এই গণভোটের প্রশ্ন বোধগম্য নয়

ড. শাহদীন মালিক

এটা কীভাবে গণভোট, তা আমার বোধগম্য নয়। কারণ জুলাই সনদে এতগুলো ধারা যে সেখানে কীসের ভিত্তিতে মানুষ ‘হ‍্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে? এসব ধারা বাস্তবসম্মত নয়। এগুলো কেউ পড়বে না। না পড়ে, না বুঝে কীভাবে মানুষ জবাব দেবে— এটা আমি বুঝতে পারছি না।

যে জিনিস কেউ বুঝবে না বা জানবে না, তার পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলাটাও অর্থহীন হবে।

গণভোট কখন ও কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে— তা সরকারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে ঐকমত‍্য কমিশন। এই গণভোটের প্রশ্নটি খুবই দুর্বোধ‍্য মনে হচ্ছে।

গণভোটের ব্যালটে উপস্থাপনীয় প্রশ্নটি হচ্ছে— ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১-এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’

জুলাই সনদের জটিল বিষয়গুলো গণভোটে কীভাবে প্রশ্ন আকারে উপস্থাপিত হবে, সে বিষয়েও ঐকমত্য প্রয়োজন ছিল। গণভোটের প্রশ্ন জনগণকে অবহিত করা সরকারের নৈতিক ও আইনি দায়িত্ব। আমার মতে, এই গণভোট সঠিক হবে না। কারণ প্রশ্নটি পড়ে বা বুঝে মতামত দেওয়া মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশ আছে বলে মনে হয় না।

সুপারিশে বলা হয়েছে, সরকারপ্রধান জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করবেন। এরপর জুলাই সনদের ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে যে ৩৬টি সরকারের নির্বাহী আদেশ কিংবা সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের অফিস আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলো সরাসরি নির্বাহী বা অফিস আদেশের মাধ্যমে অবিলম্বে বাস্তবায়ন করবে সরকার।

 

জুলাই সনদের বাকি ৪৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে সংবিধান সংশোধন করতে দুটি বিকল্প সুপারিশ রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের। দুটি পদ্ধতির জন্যই আয়োজন করতে হবে গণভোট।

প্রথম বিকল্প হিসেবে সংবিধান সংশ্লিষ্ট ৪৮টি বিষয়ে কমিশন সরকারকে পরামর্শ দিয়েছে, তারা যেন একটি ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ সংবিধান সংস্কার বিষয়ক আদেশ’ জারি করে। এ আদেশের অধীনে সরকার গণভোট আয়োজন করবে। সেখানে জনগণের কাছে প্রশ্ন রাখা হবে— ‘আদেশ ও এর তফসিলে অন্তর্ভুক্ত ৪৮টি সংবিধান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জনগণের সম্মতি আছে কি না।’

 

গণভোটে সম্মতি পাওয়া গেলে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ একই সঙ্গে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ হিসেবে কার্যকর থাকবে। সংবিধান সংস্কার পরিষদ কার্যকর থাকবে ২৭০ দিন। এ সময়ের মধ্যে পরিষদ জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন ও পরিমার্জন করবে।

 

এর একটি বিকল্প প্রস্তাবও করেছে ঐকমত্য কমিশন। এ প্রস্তাব অনুযায়ীও আগের প্রশ্নেই আয়োজন করা হবে গণভোট। তবে এবারে জুলাই সনদের সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি প্রস্তাবকে এই গণভোটের তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করে বিল আকারে জনগণের সামনে উপস্থাপন করা হবে।

 

এবারে গণভোটে জনগণের অনুমোদন মিললে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে দায়িত্ব সম্পন্ন তথা জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলেও গণভোটে অনুমোদিত বিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানের সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলো প্রতিস্থাপন করবে।

প্রকৃত অর্থে এগুলো একটি রাজনৈতিক কাঠামোর প্রশ্ন। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা দ্রব্যমূল্যের মতো বিষয় নয়। তেমন হলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ যুক্ত থাকত। কিন্তু এটি উচ্চমধ্যবিত্তের প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা। কীভাবে সাধারণ মানুষ এতে ভোট দিবে পক্ষে-বিপক্ষে, সেটি আমিও বুঝতে পারছি না।

গণভোট সবচেয়ে বেশি হয় সুইজারল্যান্ডে, তাও লোকাল গণভোট। দেশটির আইন অনুযায়ী, কোনো প্রস্তাবের পক্ষে এক লাখ সই থাকলে সেটি নিয়ে গণভোট আয়োজন করতে হবে। অস্ট্রেলিয়ায় সংবিধানের যেকোনো সংশোধনীর জন্য গণভোটের প্রয়োজন হয়। তবে রাজনীতির বড় প্রশ্নে গণভোট সাধারণত হয় না।

ব্রিটেনে সবশেষ গণভোট হয়েছিল ব্রেক্সিট নিয়ে। প্রশ্ন ছিল— তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) থাকতে চান কি না। পশ্চিমা শিক্ষিতদের জন্য বিষয়টি জটিল না। কিন্তু আমাদের এখানে জুলাই সনদ বা এর ধারাগুলো কজন জানেন বা বোঝেন? বেশির ভাগ প্রশ্নের আবার আইনি ভিত্তি নেই।

