ধমত তুলে ধরা হয়। বিরুদ্ধমত দেওয়া ব্যক্তিরা হলেন- আছাদুজ্জামান খান, এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ, আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী, হাফিজ হাবিবুর রহমান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আছাদুজ্জামান খান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে লিখিত আপত্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোনো সদস্যকে বহিষ্কারের আগে বিষয়টির যথাযথ তদন্তের বা অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
আপত্তিতে এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কারের পর তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এই বিধানটি বাতিল করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে দলের ভাঙনের সৃষ্টি হবে।
সংবিধান বিল উত্থাপনের দিন থেকে পাশের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গণপরিষদে বিলটির বিভিন্ন দফা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। অসংখ্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যার মধ্য থেকে অনেকগুলো গৃহীতও হয়। সবচেয়ে বেশি ৭০-এর বেশি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর একটি সংশোধনী প্রস্তাত গৃহীতও হয়। সেটি হলো, রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দেওয়ার পর সংসদে ওই ভাষণের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে (অনুচ্ছেদ-৭৩)। এই জন্য শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সমাপনী ভাষণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রশংসাও করেছিলেন।
মানবেন্দ্র লারমার ওয়াক আউট
গণপরিষদের অধিবেশনের সবচেয়ে অলোচিত ঘটনাটি ঘটে ৩১ অক্টোবর। খসড়া সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।’ ওই দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সদস্য আ. রাজ্জাক ভূইয়া (ঢাকা-১২, জাতীয় পরিষদ) তাঁর সংশোধনীতে প্রস্তাবিত ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেন।
এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম-১, প্রাদেশিক পরিষদ)। তিনি বলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।...কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দপুরুষ- কেউই বলে নাই, আমি বাঙালি। আমার সদস্য-সদস্যা ভাইবোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধান আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়...।’
ওই পর্যায়ে স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ মানবেন্দ্র লারমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’
জবাবে মানবেন্দ্র লারমা বলেন, ‘...আমাদেরকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় নাই। আমরা কোনোদিন নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’
ওই দিন রাজ্জাক ভূইয়ার সংশোধনী প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে পাশ হবার পর মানবেন্দ লারমা বলেন, ‘আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধিত আকারে গৃহীত হলো। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গণপরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।’
বিল পাশ
সংবিধান বিল গণপরিষদে পাশ হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। ওই দিনের আলোচনায় মানবেন্দ্র লারমা বলেছিলেন, ‘...মাননীয় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার যে সময় দিয়েছিলেন কথা বলার, সেটা আমি মনে করি, এই মহান গণপরিষদে গণতান্ত্রিক অধিকারের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।’ বক্তব্যের শেষ লাইনে মানবেন্দ্র লারমা সংবিধান উপহার দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘...আমার জীবনের আজকে সবচেয়ে আনন্দের দিন, সেই আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত আন্দোলন হয়েছে এই দেশে। আজকে, আমার দল যে ওয়াদা করেছিল, তার এক অংশ পালিত হলো। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। যে-কোনো ভালো জিনিস না দেখলে, না গ্রহণ করলে, না ব্যবহার করলে হয় না, তার ফল বোঝা যায় না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহিদের রক্তদান সার্থক হবে।’
এরপর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের বৈঠক মুলতুবি করা হয়।
নতুন সংবিধানের সমালোচনা
ঢাকা বার সমিতির সভাপতি আহমদ সোবহান, রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, আইনজীবী আলিম আল রাজী ও বদরুদ্দীন উমরসহ আরো অনেকই খসড়া সংবিধান বিলের সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, বিরোধী দলগুলো সংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারেনি। (সাংবিধানিক আইনের মূলনীতি- আ ফ ম মহসীন)।
গণপরিষদে পাশ হওয়া সংবিধানে সেই সময়ে প্রতিবাদী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সই করেননি। তবে ২০১০ সালে তিনি সংবিধানের সমালোচকদের সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন, ‘আসলে ওই সময়ে পরাজিত শক্তির লোকজন মওলানা ভাসানীর পেছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, যারা সংবিধান রচনা করেছে তারা তো নির্বাচিত নয়। মূলত ওই সময়ে মওলানা সাহেবকে পাকিস্তানি পরাজিত শক্তিদের যে-ই পেরেছে, ব্যবহার করেছে।’
