নীরবেই চলে গেলেন ভাষাবিজ্ঞানী শফিউল আলম

ড. মোহাম্মদ হাননান

সাহিত্য গবেষক ও ভাষাবিজ্ঞানী অধ্যাপক শফিউল আলমের ৭০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে একটি সংবর্ধনা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে ছাপা হওয়া আমার লেখার শিরোনাম ছিল: ‘শফিউল আলম স্যারকে দেখবে কে’। এরকম একটি শিরোনাম আমি করেছিলাম তাঁর নিজের লেখা একটি গ্রন্থ ‘ফিরে দেখা’–এর জবাব হিসেবে।

ফিরে দেখা গ্রন্থে শফিউল আলম স্যার তাঁর সমকালের লেখক, গবেষকদের নিয়ে নানান কথার মালা গেঁথেছিলেন। আমার লেখাটিতে সেই প্রসঙ্গ টেনে যে উপসংহারটি রচনা করেছিলাম তা ছিল এরকম: “বইটিতে তিনি অত্যন্ত যত্নের সাথে ফিরে ফিরে দেখেছেন অনেক মনীষীকে, অনেক প্রতিষ্ঠানকে, অনেক সংগঠনকে। … পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, তিনি তো এমন করে কতজনকে নিয়ে লিখেছেন, তাঁকে নিয়ে কেউ কি লিখবেন! … যাঁরা জীবনভর অন্যের জন্য করে যান, তাঁদের জন্য কিছু করার কেউ থাকে না। শফিউল আলম স্যার তার ব্যতিক্রম থাকবেন কেন!” [অধ্যাপক শফিউল আলম স্মারকগ্রন্থ, সুব্রত বড়ুয়া, মাহবুবুল হক প্রমুখ সম্পাদিত, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ২০১৪, পৃষ্ঠা ১৪৪–১৪৭]।

আমি শফিউল আলম স্যারের সরাসরি ছাত্র। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কথাটা সত্য হলো। ২০২৫ সালের ২৪শে জুন তিনি পরলোকে গমন করলেন, অত্যন্ত চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। ২৩শে জুন দিবাগত রাত ৩টায়—ঘড়ির কাঁটায় তখন ২৪শে জুন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে কোনো কাগজে খবর প্রকাশিত হয়নি। আমাদের দেশে এখন মৃত্যু-পরবর্তী যে একধরনের হৈ-হল্লার সংস্কৃতি চালু হয়েছে—শহিদ মিনারে নিয়ে যাওয়া, লাশ সামনে রেখে সত্য-মিথ্যা বক্তৃতা করা ইত্যাদি—সবকিছুকে এড়িয়ে তিনি কবরে শুয়ে গেলেন।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। সেই সুবাদে ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে অনেক গবেষণা কাজ করেছেন। কিন্তু ভাষা-সাহিত্য গবেষণার বিবিধ রকম অবদান রাখার পরও বাংলা একাডেমি থেকে তিনি কোনো স্বীকৃতি পাননি। দীর্ঘদিন যাঁরা বাংলা একাডেমির সভাপতি-মহাপরিচালক ছিলেন, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁর খুব কাছের লোক, অথবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিংবা একসঙ্গে জাতীয় অনেক দায়িত্ব পালন করেছেন বছরের পর বছর। কিন্তু কেউ মনে করেননি বাংলা একাডেমি বা একুশে পদক তিনি পেতে পারেন!

আনিসুজ্জামান স্যারের সঙ্গে তো তিনি দীর্ঘসময় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সম্পাদনা কাজে জড়িত ছিলেন, তিনি জানতেন—এ ক্ষেত্রে শফিউল আলম স্যারের রয়েছে বিশাল অবদান। আনিস স্যার দীর্ঘসময় বাংলা একাডেমির সভাপতি ছিলেন। তাঁর একবারও মনে হয়নি—নীরব এ ভাষা-সাহিত্য গবেষককে বাংলা একাডেমি সম্মানিত করতে পারে।

কিছুদিন আগে শফিউল আলম স্যারেরই একই জেলা কক্সবাজারে জন্মগ্রহণকারী একজন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হলেন। তিনি তো ছাত্রজীবন থেকেই প্রফেসর শফিউল আলমের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কই, তাকেও দেখলাম না শফিউল আলম স্যারের প্রতি সম্মানিত দৃষ্টিতে একবার ফিরে তাকাতে। শফিউল আলম স্যারের বন্ধু একজন, যিনি প্রতিদিন না হোক, সপ্তাহে একবার দেখা করা অভ্যেসে ছিলেন—তিনিও বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ফেলো, আরও অনেক কিছু হয়েছেন। তাঁরাও কোনোদিন শফিউল আলম স্যারের পুরস্কারের জন্য প্রস্তাব করেছেন—এমনটা শুনিনি।

