
ড. মিহির কুমার রায়

দুই দশক আগে ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালী আবিষ্কার করেন হরি ধান। কেবল দারিদ্র্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তিনি পাননি। তবে কৃষিকাজে করেছেন মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে। তারই ফলশ্রুতিতে একটা সময় তিনি উদ্ভাবন করেন হরি ধান, যার উৎপাদন খরচ যেমন একদিকে কম, অন্যদিকে ফলনও বেশি।
প্রায় দুই দশক আগে হরিপদ কাপালী এই ধানের জাত উদ্ভাবন করলেও তার স্বীকৃতি মেলেনি আজও। একটি ধানের জাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়নি দুই দশকেও। অনেকেরই ধারণা, বীজ বাজারতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।
হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ৬ জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্যু হয় তার। স্ত্রী সুনিতী কাপালী ও এক দত্তক সন্তান রুপ কুমার কাপালীকে রেখে যান তিনি। হরিপদ কাপালীর শেষকৃত্য সম্পন হয় চুয়াডাঙ্গা জেলার আলীয়ারপুর শ্মশানঘাটে, যেখানে স্থানীয় কৃষি অফিসের কমকর্তাসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
হরিপদ কাপালীর ধান গিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ শুরু হয় মূলত ২০০২ সালে। ওই সময় যেখানে ইরি ধানের ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে তিনি তিন-চারটি ধানের গাছ দেখতে পান, যেগুলোতে ধানের ছড়ায় ধানগুলো ছিল অন্য ধানের চেয়ে মোটা ও আকারে বড়। এই ধান থেকে ভালো ফলন হতে পারে— এমন আশায় সেগুলো আলাদা করে রেখে দেন এই কৃষক গবেষক।
পরে এই ধানের বীজ থেকে চারা তৈরি করে ছোট্ট একটি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করেন। সেখানেও ফলন ভালো হয়। এরপর থেকে এ ধানের আবাদ বাড়াতে থাকেন হরিপদ কাপালী। পরে স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে এ ধানের আবাদ বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে এটি পরিচিতি লাভ করে হরি ধান হিসেবে।
বর্ষা মৌসুমে আবাদ করা মোটা জাতের এ ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হয় গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মণ হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম। এ ধানের ভাত খেতেও অনেক সুস্বাদু। ফলে ধানটি স্থানীয় কৃষকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও ধানটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষকরা বলছেন, হরি ধান মূলত ধানের জিনগত মিউটেশন থেকে সৃষ্ট জাত। ইনব্রিড জাত, হাইব্রিড নয়। হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজ বারবার কিনতে হয়। পরের বছরের জন্য বীজ করে চারা করলে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। বিপরীতে ইনব্রিড ধানের ক্ষেত্রে বীজ করে চারা করলে প্রায় শতভাগ উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব।
এই সফল আবিষ্কারটি প্রথম প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’র পরিচালক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। হরিপদ কাপালী ও তার উদ্ভাবিত হরি ধান নিয়ে চ্যানেলটিতে প্রচারিত শাইখ সিরাজের প্রতিবেদন দেশব্যাপী সাড়া ফেলে। কৃষি গবেষক মহলে ব্যাপক উৎসাহ সঞ্চার করে এই ধান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের একটি দল হরিপদ কাপালীর গবেষণার ক্ষেত্র পরিদর্শন করেন। বিভিন্নযুক্তি তর্কে অবতীর্ণ হয়ে তারা বলেন, এটি কোনো নতুন আবিষ্কার নয়, এটি মূলত ভ্যারাইটাল ট্রায়েল, যার এর আগে অনেক দেশেই হয়েছে।
তবে চ্যানেল আইয়ের প্রতিবেদন হরিপদ কাপালী ও তার ধানকে সরকারের নজরে নিয়ে আসে। সরকারের কৃষি বিভাগ পরীক্ষামূলকভাবে জামালপুর জেলাকে বেছে নেয় এবং সেখানকার কৃষকদের হরি ধান আবাদের পরামর্শ দেয়। এই ধানের আবাদ হতে থাকলে তখন প্রতিযোগিতামূলক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। কৃষি বিভাগ যুক্তি দেয়, ব্রি-১১ বা ব্রি-৫৬ জাতের চেয়ে হরি ধানের ফলন কম।