সংবিধান ছাপা
৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাশ হওয়ার পর এটি ছাপার তোড়জোড় শুরু হয়। সংসদ সচিবালয়ের লাইব্রেরিতে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন-সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা নথি না থাকায় এ বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শিল্পী হাশেম খান ও বিজি প্রেসের তৎকালীন উপপরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমানের সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটি হাতে লেখা। হাতে লেখার এই কাজটি করেছিলেন শিল্পী আবদুর রউফ। এই সংবিধানে অলংকরণের কাজ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভী ও হাশেম খান। হাশেম খানের কাছে শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেছিলেন, তিনি নন্দলাল বসুর মতো কাজ দেখতে চান। নন্দলাল বসু ভারতীয় সংবিধানের অলংকরণের কাজ করেছিলেন।
হাতে লেখা সংবিধানের পাশাপাশি একই সময়ে ছাপার হরফে লেখা সংবিধান ছাপার কাজও শুরু হয়। এ বিষয়ে হাশেম খান ও সিদ্দিকুর রহমানের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেটা এই রকম- কামাল হোসেন পদ্মা প্রিন্টিং প্রেসে সংবিধান ছাপতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবে পদ্মা প্রেস জানিয়েছিল, সংবিধান ছাপতে ৫ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। এর মধ্যে ৩ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তখন ওই পরিমাণ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন কামাল হোসেন বিজি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিজি প্রেসে তখন ইংল্যান্ডের তৈরি ১৯৪৮ সালের দুটি ‘ক্র্যাবট্রি’ ব্র্যান্ডের অফসেট মেশিন ছিল। সেই মেশিনে পরীক্ষামূলকভাবে শিল্পীদের অলংকৃত সংবিধানের কিছু পাতা ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, সেই ছাপার মান ভারতীয় সংবিধানের ছাপার চেয়েও উন্নত। শেষ পর্যন্ত ওই মেশিনেই বাংলাদেশের সংবিধান ছাপা হয়। তাতে সরকারের খরচ হয়েছিল মাত্র ১৪ হাজার টাকা। কভার মুদ্রণ করা হয়েছিল ইস্টার্ন রিগ্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে।
যে দুটি মেশিনে সংবিধান ছাপা হয়েছিল সেগুলো দীর্ঘদিন বিজি প্রেসের পেছনের রেললাইনের ওপরে পড়ে ছিল। এ নিয়ে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম ২০১৩ সালের দিকে। শুনেছি, মেশিন দুটি নাকি এখন জাতীয় জাদুঘরে আছে। তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
হাতে লেখা সংবিধানে সদস্যদের সই
৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাশের পর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের বৈঠক মুলতুবি করা হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরের অধিবেশনে সদস্যরা হাতে লেখা সংবিধানে নিজেদের সই প্রদান করেন। সবার আগে সই করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মোট ৩৯৯ জন সদস্য সই করেন। চার জন সদস্য সই করেননি।
প্রথম দিনে ৩৫১ জন সই করেন। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বরের অধিবেশনের শুরুতে ৪৪ জন সই করেন। তখনো আট জনের সই করা বাকি। ওই অবস্থায় স্পিকার বলেন, আট জন সদস্যকে আহ্বান করে আমি পাই নাই। আমি শেষ বারের মতো তাদের আহ্বান করছি।
স্পিকারের ঘোষণার পর মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ চার জন সদস্য সংবিধানে সই করেন।
এরপর শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “গতকাল আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম যে, কয়েক জন সদস্য অনুপস্থিত থাকতে পারেন এবং আমার মনে হয় কয়েক জন হজ করতে গেছেন, আর দুজন অসুস্থতাবশত আসতে পারেন নাই। আর যদি কেউ দস্তখত করার জন্য আসতে না পেরে থাকেন, তাতে কিছু আসে-যায় না। আপনি পরেও তাদের দস্তখত নিতে পারেন। এটা এই হাউজের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছিলাম এবং আপনি সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছেন। সেজন্য ‘শেষবারের মতো’ বললে কিছুটা অসুবিধা হয়। সেটা আপনার রুলিং হয়ে যাবে। তাই আশা করি, আপনার রুলিং আপনি প্রত্যাখ্যান করে আমার অনুরোধ মেনে নেবেন।”
এরপর স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ হাউজের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আজকের মতো এঁদেরকে আর একবার দেখি, এঁরা আছেন কি না। আমি ডাকছি- শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, শ্রীসুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, জনাব মোহাম্মদ আজিজার রহমান (রংপুর-২, প্রাদেশিক পরিষদ), জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহীম (ময়মনসিংহ-৭, জাতীয় পরিষদ)।…আমাদের স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান শেষ হলো।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা তাঁদের প্রতিবাদী চরিত্রের স্বাক্ষর রেখে সংবিধানে সই করেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও মোহাম্মদ আজিজার রহমান কী কারণে সই করেননি স্পষ্ট নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায়, এঁরা অসুস্থ ছিলেন, অথবা দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১। বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড
