৭ কলেজ ও ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি

অস্তিত্ব সংকটে শিক্ষা ক্যাডার ও উচ্চশিক্ষা

মো. মাসুমে রাব্বানী খান
আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৩: ০২

বর্তমানে ঢাকার সাতটি কলেজকে কেন্দ্র করে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ করার যে পরিকল্পনা ও অধ্যাদেশের প্রস্তাবনা আমরা দেখেছি, তাতে শিক্ষকদের অবস্থান থেকে আমাদের গভীর উদ্বেগের জায়গা তৈরি হয়েছে। প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় যে ‘স্কুলিং মডেলে’র কথা বলা হয়েছে, যেখানে সাতটি কলেজের সাতটি ক্যাম্পাসকে একেকটি অনুষদ বা ফ্যাকাল্টি হিসেবে গণ্য করা হবে, যা মূলত এই কলেজগুলোর স্বাতন্ত্র্য বা ঐতিহ্যকে বিলীন করে দেবে। আর এই স্বাতন্ত্র্য নষ্ট হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ারও একটি বড় সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

আমরা যখন সপ্তম বিসিএসের মাধ্যমে এ ক্যাডারে যোগদান করেছিলাম, তখন শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ার পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্যবাহী ও বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দেখেই আগ্রহী হয়েছিলাম। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্ল্যামার ও ঐতিহ্য ছিল আমাদের অনুপ্রেরণা। এখন যদি এই কলেজগুলোকে বিলীন করে ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির একেকটি ফ্যাকাল্টিতে পরিণত করা হয়, তবে শিক্ষা ক্যাডারের সেই ঐতিহ্য ও গ্ল্যামার নষ্ট হয়ে যাবে।

সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত সংক্রামক হতে পারে। আজ যদি ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির দাবি মেনে এই মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয়, তবে খুব দ্রুতই জেলা পর্যায়েও একই দাবি উঠবে। টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কিংবা রাজশাহী কলেজ, বিএম কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আসবে।

এর ফলে ধীরে ধীরে শিক্ষা ক্যাডার একটি ‘মৃত ক্যাডারে’ পরিণত হবে। অথচ এ ক্যাডার তৈরি করা হয়েছিল একটি সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য নিয়ে, যেন এটি দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা স্তরে একটি ‘আমব্রেলা সংগঠন’ বা ছাতা হিসেবে কাজ করতে পারে।

এখন এ কাঠামো ভেঙে গেলে শিক্ষার ভার্টিক্যাল (উল্লম্ব) ও হরাইজন্টাল (অনুভূমিক) মোবিলিটি বা সামঞ্জস্য নষ্ট হয়ে যাবে। সার্বিকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। এটি নিঃসন্দেহে একটি অদূরদর্শী পরিকল্পনা এবং দেশের শিক্ষার ওপর বিরূপ প্রভাব বিস্তারকারী পদক্ষেপ।

নারী শিক্ষার ক্ষেত্রেও এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। ইডেন কলেজ ও বদরুন্নেসা কলেজ দীর্ঘদিন ধরে দেশের নারী শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। আমাদের দেশে এখনো অনেক রক্ষণশীল পরিবার আছে, যারা সহশিক্ষা বা কো-এডুকেশনে মেয়েদের পড়াতে চান না।

আমি ইডেন কলেজে সাত বছর চাকরি করার সুবাদে দেখেছি, অনেক মেধাবী ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পরেও কেবল কো-এডুকেশনের কারণে সেখানে ভর্তি হয়নি। এই কলেজগুলো তাদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেছিল। এখন এগুলোকে ফ্যাকাল্টি বানিয়ে কো-এডুকেশন চালু করলে বহু নারীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে এবং নারী শিক্ষা সংকুচিত হবে।

শিক্ষার্থী ভর্তির পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও আমরা এক ভয়াবহ চিত্র দেখতে পাই। বর্তমানে এই সাত কলেজে প্রায় দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৬০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। অথচ প্রস্তাবিত মডেলে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে মাত্র ১০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার সুযোগ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী তখন কোথায় যাবে? তারা বাধ্য হবে উচ্চ মূল্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে শিক্ষা ‘ক্রয়’ করতে। সব মিলিয়ে একটি ‘হ য ব র ল’ পরিস্থিতি দেখা দেবে।

এ সংকট নিরসনে আমাদের প্রস্তাব হলো— কলেজগুলোকে বিলীন না করে একটি ‘অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয়’ বা অধিভুক্তকারী বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা। ছাত্ররা চায় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দিতে। তাই ‘ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি’ একটি অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কাজ করতে পারে, যার অধীনে সাতটি কলেজ তাদের স্বকীয়তা বজায় রেখে চলবে।

এ মডেল কিন্তু নতুন কিছু নয়। ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধীনে ৭৭টি কলেজ তাদের স্বাতন্ত্র্য ও মান বজায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আমাদের সাত কলেজও ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির অধীনে থেকে তাদের ঐতিহ্য ও পড়ালেখার মান রক্ষা করতে পারে। এটিই হতে পারে এই সমস্যার একটি সুন্দর ও যৌক্তিক সমাধান।

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, ইডেন মহিলা কলেজ ও সাবেক মহাসচিব, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে ব্যাখ্যার দায় সরকারের

এখানে সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব আছে। তার মন্তব্যের কারণ কী, সেটি সরকার জানতে চাইতে পারে এবং পরিষ্কার করতে পারে। কারণ এর বাইরে অন্য কোনো বিশেষ জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না।

৮ দিন আগে

তারেক রহমানের দেশে না ফেরা হতে পারে হিসেবি রাজনৈতিক কৌশল

দীর্ঘ সময় ধরে তারেক রহমান দেশের বাইরে। এটি এখন বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। তৃণমূলের বহু নেতাকর্মী বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। সত্যি বলতে, তিনি দেশে ফিরলে দল অবশ্যই নতুন উদ্দীপনা পাবে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও দলের সাংগঠনিক কাজ থেমে নেই— এটাই গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।

৮ দিন আগে

তারেক রহমানের ফিরতে বাধা পুরনো শক্তির অমীমাংসিত হিসাব

ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেসব শক্তি তাকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং নির্যাতন করেছিল, তাদের সঙ্গে সেই পুরনো বিরোধ এখনো পুরোপুরি মিটেনি। সেই সময়ের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এতে জড়িত ছিলেন, তাদের একটি অংশ আজও ‘সম্মতি’ দিচ্ছেন না— এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের হয়তো নিজেদের কিছু স্বার্থ বা অবস্থান রয়ে

৮ দিন আগে

দেশে ফিরতে অসুবিধা থাকলে খোলাখুলি জনগণকে জানান

যদি তিনি সত্যিই বিএনপিকে ধরে রাখতে চান, তাকে দেশে ফিরে এসে নেতৃত্ব দিতে হবে। তা না হলে খালেদা জিয়ার দুঃখজনক অনুপস্থিতিতে দল গভীর সংকটে পড়বে। আমি আশা করি তিনি ফিরবেন। আর যদি কোনো অসুবিধা থাকে, সেটা খোলাখুলিভাবে জনগণকে জানানো উচিত— ‘এই আমার অসুবিধা’।

৮ দিন আগে