‘যদি’, ‘কিন্তু’ আর ‘কেউ’-এর ফাঁদে কাঁদছে ক্ষমা!

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ০৭

সুদূর আমেরিকায় বসে বাংলাদেশের ভুক্তভোগীদের উদ্দেশে বার্তা। তাও সেই বার্তা ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’নির্ভর! ঘোরতর বিস্ময়ে স্তব্ধতায় ডুবে যেতে হয়। মানে ব্যথা পেয়েছেন কি না, তা বায়বীয়? রক্তপাত–হত্যা–নিধন, ধর্ষণ, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর কাছে মা-বোনদের বর্গা দেওয়া, ক্যাম্পে ক্যাম্পে নারী–শিশুদের আটকে রেখে নির্যাতনের ব্যথা বা কষ্ট নেই বুঝি!

বুধবার (২২ অক্টোবর) জামায়াতের আমিরের ক্ষমা চাওয়ার কৌশলী মারপ্যাঁচে আমার সেই ইতিবাচক মোটিভেশন বক্তব্যটির উল্টো বোধের ভাবধারায় মনে পড়েছে— “সবাই হার মানে না, কেউ কেউ শুধু একটু থেমে যায়—আরও শক্ত হয়ে ফিরে আসার জন্য।”

সত্যি রাষ্ট্রক্ষমতার কী শক্তি! রাষ্ট্রের অসীম ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ারে গদিনসিন হতে এই তিনারা হার না মেনে শুধু খানিক থেমে নতুন শক্তিতে ফিরে আসার জন্য কত কথা বলছেন। নতুন সব চিন্তা ও মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে কৌশলের ফাঁদ পেতেছেন। যে ফাঁদে “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা” বেঁচবে ভোটের বাজারে! জনগণ ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ এবং ‘কেউ’ শব্দগুলো উপলব্ধি করতে না পারেন, তবে তো বিজয়ী হবে না তিনারা।

ডা. শফিকুর রহমান বলেন, সাতচল্লিশ (১৯৪৭ সাল) থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমাদের দ্বারা যে যেখানে যত কষ্ট পেয়েছেন আমরা বিনা শর্তে তাদের কাছে মাফ চাই।

তিনি এদিন নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার কথা বললেও এর আগে তিনি বলেছিলেন, যদি একাত্তরের ভুল ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়’ তবে তিনি ক্ষমা চাইবেন, যা আরও বিতর্ক তৈরি করেছিল। জামায়াত আমির বলেন, এই অ্যাপলজি (ক্ষমা প্রার্থনা) কমপক্ষে তিনবার চেয়েছি।

‘‘অধ্যাপক গোলাম আযম, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং আমিও চেয়েছি। কিছুদিন আগে এ টি এম আজহার যখন জেল থেকে মুক্তি পেলেন তখনো বলেছি। শুধু এখন নয়, ’৪৭ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর দ্বারা কেউ যদি কোনো কষ্ট পান, কারও কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে, আমি সব ব্যক্তি এবং সংগঠনের পক্ষে নিঃশর্তে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই, আপনারা আমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন’’,— বলেন তিনি।

নেটিজেনদের অনেকেই বলছেন, ভোটকে সামনে রেখে এটা জামায়াতের একটা চাল। কারণ ক্ষমা চাওয়ার দাবি তো দীর্ঘ দিনের। তাহলে মার্কিন মুল্লুকে গিয়ে কেন ক্ষমা চাইতে হলো। দেশের বাইরে গিয়ে ক্ষমা চাওয়ায় রাজনৈতিক মহলে নতুন বিতর্ক ও সমালোচনা শুরু হয়েছে, বিষয়টি বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হচ্ছে।

১৯৭১-এর রণাঙ্গনের ময়দান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের সময়ের দূরত্ব অর্ধশত বছরের বেশি। ৫৪ বছরে ভুক্তভোগী মানুষের অনেকেই বেঁচে নেই। স্মরণে নেই দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়া ভোগান্তির শিকার মানুষদেরও।

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর একটি বক্তব্য বহুবার, বহু সময় ব্যাখ্যা করেছি। বিপ্লবী জনমানুষের এই নেতা বলেছিলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমার আসল নিয়তি হচ্ছে যুদ্ধ করা, যেটা আমি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছি।”