২। সংসদীয় রীতি ও পদ্ধতি- খন্দকার আবদুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
৩। সংবিধান বিল-১৯৭২
৪। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট-১৯৭২
৫। বাংলাদেশের নির্বাচন (১৯৭০-২০০১)- এ এস এম সামছুল আরেফিন
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ৭ এপ্রিল। সেই হিসাবে এই বছর জাতীয় সংসদের বয়স ৫০ পার হয়েছে। দুই বছর আগে স্বাধীন বাংলাদেশের বয়সও ৫০ অতিক্রম করেছে। তবে আজকের বাংলাদেশ ও জাতীয় সংসদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনিবার্যভাবে এসে পড়ে ১৯৭০-এর নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধ চলাকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার গঠন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ও গণপরিষদসহ আরো অনেক কিছু। এসবের মধ্যে গণপরিষদের ভূমিকার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। মূলত এই পরিষদের ৩৪ জন সদস্যের নিরলস পরিশ্রমের ফসল আজকের সংবিধান। তারা মাত্র ৯ মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতিকে একটি সংবিধান উপহার দিতে পেরেছিলেন, যা পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ২০ বছরের বেশি সময়েও দিতে পারেনি। এই সংবিধানের হাত ধরেই ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ এপ্রিল শুরু হয়েছিল জাতীয় সংসদের যাত্রা।
স্বাধীনতার ঘোষণা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের ঢাকাসহ আরো বেশ কিছু শহরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে শত শত নিরীহ মানুষকে। এই আক্রমণ শুরুর অল্প কিছুক্ষণ আগে পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। তবে এই ঘটনার আগ মুহূর্তে শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। ঘোষণাটি ছিল এই রকম : 'এটিই সম্ভবত আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণের নিকট আমার আহ্বান, আপনারা যে যেখানেই থাকুন এবং আপনাদের যা-কিছু আছে তা-ই নিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করুন। যতদিন পাক হানাদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত না হয় এবং যতদিন আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হয় ততদিন সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।'
২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ঢাকা ও দেশের অন্যান্য স্থানে মানুষের ওপর আক্রমণ চালালে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। এসব নেতার মধ্যে অনেকেই ৩০ মার্চের মধ্যে কলকাতায় জড়ো হন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তারা ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন করেন। এই সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে শপথ গ্রহণ করে। এই সরকারে শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতির পদ দেওয়া হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতির এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদসহ আরো কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এছাড়া খন্দকার মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্র এবং আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, এম মনসুর আলীকে অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
একই দিন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন গণপরিষদ সদস্য এম ইউসুফ আলী। এ ঘোষণার মাধ্যমে নবগঠিত আইন পরিষদ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। এ ঘোষণায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদন করা হয়। ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা কার্যকর বলে উল্লেখ করা হয়। এবং এই ঘোষণাবলে গণপরিষদ ও মুজিবনগর সরকার বৈধ বলে বিবেচিত হয়।
বলা বাহুল্য, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক দলিল। এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গণপরিষদ এবং আজকের সংবিধান ও সংসদ। এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণপরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর কয়েকটি বিধান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং বাকিগুলো মূল সংবিধান কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের আইন হিসেবে কার্যকর ছিল।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করে। এরপর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। পরের দিন ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ ১৯৭২ জারি করেন।
