নির্বাচনি ভারসাম্যে হাঁটছেন অধ্যাপক ইউনূস

মো. ফেরদাউস মোবারক

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোকে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ভোট গ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ ২০২৬ সালের শুরুর দিকে।

এ নির্দেশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই একে রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর দাবির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডা সচল রাখার কৌশল হিসেবে দেখছেন।

২০২৪ সালের আগস্টে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদচ্যুতির পর ক্ষমতায় আসেন মুহাম্মদ ইউনূস। তখন থেকেই দেশকে একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি চরম চাপের মুখে কাজ করে চলেছেন। তার অন্তর্বর্তী সরকারকে একদিকে বিএনপি ও সামরিক বাহিনীর চাপে পড়তে হয়েছে, যারা ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে আসছিল, অন্যদিকে ইউনূসের নিজের রাজনৈতিক সহচর— বিশেষ করে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার না হলে নির্বাচন করা ঠিক হবে না। এ টানাপোড়েন ইউনূসের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, তিনি প্রকৃতপক্ষে নিজের ক্ষমতা মজবুত করতে সময়ক্ষেপণ করছেন।

ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রস্তুতির নির্দেশ বহু উদ্দেশ্য পূরণে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক শক্তির চাপে একটি পরিষ্কার নির্বাচন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা মেটানো হচ্ছে। ইউনূস সরাসরি ভোটের তারিখ না দিয়ে কেবল প্রস্তুতির সময়সীমা নির্ধারণ করে নিজের কৌশলী নমনীয়তা বজায় রেখেছেন। এর ফলে তিনি বিরোধীদের শান্ত রাখতে পারছেন, আবার নিজস্ব সংস্কার পরিকল্পনার জন্য সময়ও পাচ্ছেন।

২০২৫ সালের জুনের শেষ দিকে রাজনীতি নতুন মোড় নেয়। তখন ড. ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়। তাতে বলা হয়, নির্বাচন হবে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে, যা বিএনপির আগের দাবি ডিসেম্বর থেকে কিছুটা পরে, কিন্তু ইউনূসের প্রস্তাবিত এপ্রিল সময়ের আগেই। এই সমঝোতার ভিত্তিতেই মনে করা হচ্ছে, ডিসেম্বরের প্রস্তুতির নির্দেশ এসেছে। এতে একদিকে বিরোধীদের নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হচ্ছে, আবার সংস্কারের জন্য কিছুটা সময়ও থাকছে।

ইউনূসের এই প্রস্তুতিমূলক নির্দেশ তার নির্বাচনি ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তনের ওপর জোর দেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। তিনি একাধিকবার বলেছেন, অতীতের মতো সহিংসতা, জালিয়াতি ও অবিশ্বাসে ভরা নির্বাচন আর চলবে না। ভোটকর্মীদের প্রশিক্ষণ, ভোটকেন্দ্র সুরক্ষা এবং সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার চেষ্টা প্রমাণ করে যে, ইউনূস মনে করেন শুধু তারিখ নয়, নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাই মূল বিষয়।

এই নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টাকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক চাপ সামাল দেওয়ার সুযোগ দেয়। তিনি একদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু দাবি মেনে নিচ্ছেন, অন্যদিকে ট্রানজিশনের সময়সীমা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখছেন। এমন অবস্থায় ডিসেম্বরের সময়সীমা হয়তো একটি কৌশলগত বিলম্ব, যার মাধ্যমে বিরোধীদের প্রশমিত করে নিজের সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার সুযোগ পাওয়া যাবে, তাও আবার সামরিক বাহিনীর প্রত্যাশাকে সরাসরি অস্বীকার না করেই।