এই বক্তব্যটির ব্যাখ্যায় আমি সহজেই লিখি— সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বড় শক্তির সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ে টিকে আছে ল্যাটিন আমেরিকার জনমানুষেরা এবং তাদের নেতা ফিদেল কাস্ত্রো। আর আমাদের দুঃখ— আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মের গৌরবময় মাহাত্ম্য বিরোধিতাকারী একটি দলের সঙ্গে গত ৫৪ বছর লড়ে যাচ্ছি। এই লড়াইয়ে ঘরের সেই শত্রু বিভীষণকেই আমাদের প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে বুঝে ও সামলে চলতে হয়। কারণ প্রতিদিন এই স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী শক্তির আগ্রাসনে ধরন পাল্টে যাচ্ছে। স্বাধীন দেশের বিপক্ষ শক্তি মনস্তাত্ত্বিক বোধে, চিন্তায়, চেতনায় নয়া প্রজন্মকে ধোঁকা দিচ্ছে। আর্থিকভাবেও তারা ক্রমশ এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে তারা দীর্ঘ পরিকল্পিত নীলনকশায় তাদের সমর্থক গোষ্ঠী বাড়াতে তৎপর।

সর্বনাশের কথা এই, এই গোষ্ঠীর ফাঁদে আটকে গেছে দেশের একশ্রেণির শিক্ষিত, সুশীল, সুবিধাবাদী নাগরিক গোষ্ঠী।

তবে এটাও ঠিক, স্মৃতি কখনো মরে না। আর যন্ত্রণাভুক্ত ভুক্তভোগী মানুষের ক্ষতগুলো মানুষদের তাড়িয়ে ফেরে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যথার্থই বলেছেন, “স্মৃতি কখনো মরে না, সে কেবল নীরব হয়ে যায়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উক্তিটি খুবই গ্রহণযোগ্য ও হৃদয়গ্রাহী। তিনি বলেছিলেন, “ভুলে যাওয়া যায় মানুষকে, কিন্তু তার রেখে যাওয়া স্মৃতিকে নয়!”

১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বুদ্ধিজীবীদের তুলে নিয়ে হত্যার কাজটি করেছিল আল-বদর বাহিনী। এই বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। তিনি ১৯৭১ সালে তখনকার জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রধান ছিলেন।

এই ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়েই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী মিলিশিয়া হিসেবে গঠিত হয়েছিল আল-বদর বাহিনী।

মতিউর রহমান নিজামী নিজেই আল-বদর বাহিনীর কার্যক্রমের সাফাই গেয়েছেন তখনকার সংবাদপত্রে বিবৃতি দিয়ে। সেই বিবৃতিতে “পাকিস্তানের শত্রুদের কাছে আল-বদর বাহিনীকে তিনি সাক্ষাৎ আজরাইল” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক আফসান চৌধুরী কয়েক বছর আগে গণমাধ্যমে তার গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলে, “সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উদ্যোগে এই বাহিনী প্রতিষ্ঠা করা হয়।” তিনি বলেছিলেন, “মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান বাহিনী ভেতর থেকে কোনো প্রতিরোধ হবে বলে ভাবেনি। তাদের প্রস্তুতিও ছিল না। কিন্তু সারা দেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম গণহত্যা-নিধনে সারা বাংলাদেশেই প্রতিরোধ শুরু হলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান নামক দেশটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার দরকার পড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বুঝতে পারে, পুরো বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব না। তখনই পাকিস্তান সেনাবাহিনী, ভিন্ন এক দেশ, পৃথক ভৌগলিক অবস্থান, অচেনা এক দেশে তাদের যে সহায়ক ছিল—সেই রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্মের বিরোধী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গঠন করে আল-বদর বাহিনী।”

ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণ জনগণ, ভুক্তভোগী এবং গবেষণা বলছ, আল-বদর বাহিনী গঠনের পর এই আল-বদর বাহিনীর সদস্যরা মূলত শহরাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের হত্যা-নিধন, জ্বালাও-পোড়াও, ধরপাকড়, মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে নিয়ে যাওয়া, হত্যা করার সব কাজে সহায়ক ছিল। আর গ্রামাঞ্চলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যা, নিধন, জুলুম, নারী নির্যাতন, লুটতরাজের মতো নানা ধরনের পৈশাচিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করেছে রাজাকার বাহিনী।

প্রত্যক্ষদর্শী প্রবীণ ভুক্তভোগীরা তাদের চোখে দেখা, সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে ফেরার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ইতিহাস সাক্ষী—সেই সব সত্যগাঁথা নানা ভাবে সংবাদপত্রে, গল্প-উপন্যাসে, গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