অস্থায়ী সংবিধান আদেশের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ছয় দফায় দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী।
গণপরিষদ গঠন
রাষ্ট্রপতি ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ গণপরিষদ আদেশ জারি করেন। এই আদেশে গণপরিষদকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকরী বলে ঘোষণা করা হয়। আদেশে বলা হয়েছে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গণপরিষদের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে এবং দুটি উপনির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে যারা কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীন অযোগ্য ঘোষিত হননি, তাদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হবে।
উল্লিখিত সময়ের মধ্যে জাতীয় পরিষদে ১৬৯টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে মৃত্যুবরণ, শপথগ্রহণ না করা এবং গণপরিষদ আদেশ অনুযায়ী সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাওয়ায় ৬৬টি আসন শূন্য ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত ৪০৩ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয়। এদের মধ্যে ৪০০ জন সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের, একজন ন্যাপের এবং বাকি দুজন ছিলেন নির্দলীয়। গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল। অধিবেশনের সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনেই শাহ আব্দুল হামিদ স্পিকার ও মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
এখানে বলা প্রয়োজন যে, গণপরিষদের একমাত্র দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন করা। এক্ষেত্রে গণপরিষদ ছিল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। অন্য কোনো রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের ওপর গণপরিষদের কোনো ধরনের নির্ভরশীলতা ছিল না। সাধারণত সংসদ বা আইনসভায় কোনো বিল পাশ হলে তাতে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন হয়। সম্মতি প্রদানের আগে রাষ্ট্রপতি চাইলে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য আইনসভায় ফেরত পাঠাতে পারেন। কিন্তু গণপরিষদে গৃহীত সংবিধান বিল পাশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সম্মতি গ্রহণের কোনো বিধান গণপরিষদ আদেশে রাখা হয়নি। সহজ কথায়, জনগণের জন্য সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে গণপরিষদ ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন।
খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি
১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল সংবিধান প্রণয়নের জন্য ড. কামাল হোসেনকে (ঢাকা-৯, জাতীয় পরিষদ) সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন :
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (ময়মনসিংহ-১৭, জাতীয় পরিষদ),
তাজউদ্দীন আহমদ (ঢাকা-৫, জাতীয় পরিষদ),
খন্দকার মোশতাক আহমেদ (কুমিল্লা-৮, জাতীয় পরিষদ),
এ এইচ এম কামারুজ্জামান (রাজশাহী-৬, জাতীয় পরিষদ),
এম আবদুর রহিম (দিনাজপুর-৭, প্রাদেশিক পরিষদ),
আবদুর রউফ (রংপুর-১১, জাতীয় পরিষদ),
মো. লুৎফর রহমান (রংপুর-৪, জাতীয় পরিষদ),
আবদুল মমিন তালুকদার (পাবনা-৩, জাতীয় পরিষদ),
আবু সাইয়িদ (পাবনা-৫, জাতীয় পরিষদ),
মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (রাজশাহী-৩, জাতীয় পরিষদ),
এম আমীর-উল ইসলাম (কুষ্টিয়া-১, জাতীয় পরিষদ),
বাদল রশীদ (কুষ্টিয়া-৪, জাতীয় পরিষদ),
খন্দকার আবদুল হাফিজ (যশোর-৭, জাতীয় পরিষদ),
মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (বাকেরগঞ্জ-৩, জাতীয় পরিষদ),
শওকত আলী খান (টাঙ্গাইল-২, জাতীয় পরিষদ),
মো. হুমায়ুন খালিদ (টাঙ্গাইল-৩, জাতীয় পরিষদ),
আছাদুজ্জামান খান (যশোর-১০, প্রাদেশিক পরিষদ),
এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ (ময়মনসিংহ-৬, জাতীয় পরিষদ),
আবদুল মমিন (ময়মনসিংহ-১৩, জাতীয় পরিষদ),
শামসুদ্দিন মোল্লা (ফরিদপুর-৪, জাতীয় পরিষদ),
শেখ আবদুর রহমান (খুলনা-২, প্রাদেশিক পরিষদ),
ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ (ঢাকা-২০, প্রাদেশিক পরিষদ),
আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী (সিলেট-৫, জাতীয় পরিষদ),
অধ্যাপক খোরশেদ আলম (কুমিল্লা-৫, জাতীয় পরিষদ),
অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (কুমিল্লা-৪, জাতীয় পরিষদ),
দেওয়ান আবু আব্বাছ (কুমিল্লা-৫, জাতীয় পরিষদ),
হাফিজ হাবিবুর রহমান (কুমিল্লা-১২, জাতীয় পরিষদ),
মো. আবদুর রশীদ (নোয়াখালী-৮, জাতীয় পরিষদ)
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (সিলেট-২, প্রাদেশিক পরিষদ),
নুরুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম-৬, জাতীয় পরিষদ),
মুহাম্মদ খালেদ (চট্টগ্রাম-৫, জাতীয় পরিষদ)
বেগম রাজিয়া বানু (নারী আসন, জাতীয় পরিষদ)।
ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল (বাকেরগঞ্জ-১৫, প্রাদেশিক পরিষদ),
