সাহিত্য

বাংলা কবিতায় বর্ষা

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২০ মে ২০২৫, ১৬: ১২

বর্ষা শুধুই একটি ঋতু নয়, এটি বাংলার কবিতায় এক চিরন্তন অভিব্যক্তি। বৃষ্টির শব্দ, মেঘের গর্জন, বাতাসের শীতলতা আর মাটির গন্ধ—সব মিলিয়ে বর্ষা বাংলা কাব্যজগতে হয়ে উঠেছে প্রেম, বিরহ, স্বপ্ন আর স্মৃতির প্রতীক। এই ঋতু কখনো এসেছে প্রকৃতির অপরূপ রূপসী রূপে, কখনো বা অন্তর্জগতের নিঃসঙ্গতা বা আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হয়ে।

বর্ষার সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। এই ঋতু এসেছে সাহিত্যের শুরু থেকেই। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন বর্ষা এসেছে রাধা ও কৃষ্ণের মিলন বা বিরহের আবহে, তেমনি আধুনিক কবিতায় বর্ষা এসেছে নানা দার্শনিক ও মানসিক স্তরের অনুভব হয়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায় বর্ষা এক বিশেষ আবেগ নিয়ে আসে। তাঁর "আষাঢ়" কবিতায় বর্ষা এসেছে প্রকৃতির উদ্দাম রূপ নিয়ে, যা একদিকে যেমন সুন্দর, অন্যদিকে তেমনই ভয়াল। তিনি লিখেছেন:

"কেন বাহির হলি বন্যা,

ভাসালি সব ঘরবাড়ি—

হায় রে তোর প্রেম যে শুধু

ধ্বংস এনেছে সঙ্গে তারি।"

এই কবিতায় বর্ষা প্রকৃতির উচ্ছ্বাসমাত্র নয়, বরং জীবনের বিপর্যয়ের চিত্রও। আষাঢ়ের বৃষ্টিতে যেমন হৃদয় উতলা হয়, তেমনি সে নিয়ে আসে চরম ভাঙচুর, যা জীবনের গভীর সত্যকে তুলে ধরে। বর্ষা এখানে কবির চোখে দ্বৈত রূপে—একদিকে সে রোমান্টিক, অন্যদিকে সে বিধ্বংসী।

রবীন্দ্রনাথের অন্য কবিতাগুলিতেও বর্ষা এসেছে এক ব্যক্তিগত আবহ, যেখানে প্রকৃতি ও মন একসঙ্গে কথা বলে। তাঁর "বর্ষাযাপন" কবিতায় দেখা যায় একাকীত্ব ও স্মৃতির সম্মিলন:

"আজ এই বৃষ্টির দিনে, মনে পড়ে তোমারে,

শূন্য ঘরে বসে ভাবি, মেঘ ভাসে আমার ঘারে।"

এই বৃষ্টিতে শুধু প্রকৃতি নয়, একাকী হৃদয়ের কাতরতা ধরা পড়ে। তাঁর "মেঘ ও বৃষ্টি" কবিতায়ও সেই কাব্যিক বিষণ্নতা অনুভব করা যায়:

"বৃষ্টি পড়ে, বাদল নামে

তুমি আসে না বলে মন কাঁদে—

ঘরের কোণে, জানলা পাশে,

বসে থাকি জলে ভেজা মনে।"

কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় বর্ষা এসেছে এক ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। তাঁর "বর্ষা-মঙ্গল" কবিতায় বর্ষা এক উৎসব, কিন্তু তার মধ্যে আছে শক্তি ও স্পন্দনের প্রতীকী ব্যবহার:

"আকাশে আজ গর্জন ঘন, ধরণীতে নেমে আসে জলধারা,

বজ্ররবে জাগে প্রাণ, নাচে বনের তরু-পল্লব সারা।"

এই বর্ষা একধরনের জাগরণ, যা জীবনের গতি ও গতিময়তা প্রকাশ করে। নজরুলের কবিতায় বর্ষা শুধু প্রকৃতির রূপ নয়, বরং মানব-আত্মার এক উল্লাসময় দ্যোতনা।