কৃষি বিভাগ তথ্য দিয়ে দেখায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি হরি ধানের উৎপাদন হার ছিল ৪ দশমিক ২ টন। অন্যদিকে ব্রি-৫৬ জাতের উৎপাদন হার ছিল তার চেয়েও বেশি, যা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৭৪ টন।
কৃষি বিভাগের এমন তথ্যের বিপরীত চিত্র উঠে আসে স্বাধীন গবেষণায়। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, হরি ধান আমন মৌসুমের উচ্চ ফলনশীল ব্রি-৫৬ জাতের চেয়েও বেশি ফলন দেয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ব্রি-৫৬ জাতের গড় উৎপাদন যেখানে ৫ দশমিক ৫১ টন, সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে হরি ধান উৎপাদন হয় ৬ দশমিক শূন্য ৮ টন। কাজেই হরি ধান ফলন নিয়ে যে প্রশ্ন কৃষি বিভাগ তুলেছিল, তার যৌক্তিকতাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
এখন হরিধানের বীজ সম্প্রসারণ ও অনুমোদনের যে প্রশাসনিক পদ্ধতি, তার জালে আটকে গেছে এই হরি ধানের ভবিষ্যত। তথ্য উপাত্ত বলছে, উচ্চ ফলনশীল জাতটির উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী সরকারি জেলা পর্যায়ের কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন— জেলা প্রশাসক পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারণ পুরস্কার, গণস্বাস্থ্য পুরস্কার, রোটারি ক্লাব পুরস্কার, চ্যানেল আই পুরস্কার ইত্যাদি। কিন্তু ২০১৮ সালে হরিপদ কাপালীর মৃত্যুর পর হরি ধানটি এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি।
নিয়ম অনুযায়ী স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কিছু নিয়ম ও নানা শর্ত পূরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে আবেদন করতে হয়। এরপর বীজটি পরীক্ষা করা হয়। সে পরীক্ষায় টিকলে আবেদন করতে হয় বীজ বোর্ডে, অনুমোদন মেলে সেখান থেকে।
নানা সূত্র থেকেই খবর মেলে, বীজ বোর্ডে বীজ ব্যবসায়ীরা আধিপত্য ধরে রেখেছে। হরি ধানের জাত হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে তাদের প্রভাব থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। স্থানীয় কৃষকের ভাষ্য, গুণে-মানে হরি ধান এগিয়ে থাকলেও বীজকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক।
হরি ধানের বাজারও সম্প্রসারিত হয়নি। এর পেছনে যথাযথ সংরক্ষণের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য, অনীহা, মাঠ সম্প্রসারণে তদারকির অভাবসহ আরও নানা নিয়ামকের কথা উঠে এসেছে।
একটা সময় ধান বীজের পুরো উৎস ছিল নিজেদের হাতে। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন, সে বীজ বিক্রি করতেন অন্য কৃষকের কাছে। সময়ের ব্যবধানে বীজ নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে যুক্ত হয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি শুরু করে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বরাবরই স্থানীয় জাতগুলোকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আসতে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। হরি ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় প্রজাতির উদ্ভাবিত এ উচ্চ ফলনশীল জাত সুকৌশলে একটি মহল বাজার থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। জাতটির আবাদ সম্প্রসারণ না করে উলটো মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ধানটির আবাদ কমেছে।