আমাদের দেশে দলহীন-গোত্রহীনদের জন্য বরাবর এটাই হয়ে এসেছে। সুতরাং অধ্যাপক শফিউল আলমের জন্যও এটা সত্য হয়েছে—কেউ তাঁকে সম্মান জানাতে আগ্রহী ছিলেন না। বরং উল্টো অনেক যন্ত্রণাদায়ক সমালোচনা তাঁকে শুনতে হয়েছে। একবার ড. হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত কঠিন ভাষায় একটি পত্রিকায় অধ্যাপক শফিউল আলমকে সমালোচনা করে নানা কথা লিখলেন। সে সময় পত্রিকায় সেটা তিনি দেখেননি। পরে যখন লেখাটি হুমায়ুন আজাদের একটি গ্রন্থে সংকলিত হয়, তখন সেটা স্যারের নজরে পড়ে। তিনি খুব দুঃখ পেলেন লেখাটা পড়ে। আমি বললাম, “হুমায়ুন আজাদ তো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকেও ‘মূর্খ’ মনে করতেন, সে ক্ষেত্রে আপনি তো কিছুই না।” স্যার, মনে হয়, একটু সান্ত্বনা পেলেন।

আমি সরাসরি তাঁর ছাত্র হলেও, তিনি আমাকে ছেলের মতো দেখতেন। একদিন বললেন, তাঁর একটি ছেলে হয়েছিল—অল্প বয়সেই সে মারা যায়। বেঁচে থাকলে আমার কাছাকাছি বয়সেরই হতো সে। সে জন্য একটা অসিয়ত করে গেলেন—তাঁর মৃত্যুর পরে যেন আমি তাঁকে কবরে নামিয়ে দিই। আমি এ ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতাম—স্যার অসুস্থ, কখন কী হয়ে যায়। কলাবাগানের বাসায় সে জন্য মাঝেমাঝেই গিয়ে হাজির হতাম। মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে, ২০শে জুন শুক্রবার, আমি নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও বাসায় গিয়ে হাজির হলাম, শুনলাম তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এরকম হাসপাতালে তাঁকে অনেকবারই যেতে হয়েছে, কিন্তু এটা যে শেষযাত্রা—সেটা তো কেউ ভাবতে পারেনি। মৃত্যুর খবর যখন শুনেছি, তখন তিনি কবরে সমাহিত হয়ে গেছেন। স্যারের অসিয়ত পূরণ হলো না। এ ব্যাপারটা মনকে খুব খারাপ করে দেয়।

অধ্যাপক শফিউল আলমের মৌলিক গবেষণা গ্রন্থ ১৯টি। এর মধ্যে:

১. সাহিত্যের কালোত্তীর্ণ কুশীলব

২. ভাষা বানান শিক্ষা

৩. শিক্ষা ভাবনা ও ভাষা চিন্তা

৪. সাংবাদিক সাহিত্যিক আবদুর রশিদ সিদ্দিকী

৫. সাহিত্য: কতিপয় বিবেচনা

গ্রন্থগুলো খুব আলোচিত ও বিশিষ্টতা লাভ করেছিল।

১৮টি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা করেছেন এবং শিক্ষক-সহায়িকা ও নির্দেশিকামূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন ১০টি।

শিশু-কিশোরদের জন্য প্রচুর লিখেছেন, এর মধ্যে গল্পে গল্পে সুফিয়া কামাল বিশেষ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

তবে বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রে তাঁর প্রধান অবদান:

১. প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক সম্পাদনা

২. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পাঠ্যপুস্তক রচনা, সংকলন ও সম্পাদনা

৩. বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ

তিনি শিক্ষাকোষ গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক এবং নিয়মিত প্রকাশিত শিক্ষাবিষয়ক জার্নাল বাংলাদেশ শিক্ষা সাময়িকী–এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।

অধ্যাপক শফিউল আলমের জন্ম ১৯৪১ সালের ১৫ই এপ্রিল। তাঁর পিতা ছিলেন কক্সবাজারের হারবাং ইউনিয়নের শিক্ষানুরাগী বজলুর রহমান এবং মাতা রাশিদা বেগম। ১৯৬৯ সালের ১৯শে অক্টোবর চাঁদপুরের অধ্যাপক হোসনে আরা আলমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন কন্যা: রাশিদা আফরোজ শুভ্রা, সাদিয়া আফরোজ সোমা এবং সোহানা আফরোজ প্রিয়াংকা। তোমাদের সবাইকে ভালোবাসা। আল্লাহ স্যারকে কবরে শান্তি ও স্নেহে রাখুন।

—লেখক কলামিস্ট ও গবেষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

অপারেশন মাউন্টেন ঈগল: মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতী গেরিলা

কর্ণফুলীর স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরের আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ। সেই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ যোগ দেয় একদল সশস্ত্র তিব্বতীয় গেরিলা। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর কর্ণফুলীর স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিব্বতীয়দের দিকে।

১২ দিন আগে

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১২ দিন আগে

সহিংসতার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হ

১৩ দিন আগে

অস্তিত্ব সংকটে শিক্ষা ক্যাডার ও উচ্চশিক্ষা

আজ যদি ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির দাবি মেনে এই মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয়, তবে খুব দ্রুতই জেলা পর্যায়েও একই দাবি উঠবে। টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কিংবা রাজশাহী কলেজ, বিএম কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আসবে।

২০ দিন আগে