মতামত

কলামিস্ট তারিখ ইবরাহিমের অনন্ত যাত্রা

ড. মোহাম্মদ হাননান

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে কলমযোদ্ধাদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল কলামিস্ট তারিখ ইবরাহিমের নিয়মিত কলাম। সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায় তখন বিভুরঞ্জন সরকার নিয়মিত কলাম লিখছিলেন। সামরিক সরকার তখন কথায় কথায় নানা রকম সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিত। ফলে বিভুরঞ্জন সরকার নাম পাল্টালেন। তিনি হয়ে উঠলেন ঢাকার বিশিষ্ট কলামিস্ট— লেখক ‘তারিখ ইবরাহিম’। প্রতি সপ্তাহে যায়যায়দিন বের হওয়ার সাথে সাথেই সবার চোখ গিয়ে পড়তো তারিখ ইবরাহিমের রাজনৈতিক বিশ্লেষণী কলামের ওপর।

অসাধারণ ছিল তারিখ ইবরাহিমের রাজনৈতিক ভূত-ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত আলোচনাগুলো। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্মীরা এ থেকে খোরাক পেতেন। কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদরাও সে সময় তারিখ ইবরাহিমের লেখা থেকে পাথেয় খুঁজতেন। কেউ সেদিন জানতে পারেনি, সামরিক সরকারের গোয়েন্দারাও খুঁজে বের করতে পারেনি তারিখ ইবরাহিম নামক কলামিস্টের গোষ্ঠী-তথ্য। এ জন্য একটা বড়ো কৃতিত্ব ছিল যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদক শফিক রেহমানের। তিনি সামরিক আইনের থোড়াই কেয়ার করতেন।

১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আদ্যোপান্ত খুঁজতে বিভুদা ঢাকার আশেপাশের কয়েকটি এলাকা সফর করেছিলেন। এ নিয়ে তারিখ ইবরাহিমের যা লিখলেন, তাতে সামরিক সরকারের মধ্যে খুব নাখোশ ভাব ফুটে উঠল। নিশ্চিত হতে না পারলেও গোয়েন্দারা অনুমান করত বিভুরঞ্জন সরকারই তারিখ ইবরাহিম। নির্বাচনের রিপোর্ট যেদিন প্রকাশিত হলো সেদিনই বিভুরঞ্জন সরকারকে তথ্যমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সচিবালয়ের কার্যালয়ে পুলিশ ধরে নিয়ে এলো। শাহ মোয়াজ্জেম তারিখ ইবরাহিমকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন, দেখতে তো মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মতো লিকলিকে, এসব ছাইপাশ লেখেন কীভাবে!

শাহ মোয়াজ্জেম প্রস্তাব করলেন, আজই আমার নির্বাচনী এলাকায় যাবেন এবং সমস্ত কিছু পর্যালোচনা করে নতুন করে রিপোর্ট করবেন। আমি গাড়ি দিচ্ছি।

তারিখ ইবরাহিম বললেন, সরকারি গাড়িতে সাংবাদিকরা ওঠেন না। আমি নিজেই আবার যাব। আবার রিপোর্ট করব।

সন্ত্রাসী রাজনীতিক হিসেবে শাহ সাহেবের (কু)খ্যাতি ছিল। ১৯৭২-১৯৭৫ আওয়ামী লীগ আমলে, ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর ৮২ দিন খন্দকার মোশতাক আহমদের আমলে, এরপর ১৯৮২ সালের পর জেনারেল এরশাদের আমলে তার দোর্দণ্ড প্রতাপে মুন্সিগঞ্জের রাজনীতি কাঁপত।