হারিয়ে গেছে স্থানীয় পর্যায়ে হরি ধানের মতো উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল অনেক ধান বীজ, বিলীনের পথে আরও কিছু জাত। এর মধ্যে হরি ধান অন্যতম। বিভিন্ন গবেষণায় এ ধানের উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কম সার লাগার তথ্য মিলেছে। দীর্ঘ সময় পেরোলেও এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণ করা যায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত বীজের জাত হিসেবে এর সরকারি স্বীকৃতিও মেলেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এ জাতটির বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কৃষি ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতি হলেও ফলন বাড়াতে গুণগত মানের বীজের ঘাটতি আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা। সে ক্ষেত্রে হরি ধানের মতো মোটামুটি পরীক্ষিত একটা ভালো বীজের প্রায় অবলুপ্তির সংকট তৈরি হওয়াটা ভীষণ উদ্বেগজনক।
হরি ধান সংরক্ষণ ও এর বাজার সম্প্রসারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হাইব্রিড বীজের পাশাপাশি স্থানীয় প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোও বড় ভূমিকা রেখেছে। নতুন নতুন জাত উন্মোচন হলেও হরি ধানের মতো সেগুলো বাজার কাঠামোয় অনেকটা সংকুচিত। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে বড় বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় উন্নত বীজগুলোর স্বীকৃতি প্রক্রিয়া থেকে শুরুকরে বাজার সম্প্রসারণ ব্যাহত করছে
এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উচ্চ ফলনশীল ধান বীজগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ, বাজার ও আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তায় স্থানীয় বীজের প্রসার নির্বিঘ্ন হবে বলে প্রত্যাশা।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা; সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা

দুই দশক আগে ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালী আবিষ্কার করেন হরি ধান। কেবল দারিদ্র্যের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ তিনি পাননি। তবে কৃষিকাজে করেছেন মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়ে। তারই ফলশ্রুতিতে একটা সময় তিনি উদ্ভাবন করেন হরি ধান, যার উৎপাদন খরচ যেমন একদিকে কম, অন্যদিকে ফলনও বেশি।
প্রায় দুই দশক আগে হরিপদ কাপালী এই ধানের জাত উদ্ভাবন করলেও তার স্বীকৃতি মেলেনি আজও। একটি ধানের জাতকে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্বীকৃতি পেতে যেসব প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সেই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়নি দুই দশকেও। অনেকেরই ধারণা, বীজ বাজারতকারী বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখে থাকতে পারে।
হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। ২০১৮ সালের ৬ জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্যু হয় তার। স্ত্রী সুনিতী কাপালী ও এক দত্তক সন্তান রুপ কুমার কাপালীকে রেখে যান তিনি। হরিপদ কাপালীর শেষকৃত্য সম্পন হয় চুয়াডাঙ্গা জেলার আলীয়ারপুর শ্মশানঘাটে, যেখানে স্থানীয় কৃষি অফিসের কমকর্তাসহ স্বজনরা উপস্থিত ছিলেন।
হরিপদ কাপালীর ধান গিয়ে গবেষণাধর্মী কাজ শুরু হয় মূলত ২০০২ সালে। ওই সময় যেখানে ইরি ধানের ক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে তিনি তিন-চারটি ধানের গাছ দেখতে পান, যেগুলোতে ধানের ছড়ায় ধানগুলো ছিল অন্য ধানের চেয়ে মোটা ও আকারে বড়। এই ধান থেকে ভালো ফলন হতে পারে— এমন আশায় সেগুলো আলাদা করে রেখে দেন এই কৃষক গবেষক।
পরে এই ধানের বীজ থেকে চারা তৈরি করে ছোট্ট একটি জায়গায় পরীক্ষামূলকভাবে আবাদ করেন। সেখানেও ফলন ভালো হয়। এরপর থেকে এ ধানের আবাদ বাড়াতে থাকেন হরিপদ কাপালী। পরে স্থানীয়ভাবে ও আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে এ ধানের আবাদ বিস্তার লাভ করে। ধীরে ধীরে এটি পরিচিতি লাভ করে হরি ধান হিসেবে।