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ৩৪ সদস্যের ৩৩ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। একমাত্র বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।
কমিটির বৈঠক
১৯৭২ সালের ১৭ এপ্রিল এই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, সংবিধান প্রণয়নে জনগণের সকল অংশের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা হবে। সেজন্য বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তাতে বলা হয়, যে-কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ৮ মের মধ্যে কমিটির কাছে প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কমিটি দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোট ৯৮টি প্রস্তাব পায়। এসব প্রস্তাব কমিটির সভায় যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়।
বিভিন্ন সময়ে কামাল হোসেন ও আনিসুজ্জামানের মুখে শুনেছি, কমিটির বৈঠকগুলো হয়েছে তেজগাঁওয়ে গণপরিষদ ভবনে, বর্তমানে যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। খসড়া প্রণয়নে কমিটিকে সহযোগিতা করেছিলেন গাথরি নামের এক আইরিশ লোক। লোকটির পুরো নাম দুজনের কেউই মনে করতে পারেননি। গাথরি ব্রিটিশ আইনসভার খসড়া আইনপ্রণেতা (ড্রাফটসম্যান) ছিলেন। কমিটি প্রথমে সংবিধানের ইংরেজি পাঠ তৈরি করেছে। এরপর সেই পাঠকে বাংলায় রূপ দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। আনিসুজ্জামানের বন্ধু নিয়ামুল বশিরও এই কমিটির সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি গণপরিষদের সহকারী বিতর্ক সম্পাদক ছিলেন।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ১৯৭২ সালের ১৭ থেকে ২৯শে এপ্রিল পর্যন্ত এবং ১০ থেকে ২৫শে মে পর্যন্ত অনেকগুলো বৈঠক করে। এসব বৈঠকে প্রতিটি খসড়া বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তবে কিছু কিছু দফার ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা দিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৫ মের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব দফাকে একত্রিত করে একটি খসড়া সংবিধান তৈরি করা হয়। ৩ জুন কমিটির সভায় ওই খসড়া সংবিধান উপস্থাপন করা হয়। এরপর সভায় খসড়া সংবিধানের দফাওয়ারি আলোচনা শুরু হয়। ১০ জুন কমিটি খসড়াটি অনুমোদন করে।
খসড়া সংবিধান অনুমোদনের আগে কমিটির সদস্যদের মধ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। কামাল হোসেন ও আমীর-উল ইসলামের মুখে শুনেছি, বিভিন্ন বৈঠকের ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন।
২০১০ সালে সংক্ষিপ্ত এক সাক্ষাৎকারে কামাল হোসেন আমাকে বলেছিলেন, সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে। এই অনুচ্ছেদটির ব্যাপারে কমিটির সদস্যের কয়েক জনের আপত্তি ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তুলে ধরলেন ১৯৫৪ সালের অভিজ্ঞতা। তিনি আমাদের বলেছেন, তোমরা বলছো উন্নত দেশে এ ধরনের আইন নেই। কিন্তু আমার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা তাতে এমন একটি আইনের প্রয়োজন আছে। বঙ্গবন্ধুর অভিজ্ঞতার কথা আমরাও জানি। আক্ষরিক অর্থেই পাকিস্তানের আইনসভায় রীতিমতো ঘোড়ার মতো সংসদ সদস্য কেনাবেচা হতো। প্রতিদিনই সংসদে সদস্যদের দর পরিবর্তিত হতো। এটা তো গণতন্ত্র হতে পারে না। সেজন্যই তখন আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ গ্রহণ করেছিলাম।
আমীর-উল ইসলামের মুখে শুনেছি অন্য বিতর্কের কথা। তিনি বলেছেন, আমাদের জাতীয় ফুল শাপলা। এ বিষয়ে আমার ঘোর আপত্তি ছিল, কারণ শাপলার কোনো মেরুদণ্ড নেই। আমি বলেছি, জাতীয় ফুল হবে এমন একটি, যার সঙ্গে বাঙালির চরিত্রের মিল আছে, যার শিরদাঁড়া সোজা থাকবে। এক্ষেত্রে আমার পছন্দের ফুল ছিল রজনিগন্ধা। কিন্তু আমার সহকর্মীরা জানালেন, রজনিগন্ধা বাংলাদেশে সচরাচর দেখা যায় না। শেষ পর্যন্ত বিতর্ক এড়ানোর জন্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে শিল্পী কামরুল হাসানের মত গ্রহণ করা হলো। তিনি জানালেন, শাপলা ফুল জাতীয় ফুল হতে পারে। কারণ এটি আঁকতে সুবিধা।
বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম দুটি অনুচ্ছেদ হলো ৫৯ ও ৬০। দুটিই স্থানীয় সরকারবিষয়ক। দুটি অনুচ্ছেদই আমীর-উল ইসলামের কাছ থেকে এসেছিল। তিনি বলেছেন, স্থানীয় সরকার যদি না থাকে এবং এতে যদি জনগণের অংশগ্রহণ না থাকে, তাহলে দেশ একটি কেন্দ্রনির্ভর আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হবে। অনেক বিতর্ক শেষে স্থানীয় সরকার বিষয়ক অনুচ্ছেদ দুটি গৃহীত হয়। এ জাতীয় দুটি অনুচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে ভারতের সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
১০ জুনের সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, খসড়া সংবিধানটি চূড়ান্তভাবে গৃহীত হওয়ার আগে আইনের পেশাদার ড্রাফটসম্যান এবং বাংলার ভাষাবিদদের দিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে নেওয়া হবে। এর আলোকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান আনিসুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আলী আহসান ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মযহারুল ইসলামকে সদস্য করে একটি ভাষা বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়। এই কমিটি খসড়া সংবিধানের ভাষা পরীক্ষানিরীক্ষা করে।
ভাষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পরিমার্জিত খসড়া সংবিধান ১৯৭২ সালের ১০ আগস্ট কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়। কমিটি ওই দিন থেকে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এবং ৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বিভিন্ন বৈঠকে পরিমার্জিত সংবিধান নিয়ে আলোচনা করে এবং এরপর তা গণপরিষদে উপস্থাপনের জন্য চূড়ান্ত করা হয়।
খোন্দকার আবদুল হকের লেখা সংসদীয় রীতি ও পদ্ধতি বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি মোট ২৯টি বৈঠক করেছিল। কিন্তু এর সমর্থনে কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তবে ১২ অক্টোবর পরিষদ নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, ‘…প্রায় ৭২ দিন আমাদের এই কমিটির সদস্যরা কাজ করেছেন, চিন্তা করেছেন, আলোচনা করেছেন…।’ এ থেকেই কেউ কেউ মনে করেন, কমিটি মোট ৭২টি বৈঠক করেছিল।
গণপরিষদে সংবিধান বিল
১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। স্পিকার শাহ আবদুল হামিদের মৃত্যুজনিত কারণে এদিন অধিবেশনের শুরুতে ডেপুটি স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহকে স্পিকার এবং মোহাম্মদ বায়তুল্লাহকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নির্বাচিত করা হয় । এরপর বেলা ১১টার দিকে তৎকালীন আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনসহ সংবিধান বিল গণপরিষদে উত্থাপন করেন। কমিটর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বিলটির ওপর ৩০ অক্টোবরের মধ্যে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন। তবে তাঁর প্রস্তাব গৃহীত হয়নি।
কমিটির প্রতিবেদনে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ছয় জন সদস্যের বিরুদ্ধমত তুলে ধরা হয়। বিরুদ্ধমত দেওয়া ব্যক্তিরা হলেন- আছাদুজ্জামান খান, এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ, আবদুল মুনতাকীম চৌধুরী, হাফিজ হাবিবুর রহমান ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আছাদুজ্জামান খান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে লিখিত আপত্তি তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দলের বিপক্ষে ভোট দিলে সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে কোনো সদস্যকে বহিষ্কারের আগে বিষয়টির যথাযথ তদন্তের বা অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি।
আপত্তিতে এ কে মোশাররফ হোসেন আখন্দ বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কারের পর তার সংসদ সদস্যপদ বাতিল হয়ে যাবে। এই বিধানটি বাতিল করতে হবে। কারণ এর মাধ্যমে দলের ভাঙনের সৃষ্টি হবে।
সংবিধান বিল উত্থাপনের দিন থেকে পাশের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গণপরিষদে বিলটির বিভিন্ন দফা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। অসংখ্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। যার মধ্য থেকে অনেকগুলো গৃহীতও হয়। সবচেয়ে বেশি ৭০-এর বেশি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর একটি সংশোধনী প্রস্তাত গৃহীতও হয়। সেটি হলো, রাষ্ট্রপতি সংসদে ভাষণ দেওয়ার পর সংসদে ওই ভাষণের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে (অনুচ্ছেদ-৭৩)। এই জন্য শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সমাপনী ভাষণে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের প্রশংসাও করেছিলেন।
মানবেন্দ্র লারমার ওয়াক আউট
গণপরিষদের অধিবেশনের সবচেয়ে অলোচিত ঘটনাটি ঘটে ৩১ অক্টোবর। খসড়া সংবিধানের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে।’ ওই দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সদস্য আ. রাজ্জাক ভূইয়া (ঢাকা-১২, জাতীয় পরিষদ) তাঁর সংশোধনীতে প্রস্তাবিত ৬ নম্বর অনুচ্ছেদের সঙ্গে ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন’ যুক্ত করার প্রস্তাব করেন। আইনমন্ত্রী কামাল হোসেন এই প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেন।
এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম-১, প্রাদেশিক পরিষদ)। তিনি বলেন, ‘আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে। বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় বাঙালিদের সঙ্গে আমরা লেখাপড়া শিখে আসছি। বাংলাদেশের সঙ্গে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।...কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দপুরুষ- কেউই বলে নাই, আমি বাঙালি। আমার সদস্য-সদস্যা ভাইবোনদের কাছে আমার আবেদন, আমি জানি না, আজ আমাদের এই সংবিধান আমাদেরকে কেন বাঙালি বলে পরিচিত করতে চায়...।’
ওই পর্যায়ে স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ মানবেন্দ্র লারমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘আপনি কি বাঙালি হতে চান না?’