বিভুরঞ্জন সরকার যায়যায়দিন সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে ঠিকই গিয়েছিলেন মুন্সিগঞ্জের লৌহজং-শ্রীনগর এলাকায়। ফিরে এসে তারিখ ইবরাহিমের কলামে লিখলেন, ‘নির্বাচনের পর কেমন আছে মুন্সিগঞ্জের মানুষ’। নাম ধরে ধরে লিখলেন, অমুকের ছেলে তমুক এখন শাহ বাহিনীর জুলুমে ঘর ছাড়া। এরকম অনেক জীবন্ত ঘটনা তুলে ধরলেন। শাহ মোয়াজ্জেম আর যোগাযোগ করেননি।

বিভুরঞ্জন সরকার সাংবাদিকতা করবেন ছাত্রজীবনেই তা টের পাওয়া যাচ্ছিল। কারণ ছাত্র ইউনিয়নের প্রচার-প্রকাশনা, ডাকসু নির্বাচন, একুশের সংকলন, জয়ধ্বনি প্রকাশ ইত্যাদি যত কাজ একা বিভুই করতেন। এসব কাজে তিনি যে মননশীলতা ও সৃজনশীলতা দেখিয়েছিলেন, তা গোটা ছাত্র ইউনিয়নকেই গৌরাবান্বিত করেছিল। যদিও ছাত্র ইউনিয়নের ১৯৭৯-৮০ কমিটিতে তিনি প্রচার সম্পাদক ছিলেন এবং ১৯৮০-৮১ কমিটিতে তিনি হন সহকারী সম্পাদক। এ কমিটিতে আমি ছিলাম সমাজকল্যাণ সম্পাদক। সে সুবাদে তাঁর সঙ্গ লাভ করি।

ছাত্র ইউনিয়ন থেকে বিদায় নেবার আগেই বিভুরঞ্জন সরকার যোগ দিয়েছিলেন সাপ্তাহিক একতায়। একতায় তখন সম্পাদক ছিলেন মতিউর রহমান (বর্তমানে প্রথম আলো-র সম্পাদক)। তারপরেই ছিলেন মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ভাই (সাবেক সম্পাদক সমকাল), আমিও একদিন সাপ্তাহিক একতার টেবিলে যোগ দিলাম। একটি কক্ষে চারটি টেবিল। একটি মঞ্জু ভাই, একটিতে তানভির মোকাম্মেল, আকেরটিতে বিভুরঞ্জন সরকার। একটি চেয়ার খালি ছিল। আমি প্রবেশ করতেই বিভুদার সহাস্য সম্ভাষণ। এখানেও বিভুদার সঙ্গ লাভ করি কিছুদিন।

যেখানেই যেতন বা থাকতেন তিনি তার রসের ভাণ্ডার খুলে জমিয়ে রাখতেন। এজন্য ছাত্র ইউনিয়নের মেয়েদের মধ্যে তাঁর ছিল খুব কদর। সকলের দুঃখ ও কষ্টের মধ্যেও তিনি হাসি ফুটিয়ে তুলতেন। ছাত্র-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, গণসংযোগ করে সকলের খবর রাখা তাঁর নিয়মিত কাজের একটি অংশ ছিল। খুব বেশি মানবতাবাদী ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। সর্বদা সহাস্য থাকা তাঁর চরিত্রের একটি বড় গুণ ছিল।

এর অনেকদিন পরের কথা। অনেকদিন যোগাযোগ নেই। আমি সরকারি চাকরি করি। সম্পর্কটা আরো অনেক দূরে চলে গেছে। বিভুরঞ্জন সরকার তখন দৈনিক ইত্তেফাক-এ যোগ দিয়েছেন অথবা দৈনিক ইত্তেফাক-এ নিয়মিত লেখেন। সেখানে তিনি একদিন লিখলেন, ‘একদিন কমিউনিস্ট ছিলাম রে’ শিরোনামে একটি লেখা। এতে কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন ভূমিকার বিরুদ্ধে খুব কঠিন-কঠিন কথা লিখলেন। কিছু অংশ আমি মানতে পারলাম না। আমি এর বিরুদ্ধে একটা পাল্টা লেখা লিখলাম। তাঁর প্রতি ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ তুলে কঠিন কয়েকটা শব্দ প্রয়োগ করেছিলাম। তিনি কষ্ট পেয়েছিলেন এতে এবং আমাকে ফোন করে তার প্রতিবাদ করেছিলেন। এখন সে কথা মনে করে খুব কষ্ট পাই। মতাদর্শগত বিতর্কের জেরে লেখাগুলো হয়তো ঠিকই ছিল, কিন্তু এমন লেখা না লিখলেই ভালো, যা পরে কষ্ট দেয়।