বাংলা কবিতায় বর্ষার আরেক গুরুত্বপূর্ণ নাম জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় বর্ষা এসেছে নিস্তব্ধতা, একাকীত্ব ও স্মৃতির আলপথ ধরে। "আষাঢ়ে" কবিতায় তিনি লেখেন:

"আষাঢ়ে মেঘের ধূসর ছায়া পড়ে মনে,

ভিজে যায় একটানা দিন, পুরোনো স্মৃতির ক্ষণে।"

জীবনানন্দের বর্ষা এক বিষণ্ন সৌন্দর্য, যেখানে প্রকৃতির রঙ মিশে যায় স্মৃতির কুয়াশায়। তাঁর "আবার আসিব ফিরে" কবিতায়ও বর্ষার আবহ রয়ে যায়:

"আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ি নদীর তীরে—

এই বাংলার ধান-ঘেরা মাঠে, শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে।"

বর্ষা এখানে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি, মাটির টানে ফিরে আসার আকুতি।

আধুনিক কবিদের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় বর্ষাকে দেখেছেন নাগরিক বাস্তবতার সঙ্গে মিশিয়ে। তাঁর "হে বর্ষা" কবিতায় লেখেন:

"তুমি এলে হে বর্ষা, জানালার কাঁচে তোমার স্পর্শ,

আকাশ কালো হলেও মনটা যেন হঠাৎ জেগে উঠে।"

এই বর্ষা বাইরের নয়, মনের ভিতরে এক আলোড়ন তোলে।

মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতায় বর্ষা নারীর অনুভূতির এক গভীর রূপ পায়। তাঁর "বর্ষা ও আমি" কবিতায় তিনি লেখেন:

"এই বৃষ্টি শুধু মাটিকে ভেজায় না,

ভেজায় এক মেয়ের বুকের ভিতর জমে থাকা কান্না।"

এখানে বর্ষা হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ কষ্টের ভাষা, যা নারী জীবনের আত্মপ্রকাশে সহায়ক।

আসলে বাংলা কবিতায় বর্ষা কখনো প্রেমের ভাষা, কখনো বিরহের কান্না, আবার কখনো প্রতিবাদের স্বর। এই ঋতু আমাদের মনোজগতে নানা ছায়াপাত ফেলে, যা কবির কলমে রূপ পায় ছন্দ, শব্দ আর রূপকের আড়ালে। বর্ষা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে ওঠে কবিতার পাতায়।

আজকের কবিরাও বর্ষাকে নতুনভাবে দেখছেন। কারো কবিতায় বর্ষা আসে শহরের ট্রাফিকজ্যামে আটকে পড়া মানুষের ক্লান্ত চোখে, কারো কবিতায় সে আসে ছাদে বসে অতীত খোঁজার উপলক্ষে। কেউ লেখেন হঠাৎ বৃষ্টিতে কাকভেজা ভালোবাসার গল্প, কেউ লেখেন বৃষ্টির ফোঁটার মতো ভেঙে পড়া স্বপ্নের কথা।

এই বহুমাত্রিকতা বর্ষাকে বাংলা কবিতায় করে তুলেছে এক অপরিহার্য রূপক। কবিরা যখন লেখেন বর্ষা নিয়ে, তারা শুধু প্রকৃতিকে আঁকেন না, বরং জীবনের বহমানতা, অনুভবের গভীরতা ও সম্পর্কের সূক্ষ্ম দোলাচলকে তুলে ধরেন।

বাংলা কবিতায় বর্ষা তাই এক জীবন্ত অভিজ্ঞতা—যা আমাদের মনের গভীরে কথা বলে, চোখে জল আনে, হৃদয়ে শব্দ তোলে। এই বর্ষা চিরকালীন, চিরন্তন এবং চিরনবীন।