বর্ষা মৌসুমে আবাদ করা মোটা জাতের এ ধানের বিঘাপ্রতি ফলন হয় গড়ে ১৫ থেকে ১৬ মণ হারে। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম। এ ধানের ভাত খেতেও অনেক সুস্বাদু। ফলে ধানটি স্থানীয় কৃষকের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ও ধানটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে। গবেষকরা বলছেন, হরি ধান মূলত ধানের জিনগত মিউটেশন থেকে সৃষ্ট জাত। ইনব্রিড জাত, হাইব্রিড নয়। হাইব্রিডের ক্ষেত্রে বীজ বারবার কিনতে হয়। পরের বছরের জন্য বীজ করে চারা করলে উৎপাদন প্রায় ৫০ শতাংশ কমে যায়। বিপরীতে ইনব্রিড ধানের ক্ষেত্রে বীজ করে চারা করলে প্রায় শতভাগ উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব।
এই সফল আবিষ্কারটি প্রথম প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘চ্যানেল আই’র পরিচালক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। হরিপদ কাপালী ও তার উদ্ভাবিত হরি ধান নিয়ে চ্যানেলটিতে প্রচারিত শাইখ সিরাজের প্রতিবেদন দেশব্যাপী সাড়া ফেলে। কৃষি গবেষক মহলে ব্যাপক উৎসাহ সঞ্চার করে এই ধান।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের একটি দল হরিপদ কাপালীর গবেষণার ক্ষেত্র পরিদর্শন করেন। বিভিন্নযুক্তি তর্কে অবতীর্ণ হয়ে তারা বলেন, এটি কোনো নতুন আবিষ্কার নয়, এটি মূলত ভ্যারাইটাল ট্রায়েল, যার এর আগে অনেক দেশেই হয়েছে।
তবে চ্যানেল আইয়ের প্রতিবেদন হরিপদ কাপালী ও তার ধানকে সরকারের নজরে নিয়ে আসে। সরকারের কৃষি বিভাগ পরীক্ষামূলকভাবে জামালপুর জেলাকে বেছে নেয় এবং সেখানকার কৃষকদের হরি ধান আবাদের পরামর্শ দেয়। এই ধানের আবাদ হতে থাকলে তখন প্রতিযোগিতামূলক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। কৃষি বিভাগ যুক্তি দেয়, ব্রি-১১ বা ব্রি-৫৬ জাতের চেয়ে হরি ধানের ফলন কম।
কৃষি বিভাগ তথ্য দিয়ে দেখায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হেক্টরপ্রতি হরি ধানের উৎপাদন হার ছিল ৪ দশমিক ২ টন। অন্যদিকে ব্রি-৫৬ জাতের উৎপাদন হার ছিল তার চেয়েও বেশি, যা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৭৪ টন।
কৃষি বিভাগের এমন তথ্যের বিপরীত চিত্র উঠে আসে স্বাধীন গবেষণায়। ২০১৯ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, হরি ধান আমন মৌসুমের উচ্চ ফলনশীল ব্রি-৫৬ জাতের চেয়েও বেশি ফলন দেয়। প্রতি হেক্টর জমিতে ব্রি-৫৬ জাতের গড় উৎপাদন যেখানে ৫ দশমিক ৫১ টন, সেখানে প্রতি হেক্টর জমিতে হরি ধান উৎপাদন হয় ৬ দশমিক শূন্য ৮ টন। কাজেই হরি ধান ফলন নিয়ে যে প্রশ্ন কৃষি বিভাগ তুলেছিল, তার যৌক্তিকতাও পর্যালোচনার দাবি রাখে।
এখন হরিধানের বীজ সম্প্রসারণ ও অনুমোদনের যে প্রশাসনিক পদ্ধতি, তার জালে আটকে গেছে এই হরি ধানের ভবিষ্যত। তথ্য উপাত্ত বলছে, উচ্চ ফলনশীল জাতটির উদ্ভাবক হরিপদ কাপালী সরকারি জেলা পর্যায়ের কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন— জেলা প্রশাসক পুরস্কার, কৃষি সম্প্রসারণ পুরস্কার, গণস্বাস্থ্য পুরস্কার, রোটারি ক্লাব পুরস্কার, চ্যানেল আই পুরস্কার ইত্যাদি। কিন্তু ২০১৮ সালে হরিপদ কাপালীর মৃত্যুর পর হরি ধানটি এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি।
নিয়ম অনুযায়ী স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কিছু নিয়ম ও নানা শর্ত পূরণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। প্রথমে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সিতে আবেদন করতে হয়। এরপর বীজটি পরীক্ষা করা হয়। সে পরীক্ষায় টিকলে আবেদন করতে হয় বীজ বোর্ডে, অনুমোদন মেলে সেখান থেকে।
নানা সূত্র থেকেই খবর মেলে, বীজ বোর্ডে বীজ ব্যবসায়ীরা আধিপত্য ধরে রেখেছে। হরি ধানের জাত হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার পেছনে তাদের প্রভাব থাকতে পারে বলে অনেকের অভিমত। স্থানীয় কৃষকের ভাষ্য, গুণে-মানে হরি ধান এগিয়ে থাকলেও বীজকেন্দ্রিক রাজনীতিতে এর স্বীকৃতি না পাওয়াটা দুঃখজনক।
