মহররমের প্রথম ১০ দিন: ইতিহাস, আমল ও করণীয়

আ. ছালাম খান
প্রকাশ: ০১ জুলাই ২০২৫, ১২: ১৯

ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস ‘মহররম’। এটি ‘আশহুরে হুরুম’ বা সম্মানিত চার মাসের একটি, যার প্রতি আল্লাহ ও তার রাসুল (সা.) বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। এ মাসের প্রথম ১০ দিন বিশেষভাবে ফজিলতপূর্ণ— রহমত, বরকত ও ইবাদতের উজ্জ্বল সুযোগ। ইতিহাস, আধ্যাত্মিকতা ও আত্মত্যাগের অপূর্ব মেলবন্ধনে মোড়ানো এ সময় আমাদের ঈমান, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধকে নতুন করে জাগ্রত করার আহ্বান জানায়।

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এই ১০ দিন শুধু আবেগ নয়, আত্মশুদ্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসারও উপলক্ষ্য। ইসলামি ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন— আশুরা দিবস, তেমনিভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এ মাসকে দিয়েছে অমরতা।

মহররম: ইতিহাসের আয়নায়

প্রাক-ইসলামিক আরব সমাজে মহররম

আরবরা মহররমকে সম্মান করত। তারা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ, খুন-খারাবি বন্ধ রাখত। ইসলামের আবির্ভাবের পরও এই সম্মান অক্ষুণ্ণ থাকে। কুরআনের সূরা তওবার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে— ‘আল্লাহর নিকট মাস গণনায় ১২ মাসই, যার মধ্যে চারটি সম্মানিত।’

আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব

মহররমের ১০ তারিখ, ‘আশুরা’ নামে পরিচিত। বহু নবীর জীবনে এ দিনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে—

  • হজরত মূসা (আ.)-এর বনী ইসরাঈল ফেরাউন থেকে মুক্তি পায়।
  • হজরত নূহ (আ.)-এর নৌকা তুফান শেষে পাহাড়ে থামে।
  • হজরত ইবরাহিম (আ.) আগুন থেকে রক্ষা পান।
  • হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন।
  • হজরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়।

কারবালার মহাকাব্যিক অধ্যায়

১০ মহররম, ৬১ হিজরি। ইসলামের ইতিহাসে গভীর শোক ও গৌরবের দিন। ইয়াজিদের জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পথে দাঁড়িয়েছিলেন রাসুল (সা.)-এর প্রিয় নাতি ইমাম হোসাইন (রা.)। পরিবারসহ তিনি কারবালার প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন। এ ত্যাগ শুধু ইতিহাস নয়, ইসলামের আত্মা হয়ে চিরকাল মুসলমানদের কাছে সত্য ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে আছে।

ফজিলত ও আমলের নির্দেশনা

কুরআন ও হাদিসের আলোকে

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন— ‘রমজান মাসের পর আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ রোজা হচ্ছে মহররম মাসের রোজা।’ (সহীহ মুসলিম)

আবার আশুরার দিনে রোজা রাখার প্রসঙ্গে তিনি বলেন— আশা করি আল্লাহ তায়ালা এ রোজার মাধ্যমে অতীত এক বছরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (সহীহ মুসলিম)

আশুরার রোজা

রাসুল (সা.) ইহুদিদের আশুরার রোজা পালনের কথা শুনে বলেছিলেন— ‘তোমরা দশমের সঙ্গে নবম অথবা একাদশ মিলিয়ে রোজা রাখো, যেন ইহুদিদের থেকে ভিন্ন হওয়া যায়।’

মহররমের প্রথম ১০ দিনের করণীয় আমল

  • কুরআন তেলাওয়াত বাড়ানো
  • ইস্তিগফার ও তওবা করা
  • দান-সদকা করা
  • অতীত গোনাহর জন্য কান্না করা ও আত্মসমালোচনা
  • আত্মীয়তার সম্পর্ক উন্নয়ন
  • সাহাবা ও আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ
  • সামাজিক ও আত্মিক উপলব্ধি

কারবালা: প্রতিরোধের শিক্ষা

ইমাম হোসাইন (রা.) কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন এক আদর্শ। ক্ষমতার লোভ, সত্যকে চাপা দেওয়া, ধর্মের নাম ভাঙিয়ে রাজনীতি করার বিরুদ্ধে তিনি একা দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর ত্যাগ মুসলিম সমাজকে আজো শিক্ষা দেয়— বিপদের মধ্যেও ন্যায় পথ থেকে বিচ্যুতি নয়।

মহররম ও প্রতিবাদ সংস্কৃতি

আধুনিক পৃথিবীতে যখন অত্যাচার-দুর্নীতি ও অন্যায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তখন কারবালার চেতনা আমাদের শেখায়, ‘সত্য কথা বলো, যতই শক্তির বিরুদ্ধে হোক।’

মহররম আমাদের শুধু কান্না করতে শেখায় না, প্রতিবাদও করতে শেখায়।

আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজেকে বদলে ফেলা

মহররম আত্মসমালোচনার মাস। নববর্ষের শুরুতেই আমাদের উচিত অভ্যন্তরীণ দূষণ দূর করা, অহংকার ও হিংসা দূর করা, হৃদয়কে পরিষ্কার করা।