সমসাময়িক কবিদের মধ্যেও বর্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। কবি জয় গোস্বামীর কবিতায় বর্ষা আসে একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে, যা কখনো বিষণ্নতা, কখনো ভালোবাসা, আবার কখনো জীবনের চরম বাস্তবতার সঙ্গে মিশে যায়। তাঁর "পাতা ঝরে যায়" বা "চিনার ফুল" নামের কবিতাগুলিতে বর্ষা শুধু প্রাকৃতিক উপলক্ষ নয়, বরং মানুষের আবেগ, সম্পর্ক এবং অস্থিরতার চিত্ররূপ।

এক কবিতায় তিনি লেখেন:

"বর্ষা এসেছে, অথচ তুমিই নেই—

ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদে যেন একটা শহর।"

এই বাক্যে বর্ষা এক নিঃসঙ্গ শহরের প্রতীক, ভালোবাসা ও বিচ্ছেদের আবেগের পটভূমি। জয় গোস্বামীর কবিতায় বর্ষা কখনো নগরজীবনের ব্যস্ততার মধ্যে নিঃসঙ্গতা নিয়ে আসে, কখনো বা প্রেমিক-প্রেমিকার অনুপস্থিতির যন্ত্রণাকে আরও গভীর করে তোলে। তাঁর কবিতায় বর্ষা কেবল প্রকৃতি নয়, বরং মানুষের ভেতরের আবেগ-তাড়িত জগৎ।

সব মিলিয়ে বলা যায়, বাংলা কবিতায় বর্ষা শুধুমাত্র একটি ঋতু নয়—এটি একটি মানসিক ও সাংস্কৃতিক অনুভবের পরিসর। প্রাচীন পদাবলী থেকে শুরু করে আধুনিক কবিতা পর্যন্ত বর্ষা এসেছে নানা রূপে, নানা ব্যঞ্জনায়। প্রতিটি কবির কলমে এই ঋতু নতুন রূপে ধরা দিয়েছে। আর সে কারণেই বর্ষা বাংলা কবিতার এক অবিচ্ছেদ্য ও চিরনবীন অনুপ্রেরণা হয়ে রয়ে গেছে।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

স্টারলিংকের ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা

বাংলাদেশে স্টারলিংক বর্তমানে তিনটি মূল প্যাকেজ চালু করেছে। প্রথমটি ‘রেসিডেনশিয়াল’, যার মাসিক খরচ ছয় হাজার টাকা। এটি মূলত বাসাবাড়ির জন্য উপযুক্ত। দ্বিতীয়টি ‘রেসিডেনশিয়াল লাইট’, যার জন্য মাসে খরচ হবে চার হাজার দুই শত টাকা।

১৫ ঘণ্টা আগে

তুই থুলি মুই থুলি পাখির গল্প

দিন যায়, রাত যায়, টাকার শোকে তারা বিমর্ষ হয়ে ওঠে। কিন্তু টাকার হাঁড়ার সন্ধান আর মেলে না। প্রতিদিন ঝগড়া হয়—তুই থুলি না মুই থুলি, টাকার হাড়া কনে থুলি।

১ দিন আগে

হঠাৎ কানে ব্যথা হলে করণীয়

সবচেয়ে সাধারণ কারণগুলোর মধ্যে একটি হলো ঠান্ডা লাগা বা সর্দি-কাশির সংক্রমণ থেকে কানের ভেতরে চাপ তৈরি হওয়া। নাক ও গলা দিয়ে ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কানের মধ্যকর্ণে পৌঁছায়, যেখানে তরল জমা হতে পারে এবং সেই চাপ থেকে ব্যথা শুরু হয়।

১ দিন আগে

কাঁচা আমের পুষ্টিগুণ

কাঁচা আমে আছে ভিটামিন এ, ই ও বি কমপ্লেক্স, যা ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়ায় এবং চোখের জন্য ভালো। বিশেষ করে শিশুদের চোখের যত্নে কাঁচা আমের উপকারিতা রয়েছে।

১ দিন আগে