জবাবে মানবেন্দ্র লারমা বলেন, ‘...আমাদেরকে বাঙালি জাতি বলে কখনো বলা হয় নাই। আমরা কোনোদিন নিজেদেরকে বাঙালি বলে মনে করি নাই। আজ যদি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সংবিধানের জন্য এই সংশোধনী পাশ হয়ে যায়, তাহলে আমাদের এই চাকমা জাতির অস্তিত্ব লোপ পেয়ে যাবে। আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা আমাদেরকে বাংলাদেশি বলে মনে করি এবং বিশ্বাস করি। কিন্তু বাঙালি বলে নয়।’
ওই দিন রাজ্জাক ভূইয়ার সংশোধনী প্রস্তাবটি কণ্ঠভোটে পাশ হবার পর মানবেন্দ লারমা বলেন, ‘আমাদের অধিকার সম্পূর্ণরূপে খর্ব করে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদ সংশোধিত আকারে গৃহীত হলো। আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং প্রতিবাদস্বরূপ আমি অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য গণপরিষদের বৈঠক বর্জন করছি।’
বিল পাশ
সংবিধান বিল গণপরিষদে পাশ হয় ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর। ওই দিনের আলোচনায় মানবেন্দ্র লারমা বলেছিলেন, ‘...মাননীয় স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার যে সময় দিয়েছিলেন কথা বলার, সেটা আমি মনে করি, এই মহান গণপরিষদে গণতান্ত্রিক অধিকারের ঐতিহাসিক স্বাক্ষর হয়ে থাকবে।’ বক্তব্যের শেষ লাইনে মানবেন্দ্র লারমা সংবিধান উপহার দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘...আমার জীবনের আজকে সবচেয়ে আনন্দের দিন, সেই আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত আন্দোলন হয়েছে এই দেশে। আজকে, আমার দল যে ওয়াদা করেছিল, তার এক অংশ পালিত হলো। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। যে-কোনো ভালো জিনিস না দেখলে, না গ্রহণ করলে, না ব্যবহার করলে হয় না, তার ফল বোঝা যায় না। ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহিদের রক্তদান সার্থক হবে।’
এরপর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের বৈঠক মুলতুবি করা হয়।
নতুন সংবিধানের সমালোচনা
ঢাকা বার সমিতির সভাপতি আহমদ সোবহান, রাজনীতিবিদ আবুল হাশিম, আইনজীবী আলিম আল রাজী ও বদরুদ্দীন উমরসহ আরো অনেকই খসড়া সংবিধান বিলের সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, বিরোধী দলগুলো সংবিধানের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে পারেনি। (সাংবিধানিক আইনের মূলনীতি- আ ফ ম মহসীন)।
গণপরিষদে পাশ হওয়া সংবিধানে সেই সময়ে প্রতিবাদী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সই করেননি। তবে ২০১০ সালে তিনি সংবিধানের সমালোচকদের সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন, ‘আসলে ওই সময়ে পরাজিত শক্তির লোকজন মওলানা ভাসানীর পেছনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, যারা সংবিধান রচনা করেছে তারা তো নির্বাচিত নয়। মূলত ওই সময়ে মওলানা সাহেবকে পাকিস্তানি পরাজিত শক্তিদের যে-ই পেরেছে, ব্যবহার করেছে।’
সংবিধান ছাপা
৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাশ হওয়ার পর এটি ছাপার তোড়জোড় শুরু হয়। সংসদ সচিবালয়ের লাইব্রেরিতে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন-সংক্রান্ত কোনো তথ্য বা নথি না থাকায় এ বিষয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, শিল্পী হাশেম খান ও বিজি প্রেসের তৎকালীন উপপরিদর্শক সিদ্দিকুর রহমানের সাক্ষাৎকারের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানটি হাতে লেখা। হাতে লেখার এই কাজটি করেছিলেন শিল্পী আবদুর রউফ। এই সংবিধানে অলংকরণের কাজ করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, শিল্পী জনাবুল ইসলাম, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভী ও হাশেম খান। হাশেম খানের কাছে শুনেছিলাম, বঙ্গবন্ধু তাঁদের বলেছিলেন, তিনি নন্দলাল বসুর মতো কাজ দেখতে চান। নন্দলাল বসু ভারতীয় সংবিধানের অলংকরণের কাজ করেছিলেন।
হাতে লেখা সংবিধানের পাশাপাশি একই সময়ে ছাপার হরফে লেখা সংবিধান ছাপার কাজও শুরু হয়। এ বিষয়ে হাশেম খান ও সিদ্দিকুর রহমানের কাছ থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে সেটা এই রকম- কামাল হোসেন পদ্মা প্রিন্টিং প্রেসে সংবিধান ছাপতে চেয়েছিলেন। তাঁর প্রস্তাবে পদ্মা প্রেস জানিয়েছিল, সংবিধান ছাপতে ৫ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। এর মধ্যে ৩ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দিতে হবে। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তখন ওই পরিমাণ টাকা দেওয়া সম্ভব ছিল না। তখন কামাল হোসেন বিজি প্রেসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বিজি প্রেসে তখন ইংল্যান্ডের তৈরি ১৯৪৮ সালের দুটি ‘ক্র্যাবট্রি’ ব্র্যান্ডের অফসেট মেশিন ছিল। সেই মেশিনে পরীক্ষামূলকভাবে শিল্পীদের অলংকৃত সংবিধানের কিছু পাতা ছাপা হয়। তাতে দেখা যায়, সেই ছাপার মান ভারতীয় সংবিধানের ছাপার চেয়েও উন্নত। শেষ পর্যন্ত ওই মেশিনেই বাংলাদেশের সংবিধান ছাপা হয়। তাতে সরকারের খরচ হয়েছিল মাত্র ১৪ হাজার টাকা। কভার মুদ্রণ করা হয়েছিল ইস্টার্ন রিগ্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে।