১৯৭১-এ আল-বদর, রাজাকার সংগঠন হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহায়ক শক্তি হিসেবে বেসামরিক বাহিনীর মর্যাদায় বেতনভুক্ত হয়ে নিজ দেশের মানুষ, স্বজাতি ও নিজ ধর্মভাই এমনকি এলাকার পড়শী, আত্মীয়স্বজনদের প্রতিও নির্মমতা চালাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয় সহযোগী হয়ে কাজ করেছে। এই সংগঠনের নেতৃত্ব ও সদস্যরা নিজেদের বিপক্ষে গিয়ে ভিনদেশি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের হয়ে কাজ করেছে কি শুধু মনস্তাত্ত্বিক যুক্তিতে? না, এর সঙ্গে ছিল বিপুল আর্থিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রাপ্তির নিশ্চয়তাও।

একাত্তরের রণাঙ্গনের ময়দানে এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম্যের জন্য লড়াইয়ের সকল নেতা, কর্মী, যোদ্ধা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিক্ষক-লেখক, সাহিত্যিক এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের বাড়িঘরের ঠিকানা সংগ্রহ করে তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে তুলে দিয়েছে। বিনিময়ে যুদ্ধাবস্থায় নিজেরা ছিল নিরাপদ। উপরন্তু উপঢৌকন পেয়েছে। এ জন্যই আমরা দেখি, রণাঙ্গনের সাধারণ আমজনতার মধ্যে সাধারণ কৃষক, কুলি, দিনমজুর, সাধারণ শিক্ষার্থী হলেও আল-বদর ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা ছিলেন সমাজের বিত্তশালী সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এ দেশীয় উপনিবেশিক প্রভুদের পা-চাটুকাররা বরাবরই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে, সুযোগ-সুবিধা পেয়ে তাদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত থেকে মজবুততর করেছে। সেই টাকায় গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, ট্রাস্ট— যা হয়ে উঠেছে দলটির নিরবচ্ছিন্ন আর্থিক নিশ্চয়তার উৎস।

এই আল-বদর আর রাজাকার সংগঠন ও সদস্যরা সংঘবদ্ধভাবে, নিপুণ একনিষ্ঠ সমর্থনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ডান হাত হয়ে উঠেছিল। শুধু কি তাই? পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা, এ দেশের রাস্তাঘাট, কালভার্ট, খাল-নালা, নদীর বাঁক— সবই চিনিয়ে দিতে সার্বক্ষণিক পাশে থেকেছে আল-বদর, আল-শামস। বিনিময়ে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা নিজেদের সহায়-সম্পদ, গৃহস্থালি, সন্তান, নারী-শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিল। স্বাধীনতাকামী ও তাদের সহযোগী সাধারণ জনমানুষের ঘরবাড়ি, জীবন-জীবিকা, গরু-বাছুর, গোলার ধান, গাছের ফল, পুকুরের মাছ লুটে নিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হেন কোনো কর্ম নেই যে আল-বদর- রাজাকাররা করেনি। বিনিময়ে জীবন ও অঢেল সম্পদের পাহাড়ের মালিক হয়ে এই জনগোষ্ঠী ও মতাদর্শের সন্তানরা বিদেশে উচ্চ শিক্ষার সুযোগে বেড়ে উঠেছে। তবে পারিবারিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে গলদ থাকায় উন্নত দেশের বাসিন্দা হয়েও নিজ দেশের বিরোধিতায় ভার্চুয়ালে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। ৫ আগস্ট পরবর্তী তাদের ভয়েসে যতটা গত ১৬-১৭ বছরের শাসন-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল, তার চেয়ে ঢের বেশি ছিল স্বাধীনতা, একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী।

একাত্তরের পরাজিত শক্তির সহযোগীরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রেও সব ধরনের সুফল ও সুবিধাভোগী হয়েছে। সেই ১৯৭১-এর মতোই আজকের সুবিধাভোগী সুশীলদের সেদিনের বীজ প্রতিনিধিরা নিজেরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে থেকে এ দেশের কোটি মানুষের সন্তান, সহায়-সম্পদ, নারীদের জীবন দুর্বিষহ করার কাজে সহযোগিতা করে আখের গুছিয়েছে। আজ সেই জনগোষ্ঠীর পরের প্রজন্মরা এ দেশে রামরাজত্ব করেছে। যথাযথভাবে আখের গুছিয়ে শিক্ষা, জ্ঞান, ভোগ-বিলাসের জীবনে এগিয়ে থেকেছে। তবে যেহেতু এত কিছুর পরেও নষ্ট বীজ আর গোষ্ঠীআবদ্ধতার মনোভাব ও মনোজগতের পরিবর্তন হয়নি, বিধায় আজও তারা দেশবিরোধী অবস্থানে ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে।