বিএনপি মনে করে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনসমর্থন নিশ্চিত করতে গণভোটে রাজি হওয়াটা ভুল ছিল। তবে যেহেতু তারা সম্মতি দিয়েছে, তাই এখন চাইছে— যেদিন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সে দিনই গণভোট হতে হবে।

বিএনপি নেতাদের অবস্থান হলো— গণভোট অবশ্যই জাতীয় নির্বাচনের দিনে হতে হবে। তা-ও একই ভোটকেন্দ্র, কর্মকর্তা ও ব্যালট বাক্স ব্যবহার করে। তা না হলে এটি নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে পারে এবং দলের ওপর রাজনৈতিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তারা।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগেই গণভোট চায়। জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পর তারা জোরেশোরে এ কথা বলছে।

এমনিতেই চার মাসেরও কম সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে গণভোট আয়োজন করতে গেলে অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে। কারণ এতে বাড়তি জনবল ও বাজেট প্রয়োজন হবে। ফলে সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের আয়োজন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে যথাযথ হবে না। তা ছাড়া এ রকম একটি গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনের হাতে যথেষ্ট সময়ও নেই।

কোনো জটিল ও দুর্বোধ্য প্রস্তাবের ওপর গণভোট জনগণের প্রতি অবিচার করার শামিল। গণভোটের মাধ্যমে মানুষকে তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়ার কোনো আকাঙ্ক্ষা যদি এলিটদের (অভিজাত শ্রেণি) থাকে, সেটি গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই জটিল প্রস্তাব পরিহার করা প্রয়োজন। কারণ আমরা দেখেছি, জটিল বিষয়ে মতামত জরিপে প্রকৃত ফলাফল আসে না।

গণভোটের ক্ষেত্রে প্রশ্নটি যদি প্রাক-ধারণানির্ভর হয়, তাহলে কিন্তু সেটি সৎ গণভোট হবে না। গণভোট সৎ হওয়া দরকার। কী চাওয়া হচ্ছে, সেটা কি মানুষের কাছে পরিষ্কার? মানুষ কি জুলাই সনদ সম্পর্কে জানে? আইনি ভিত্তি দিলে কী হবে, মানুষ সে সম্পর্কে ধারণা রাখে? শহরের মানুষ কিছু কিছু জানতে পারে। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের প্রান্তিক মানুষেরা সেটা সম্পর্কে কি ধারনা রাখে?

মতামত জরিপের একটি সাধারণ সমস্যা হলো ‘লিডিং কোশ্চেন’। আমি যেভাবে উত্তর চাই, সেভাবেই প্রশ্নটি সাজালাম। কিন্তু সেটি তো হওয়া উচিত নয়।

এই সরকারের অন্যতম সাফল্য হলো বিরাজনীতিকরণ। এত বড় বিরাজনীতিকরণ আগে কখনো হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের লক্ষ্য আদর্শ বা কর্মসূচি ছেড়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করছে। রাজনৈতিক দলের কাজ রাজপথে বা মাঠে। কিন্তু তারা এসি রুমে সভা করা নিয়ে ব‍্যস্ত ছিল।

আমরা দেখছি, যেখানে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজন ছিল সেখানে গণভোটের দিকে যাত্রা করা হচ্ছে। কারণ নিজেরা সমঝোতায় আসতে পারেনি। গণভোট কখন হবে, তা নিয়েও একেক পক্ষের মতামত একেক রকম। এ ক্ষেত্রে অনুপস্থিত মূল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী জনগণ চরম বিরক্ত ও হতাশ হবে। কারণ জনগণ চায় সম্মানজনক ও কার্যকর সমাপ্তি। অন্য কোনো গন্তব্য যেন তৈরি না হয়।

হযবরল অবস্থা তৈরি হলে দেশের সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক উত্তরণ হবে না। কোনোরকম উত্তরণ হলেও সমস্যার সমাধান ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা হবে না।

দেখুন, একটি বাঁশের মই দিয়ে চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে আপনি ছয় মাস আলোচনা করতে পারবেন। কিন্তু চাঁদে যেতে পারবেন কি? জুলাই সনদ বা গণভোট এমন একটি দৃষ্টান্ত হয়ে রইল।

লেখক: সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সুপ্রিম কোর্টের জ‍্যেষ্ঠ আইনজীবী

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

শান্তিতে নোবেল নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

অনেকে বলছেন, এবারও পুরস্কারটি যেন পশ্চিমা শক্তি ও মার্কিন নীতির সমর্থনে বিতরণ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি, দেশটির বিপুল তেল মজুদ, সাধারণ জনগণের কষ্ট—সবকিছুই এক জটিল চিত্র তৈরি করেছে।

১২ দিন আগে

জিপিএ ৫ নাকি গুণগত শিক্ষা— গুরুত্ব কোথায়?

ইতিবাচক দিকে জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’র লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।

১৩ দিন আগে

পিআর-এর প্যাঁচে নির্বাচন

১৩ দিন আগে

জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষা করব

স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রশ্নে আমাদের ভিন্নমত আছে, ভিন্ন চিন্তা আছে। কিছু প্রশ্নে আপত্তিও রয়েছে। কিন্তু আমরা একটি কেন্দ্রীয় বোঝাপড়া এবং রাজনৈতিক সমঝোতা তৈরি করার লক্ষ্যে অনেক প্রশ্নে ছাড় দিয়েছি। সেই জায়গা থেকে, বহু প্রশ্নে আমরা মতের ভিত্তিতে একমত হয়েছি।

১৩ দিন আগে