যে দুটি মেশিনে সংবিধান ছাপা হয়েছিল সেগুলো দীর্ঘদিন বিজি প্রেসের পেছনের রেললাইনের ওপরে পড়ে ছিল। এ নিয়ে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম ২০১৩ সালের দিকে। শুনেছি, মেশিন দুটি নাকি এখন জাতীয় জাদুঘরে আছে। তবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই।
হাতে লেখা সংবিধানে সদস্যদের সই
৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাশের পর ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণপরিষদের বৈঠক মুলতুবি করা হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বরের অধিবেশনে সদস্যরা হাতে লেখা সংবিধানে নিজেদের সই প্রদান করেন। সবার আগে সই করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মোট ৩৯৯ জন সদস্য সই করেন। চার জন সদস্য সই করেননি।
প্রথম দিনে ৩৫১ জন সই করেন। পরের দিন ১৫ ডিসেম্বরের অধিবেশনের শুরুতে ৪৪ জন সই করেন। তখনো আট জনের সই করা বাকি। ওই অবস্থায় স্পিকার বলেন, আট জন সদস্যকে আহ্বান করে আমি পাই নাই। আমি শেষ বারের মতো তাদের আহ্বান করছি।
স্পিকারের ঘোষণার পর মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ চার জন সদস্য সংবিধানে সই করেন।
এরপর শেখ মুজিবুর রহমান স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “গতকাল আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম যে, কয়েক জন সদস্য অনুপস্থিত থাকতে পারেন এবং আমার মনে হয় কয়েক জন হজ করতে গেছেন, আর দুজন অসুস্থতাবশত আসতে পারেন নাই। আর যদি কেউ দস্তখত করার জন্য আসতে না পেরে থাকেন, তাতে কিছু আসে-যায় না। আপনি পরেও তাদের দস্তখত নিতে পারেন। এটা এই হাউজের পক্ষ থেকে অনুরোধ করেছিলাম এবং আপনি সেই অনুরোধ মেনে নিয়েছেন। সেজন্য ‘শেষবারের মতো’ বললে কিছুটা অসুবিধা হয়। সেটা আপনার রুলিং হয়ে যাবে। তাই আশা করি, আপনার রুলিং আপনি প্রত্যাখ্যান করে আমার অনুরোধ মেনে নেবেন।”
এরপর স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ হাউজের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি আজকের মতো এঁদেরকে আর একবার দেখি, এঁরা আছেন কি না। আমি ডাকছি- শ্রী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, শ্রীসুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, জনাব মোহাম্মদ আজিজার রহমান (রংপুর-২, প্রাদেশিক পরিষদ), জনাব মোহাম্মদ ইব্রাহীম (ময়মনসিংহ-৭, জাতীয় পরিষদ)।…আমাদের স্বাক্ষরদান অনুষ্ঠান শেষ হলো।’
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে স্পিকার মোহাম্মদ উল্লাহ গণপরিষদের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ও মানবেন্দ্র লারমা তাঁদের প্রতিবাদী চরিত্রের স্বাক্ষর রেখে সংবিধানে সই করেননি। কিন্তু আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ ইব্রাহীম ও মোহাম্মদ আজিজার রহমান কী কারণে সই করেননি স্পষ্ট নয়। তবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকে ধরে নেওয়া যায়, এঁরা অসুস্থ ছিলেন, অথবা দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন।
তথ্যসূত্র:
১। বাংলাদেশ গণপরিষদ বিতর্ক, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড
২। সংসদীয় রীতি ও পদ্ধতি- খন্দকার আবদুল হক, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
৩। সংবিধান বিল-১৯৭২
৪। খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির রিপোর্ট-১৯৭২
৫। বাংলাদেশের নির্বাচন (১৯৭০-২০০১)- এ এস এম সামছুল আরেফিন
বৈষম্যের দেয়ালে ঘেরা এই বিশ্বে এখনও ২০ কোটির বেশি শিশু রয়েছে সাধারণ শিক্ষার বাইরে। যারা যাচ্ছে, তারাও আবার অনেক বিদ্যালয়ে গিয়ে যা শেখার তা শিখছে না। এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালে নিম্ন আয়ের দেশে মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে, আবার কম আয়ের দেশে এই সংখ্যা আরও
১২ দিন আগেতাই স্বভাবতই প্রশ্ন আসে— বিষয়টি কী? কালো টাকার একটি নিজস্ব ধারণা রয়েছে। যেমন— দেশের কর আইনে ‘কালো টাকা’র সংজ্ঞা না থাকলেও ‘অপ্রদর্শিত আয়’ কথাটি উল্লেখ আছে। ফলে কোনো ব্যক্তি যখন তার আয়কর রিটার্নে তার আহরিত আয় প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন, সেই টাকাকেই কালো বলে ধরা হয়। এই আয় অবশ্য অবৈধ পথে নাও হতে পারে।
১২ দিন আগেপ্রত্যক্ষ করের আওতা সম্প্রসারণ এবং ভ্যাট আইন প্রয়োগ ও মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাট আদায় নিশ্চিত করে রাজস্ব বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আশানুরূপ ফল মেলেনি। দেশের মাত্র ৬০ থেকে ৬৫ নাগরিক বার্ষিক রিটার্ন দাখিল করেন। এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করদাতা ৪০ লাখ অতিক্রম করবে না।
১৪ দিন আগেক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আগামী সপ্তাহেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করতে যাচ্ছে প্রসিকিউশন টিম। জুলাই – অগাস্টের আন্দোলনের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলায় এখন আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে।
১৫ দিন আগে