তবে যে বেদনা আর ক্ষত করে রেখেছে তারা, সেই ক্ষতে মলম দিতে নিছক বাহারি বুলির “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা”য় কাজ হবে না। হওয়া উচিতও নয়। কেননা এই দুটি শব্দের কৌশলে “ক্ষমা ক্ষমা খেলা”র আড়ালে পাকিস্তানের পরাজয়ের গ্লানি ভুলাতে সেই অকার্যকর পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামো ও ইসলামী রাষ্ট্রে ফেরাতে তৎপর এই তাহারা। ইসলামী রাষ্ট্রের নামকরণে পাকিস্তান কায়েম করাই তাদের উদ্দেশ্য।

তাই হাজার মাইল দূরে গিয়ে “ক্ষমা ক্ষমা খেলা”র অবতারণা। কাগুজে বুলিতে “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা”র তেলেসমাতির নামে কিঞ্চিৎ সুবিধা তারা পাবে। কারণ এরই মধ্যে কতক মিডিয়া, অনলাইন, ইউটিউবে, ফেসবুকে ক্ষমার খণ্ডিত অংশ “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা” এই দুটি শব্দে বহুত বার্তার মহাসমারোহে জোর দিয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বোধে ধাক্কা দেওয়ার মোনাফেকি করেছে। অনেক গণমাধ্যমই কথিত “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা”র প্রসঙ্গে এতটাই জোর দিয়েছে যে তারা পরের বক্তব্যে ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ এবং ‘কেউ কষ্ট পেলে’ শব্দগুলোকে অনেকটাই উপেক্ষা রেখেছে।

তথাপিও “আনুষ্ঠানিক ক্ষমা” শব্দের জোর উচ্ছ্বল ব্যবহারের হেডলাইন করে প্রচার-প্রসারের যে খেলা, এই খেলায় তারা খানিক সুবিধা পাবেন বটে। কারণ নয়া প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা ইতিহাস পড়ে না, যারা দাদু-নানুর কোলে চড়ে গ্রামীণ পরিবেশে বাংলাদেশের অপরূপ রূপ দেখার সুযোগ পায়নি, তারা তো ‘যদি’, ‘কিন্তু’র ফাঁদে বিভ্রান্ত হবে। কারণ এই বড় প্রজন্ম উঠতি মধ্যবিত্ত—যেনতেনভাবে পয়সার মুখ দেখা পরিবারের বেড়ে উঠেছে। যাদের পরিবারে বছরে দুই-চারবার সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া ঘোরার সুযোগ হয় বটে, তবে সময় হয় না নিজ দেশের মাটি, মানুষ ও গ্রামবাংলার মহিমার অপার স্নিগ্ধতা দেখার।

তবে আশার কথা— অনেকেই ‘যদি’, ‘কিন্তু’, ‘কেউ কষ্ট পেলে’র বার্তার মারপ্যাঁচ ঠিকই দেরিতে হলেও উপলব্ধি করেছে, আসলে তাদের নিজেদের “মুখ ও মুখোশ” যে পৃথক— সেটা আবারও সামনে এসেছে।

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের কাছ থেকে তারা সব ধরনের আর্থিক, মনোদৈহিক উন্নতির নানান সুযোগ-সুবিধা পেয়েই এ দেশের আলো-বাতাসে থেকে, এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব অস্বীকারের রাজনীতি করে আসছে, যা এই দেশেই সম্ভব, পুরো বিশ্বে বিরল! তথাপি কালজয়ী কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিক সেই উক্তিটির উল্লেখ করে গুণীজন তাকে স্মরণে রেখেই লিখছি, “স্মৃতি হলো এমন এক জিনিস, যা চাইলে ফেলা যায় না, ভুলেও মুছে যায় না।”

আরো বলি, “আনুষ্ঠানিকতা”র নামে যতই কৌশলের ফাঁদ পেতে মাফ চান, ‘যদি’, ‘কিন্তু’ আর ‘কেউ কষ্ট পেলে’র বুলিতে কথিত “ক্ষমা” এখন নিজেই চরম ফাঁপরে!

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জিপিএ ৫ নাকি গুণগত শিক্ষা— গুরুত্ব কোথায়?

ইতিবাচক দিকে জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’র লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।

৯ দিন আগে

পিআর-এর প্যাঁচে নির্বাচন

৯ দিন আগে

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করব

স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্নে আমাদের ভিন্নমত আছে, ভিন্ন চিন্তা আছে। কিছু প্রশ্নে আপত্তিও রয়েছে। কিন্তু আমরা একটি কেন্দ্রীয় বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করার লক্ষ্যে অনেক প্রশ্নে ছাড় দিয়েছি। সেই জায়গা থেকে, বহু প্রশ্নে আমরা মতের ভিত্তিতে একমত হয়েছি।

৯ দিন আগে

কেন আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারছি না

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ সনদে সই করবে না৷

৯ দিন আগে