ইউনূস এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জনসাধারণের প্রত্যাশা নিয়ন্ত্রণে আনার এবং রাজনৈতিক বার্তা তৈরির চেষ্টা করছেন। গত কয়েক মাসে শিক্ষকদের, সরকারি কর্মচারীদের ও বিরোধী দলীয় কর্মীদের প্রতিবাদ জোরদার হয়েছে। “মুক্ত, নিরপেক্ষ ও স্মরণীয়” নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ডিসেম্বরের সময়সীমা ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউনূস সরকার উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার অভিযান চালিয়ে সরকারের স্বচ্ছতা ও সংস্কারমূলক অবস্থান তুলে ধরা হচ্ছে, যাতে দেশের ভেতর ও বাইরের সমালোচনা মোকাবিলা করা যায়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এ নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। কেউ বলছেন, এটি একটি বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ— একটি স্থিতিশীল রূপান্তরের জন্য যা প্রয়োজন। তারা মনে করেন, ইউনূস এক কঠিন পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করছেন। আবার অনেকে বলছেন, এটি একটি সময়ক্ষেপণের কৌশল। কারণ এখনো সরকার কোনো দৃশ্যমান সংস্কার বাস্তবায়ন করেনি।

বিএনপির অভ্যন্তরীণ সমালোচকেরা বলছেন, ইউনূস মূলত এনসিপির স্বার্থ রক্ষা করছেন এবং সংস্কারের কথা বলে প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন বিলম্ব করছেন। মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোও এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছে— কেউ দেখছেন এটি নির্বাচনের পথে অগ্রগতি, আবার কেউ বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে সংকটের লক্ষণ।

অনলাইন প্রতিক্রিয়াও একইভাবে বিভক্ত। সমর্থকেরা ইউনূসকে এক ধরনের অবরুদ্ধ সংস্কারক হিসেবে দেখছেন, যিনি ডিসেম্বরের নির্দেশনা দিয়ে গণতান্ত্রিক অখণ্ডতা রক্ষা করতে চাইছেন। বিরোধীরা বলছেন, এই পদক্ষেপ কেবল ধামাচাপা দেওয়ার প্রচেষ্টা, যেন সমালোচনা সামাল দেওয়া যায়, প্রকৃত কোনো পরিবর্তনের অঙ্গীকার ছাড়াই। কেউ কেউ আরও এগিয়ে বলছেন, এতে বিদেশি প্রভাব কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষপাতিত্বের ষড়যন্ত্রও জড়িত থাকতে পারে।

শেষ পর্যন্ত ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন প্রস্তুতির এই নির্দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক রূপান্তরের ভঙ্গুরতা তুলে ধরে। এটি এক ধরনের কৌশল, যার মাধ্যমে রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা, তাৎক্ষণিক চাপ মোকাবিলা করা এবং সংস্কারের পথ অক্ষত রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

এই কৌশল কতটা সফল হবে, তা নির্ভর করবে ইউনূস কতটা দক্ষতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষগুলোর মধ্যে ঐকমত্য গড়তে পারেন এবং তার প্রতিশ্রুত সংস্কারকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেন— তার ওপর। এর আগে পর্যন্ত, ডিসেম্বর ২০২৫-এর সময়সীমা ও ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এর সম্ভাব্য নির্বাচনি দিন— সবই অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতা যাচাইয়ের পরীক্ষা।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং বিকেন্দ্রীকরণ

একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি তার জনশক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা (Demographic Stability) অর্জন করা এখন আর কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অং

১৮ দিন আগে

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন জামায়াতে ইসলামি। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা গেলে জামায়াত তখন বিএনপির শক্ত বা সবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি অন্যান্য ইসলামি দলগুলো সঙ্গে নিয়ে জামায়াত দরকষাকষির সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারে।

১৯ দিন আগে

হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরি ধানকে বাঁচাতে হবে

ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক আগে যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে। এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্

১৯ দিন আগে

আর্থিক সংকটে ক্ষুদ্র-শিল্প উদ্যোক্তারা: সমাধান জরুরি

গত বছরের জুনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৪–১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও এক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমন দফায় দফায় সুদহার বৃদ্ধির ফলে বড় প্রতিষ্ঠানও চাপে পড়তে পারে এবং বহু প্রতিষ্ঠান রুগ্ন তালিকাভুক্ত হবে। উল্লেখযোগ্য, ২০২০ সালের এপ্রিলে স

১৯ দিন আগে