বিভুরঞ্জন সরকার অনেক গণমাধ্যমে কাজ করেছেন। শুধু তিনি নন, সকল সৎ ও সংগ্রামী সাংবাদিককেই অনেক গণমাধ্যমে কাজ করতে হয় শুধু জীবিকার তাগিদে নয়, লেখার স্বাধীনতার জন্যও তাঁকে এখান থেকে আরেক ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু সাংবাদিক দেখেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যত সহজ, নিজের প্রতিষ্ঠানে স্বাধীন মত নিয়ে লেখার সংগ্রাম তত কঠিন। বিভুরঞ্জন সরকার আত্মহননের লোক নন, সদাহাস্য লালন করা মানুষটি কোনো পরিস্থিতি বা বাস্তবতায় নিজের জীবন সম্বন্ধে এমন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা হয়তো আমরা অনুমান করতে পারি, কিন্তু খুঁজে পাব না।

লেখক: কলামিস্ট ও গবেষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

চিকিৎসা শিক্ষায় সংকট: বাণিজ‍্য ও অর্থনৈতিক চাপ

অনেক মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী–শিক্ষক অনুপাত ২০:১, যা বিশ্ব স্বাস্থ‍্য সংস্থার সুপারিশকৃত মানের দ্বিগুণ। ২০২৪ সালের বিএমঅ্যান্ডডিসি জরিপে দেখা যায়, ৩৫% বেসরকারি কলেজে মৌলিক বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। দুর্বল বেডসাইড প্রশিক্ষণ ও ইন্টার্নশিপ তত্ত্বাবধানের অভাবে নতুন ডাক্তাররা বাস্তব অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে

৮ দিন আগে

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন : বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও প্রান্তিকের খাদ্য নিরাপত্তা

বিশ্বব্যাংক খাদ্য মূল্যস্ফীতির সূচক তৈরির ক্ষেত্রে কিছু ধাপ অনুসরণ করে। এর মধ্যে যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে গড়ে ২ শতাংশের কম বাড়ে ওইসব দেশকে সবুজ তালিকায় রাখে। অর্থাৎ কোনো ঝুঁকি নেই। যেসব দেশের খাদ্যপণ্যের দাম প্রতি মাসে ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে বাড়ে ওইসব দেশকে হলুদ তালিকায় রাখে।

৮ দিন আগে

পোষ্য ভর্তি: মত-মতান্তর

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রাক আলোচনায় কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা সুনিদির্ষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে শিক্ষার্থীরা এ সিদ্ধান্তের ব্যাপক বিরোধিতা করে বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেয়ার যে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, তা লক্ষণীয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো কোনো শিক্ষার্থী পোষ্য ভর্তি ফের চালু করলে বিগত সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ

৯ দিন আগে

সিগারেটের মহামারি

এই ছোট্ট ঢাকা শহর যেখানে ৪ কোটি মানুষের বাস এর অলিতে, গলিতে, ফুটপাতে, রিক্সাওয়ালা এমনকি কখনও কখনও রিক্সার যাত্রী, টেক্সি ওয়ালা, মোটর বাইক চালক,পিছনের সঙ্গী বা যাত্রী সিগারেট টানছে। বহু হাই অফিসিয়াল কর্পোরেট বস সুযোগ খুঁজে নেমে পড়েন নিচে।

১০ দিন আগে