আহলে বাইতের ভালোবাসা ও সম্মান

ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত শুধু শোক নয়, দায়িত্বের আহ্বান। রাসুল (সা.) বলতেন, ‘হোসাইন আমারই অংশ, আমি হোসাইনের অংশ।’ তাই তার প্রতি ভালোবাসা থাকা ঈমানের অংশ। আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা মানেই হলো সত্য ও ন্যায়ের প্রতি অটল থাকা।

বিদআত ও ভ্রান্ত রীতি সম্পর্কে সচেতনতা

মহররম উপলক্ষে অনেক জায়গায় কিছু কুসংস্কার ও বেদআত প্রচলিত হয়ে গেছে, যেমন—

  • নিজের শরীর আঘাত করা
  • তাজিয়া মিছিলের নামে বিশৃঙ্খলা
  • ‘পাক রান্না’ করে তা অলৌকিক মনে করা

এসব ইসলাম স্বীকৃত নয়। আমাদের উচিত রাসুল (সা.)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী এ মাস পালন করা ইবাদত, রোজা, তওবা ও সৎকর্মের মাধ্যমে।

মহররমের গুরুত্ব ও শিক্ষা সমাজে ছড়িয়ে দিতে যেসব কাজ করা যায় সেগুলো হলো—

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আলোচনা সভা ও ইসলামি ইতিহাস চর্চা করা;
  • ইমাম হোসাইন (রা.)-এর জীবনভিত্তিক নাটিকা, আবৃত্তি বা বক্তৃতা প্রতিযোগিতা আয়োজন করা;
  • টেলিভিশন ও অনলাইন মাধ্যমে ইতিহাসনিষ্ঠ ও শুদ্ধ বার্তা তুলে ধরা;
  • কারবালার ইতিহাস যেন শুধু শোক নয়, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের অনুপ্রেরণা হয়।

মহররম আমাদের জন্য কেবল একটি মাস নয়, এটি একটি চেতনা, একটি সংগ্রাম, একটি বোধ। সত্য ও ন্যায়ের পথে জীবন উৎসর্গের প্রতীক এই মাস। হোসাইন (রা.) আমাদের শেখান, সংখ্যায় বড় না হয়েও ন্যায়ের পথে অটল থাকা যায়, অন্যায়ের সামনে মাথা নত করা যায় না।

মহররমের প্রথম ১০ দিন আমাদের চিন্তা, চরিত্র ও কর্মে বিপ্লব ঘটাতে পারে, যদি আমরা তা বুঝে উপলব্ধি করি। এ মাসে কাঁদা উচিত, তবে নিজের গোনাহর জন্য। এ মাসে রোজা রাখা উচিত, তবে আত্মাকে খাঁটি করার জন্য। এ মাসে শোক করা উচিত, তবে সেই আদর্শের জন্য যা জীবনকে আলোকিত করে।

আসুন, মহররমের প্রথম ১০ দিনকে আত্মশুদ্ধি, ইবাদত, ত্যাগ ও নৈতিকতা অর্জনের ১০ দিন হিসেবে গ্রহণ করি। কারবালার ত্যাগ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সত্য, শান্তি ও ইনসাফের পথে গড়ে তুলি।

লেখক: মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

ইসরাইলের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছিলেন যে বাঙালি পাইলট

১৯৬৭ সালের ৫ জুন বিকালে ইসরাইলের চারটি ফাইটার জেট (যুদ্ধবিমান) জর্ডানের মাফরাক বিমানঘাঁটিতে আক্রমণ করে। উদ্দেশ্য ছিল— ওই ছোট্ট দেশের বিমানবাহিনীকে শেষ করে দেওয়া। সেদিন মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইলি বিমানবাহিনী মাটিতে থাকা ২০০-এরও বেশি মিশরীয় যুদ্ধবিমান ধ্বংস করে দিয়েছিল। খবর বিবিসি বাংলার।

৫ দিন আগে

রাষ্ট্র, সংস্কার ও নির্বাচন

জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একদফা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিলে ছাত্রদের সাথে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলসমূহও আন্দোলনে যোগ দেয়। ফলে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর ধরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। ৫ আগস্ট তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেন।

৮ দিন আগে

ইসরায়েলের কাছে কত পারমাণবিক বোমা রয়েছে?

গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকেই যে ইসরায়েলের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, সেটি কারোরই অজানা নয়। যদিও দেশটিকে এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বিষয়টি স্বীকার করতে দেখা যায়নি। বরং ইরান ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাছাকাছি রয়েছে’ দাবি করে সপ্তাহখানেক আগে দেশটির ওপর হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল।

৮ দিন আগে

আ. লীগ ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিবিসিকে যা বললেন ড. ইউনূস

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরের সময় বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দেশের রাজনীতি, সংস্কার, নির্বাচন ও রোহিঙ্গা সমস্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন।

১০ দিন আগে