হরি ধানের বাজারও সম্প্রসারিত হয়নি। এর পেছনে যথাযথ সংরক্ষণের ঘাটতি, প্রাতিষ্ঠানিক শৈথিল্য, অনীহা, মাঠ সম্প্রসারণে তদারকির অভাবসহ আরও নানা নিয়ামকের কথা উঠে এসেছে।
একটা সময় ধান বীজের পুরো উৎস ছিল নিজেদের হাতে। কৃষক নিজে বীজ সংরক্ষণ করতেন, সে বীজ বিক্রি করতেন অন্য কৃষকের কাছে। সময়ের ব্যবধানে বীজ নিয়ে গবেষণা, উন্নয়ন ও উৎপাদনে যুক্ত হয় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। আবার কিছু প্রতিষ্ঠান আমদানি শুরু করে। নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে তারা বরাবরই স্থানীয় জাতগুলোকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আসতে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে থাকে। হরি ধানের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে।
অভিযোগ রয়েছে, দেশীয় প্রজাতির উদ্ভাবিত এ উচ্চ ফলনশীল জাত সুকৌশলে একটি মহল বাজার থেকে উঠিয়ে দিয়েছে। জাতটির আবাদ সম্প্রসারণ না করে উলটো মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ধানটির আবাদ কমেছে।
হারিয়ে গেছে স্থানীয় পর্যায়ে হরি ধানের মতো উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল অনেক ধান বীজ, বিলীনের পথে আরও কিছু জাত। এর মধ্যে হরি ধান অন্যতম। বিভিন্ন গবেষণায় এ ধানের উচ্চ উৎপাদনশীলতা ও কম সার লাগার তথ্য মিলেছে। দীর্ঘ সময় পেরোলেও এ ধানের আবাদ সম্প্রসারণ করা যায়নি। এমনকি এখন পর্যন্ত বীজের জাত হিসেবে এর সরকারি স্বীকৃতিও মেলেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় এ জাতটির বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এর সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। কৃষি ক্ষেত্রে নানা অগ্রগতি হলেও ফলন বাড়াতে গুণগত মানের বীজের ঘাটতি আমাদের দেশে একটা বড় সমস্যা। সে ক্ষেত্রে হরি ধানের মতো মোটামুটি পরীক্ষিত একটা ভালো বীজের প্রায় অবলুপ্তির সংকট তৈরি হওয়াটা ভীষণ উদ্বেগজনক।
হরি ধান সংরক্ষণ ও এর বাজার সম্প্রসারণে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দেশের কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হাইব্রিড বীজের পাশাপাশি স্থানীয় প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল জাতগুলোও বড় ভূমিকা রেখেছে। নতুন নতুন জাত উন্মোচন হলেও হরি ধানের মতো সেগুলো বাজার কাঠামোয় অনেকটা সংকুচিত। নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে বড় বীজ প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় উন্নত বীজগুলোর স্বীকৃতি প্রক্রিয়া থেকে শুরুকরে বাজার সম্প্রসারণ ব্যাহত করছে
এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় উচ্চ ফলনশীল ধান বীজগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ, বাজার ও আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সক্রিয়তায় স্থানীয় বীজের প্রসার নির্বিঘ্ন হবে বলে প্রত্যাশা।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; গবেষক ও ডিন, সিটি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা; সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবীদ সমিতি, ঢাকা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ জুলাই জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে খুব শিগগিরই একটি আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা প্রকাশের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।
২০ দিন আগে
অনেকে বলছেন, এবারও পুরস্কারটি যেন পশ্চিমা শক্তি ও মার্কিন নীতির সমর্থনে বিতরণ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি, দেশটির বিপুল তেল মজুদ, সাধারণ জনগণের কষ্ট—সবকিছুই এক জটিল চিত্র তৈরি করেছে।
২২ দিন আগে
ইতিবাচক দিকে জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’র লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।
২২ দিন আগে