মহামারি

ফিরে আসছে প্লেগ, প্রাণঘাতি এই মহামারির ইতিহাস জানেন?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৩২

প্লেগ—এই একটি শব্দই ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ত করে রেখেছে পৃথিবীর বহু দেশের নাম। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই ভয়ানক রোগ বারবার ফিরে এসে কেড়ে নিয়েছে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ। অথচ আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের এত উন্নতির পরও, আজও প্লেগ একেবারে নির্মূল হয়নি। বরং সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের কিছু অঞ্চলে প্লেগ রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা আবারও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন—এই রোগ কি আবার ফিরে আসছে?

প্লেগ হচ্ছে ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস (Yersinia pestis) নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ। সাধারণত এটি ছড়ায় ইঁদুরের দেহে থাকা মাছির মাধ্যমে। যখন এই মাছিগুলো কোনো মানুষকে কামড়ায়, তখন মানুষের শরীরে প্লেগের জীবাণু ঢুকে পড়ে এবং খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। আবার কোনো প্লেগ আক্রান্ত মানুষ হাঁচি-কাশি দিলে সেই জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে অন্য মানুষকেও সংক্রমিত করতে পারে।

এই রোগ সাধারণত তিন ধরনের হয়: বিউবনিক প্লেগ, সেপটিসেমিক প্লেগ এবং প্লামোনিক প্লেগ। বিউবনিক প্লেগ হলো সবচেয়ে প্রচলিত রূপ, যা শরীরে ফুলে ওঠা লিম্ফ নোড বা গাঁটে চরম যন্ত্রণার সৃষ্টি করে। সেপটিসেমিক প্লেগে রক্তে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে, এবং প্লামোনিক প্লেগ ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটায়, যা সবচেয়ে বিপজ্জনক কারণ এটি সহজেই এক ব্যক্তি থেকে আরেক ব্যক্তির শরীরে ছড়াতে পারে।

প্লেগ ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল চতুর্দশ শতকে, যখন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে “ব্ল্যাক ডেথ” নামে পরিচিত মহামারি। ১৩৪৭ থেকে ১৩৫১ সাল পর্যন্ত চলা এই মহামারিতে ইউরোপের আনুমানিক এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যায়—যার সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি। সেই সময় শহরের পর শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে, গ্রাম-গঞ্জে পচে থাকা লাশে ছড়িয়ে পড়ে দুর্গন্ধ, গির্জা, রাজপ্রাসাদ থেকে শুরু করে সবখানে শোকের ছায়া নেমে আসে।

এই ভয়ংকর সময়ের বর্ণনা দিয়ে ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড-এর ইতিহাসবিদ ড. এলেন রিচার্ডস বলেন, “১৩৪৮ সালের প্লেগ এমন একটি ধাক্কা ছিল যা শুধু জনসংখ্যা নয়, ইউরোপের অর্থনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক কাঠামোকেও পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল।” তাঁর মতে, প্লেগ মহামারি শেষে ইউরোপজুড়ে শুরু হয় কৃষি ব্যবস্থার বদল, শ্রমিকের চাহিদা বাড়ে এবং সমাজে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একপ্রকার বিদ্রোহ দেখা দেয়।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, শুধু ইউরোপ নয়, চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন অঞ্চলে প্লেগ বারবার ফিরে এসেছে। ১৮৫৫ সালে চীনের ইউনান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া আরেকটি প্লেগ মহামারি চীন, ভারত এবং হংকং হয়ে পৌঁছে যায় ইউরোপ পর্যন্ত। তখন শুধু ভারতেই মারা যায় প্রায় এক কোটি মানুষ।

প্লেগের ভয়াবহতা এমন ছিল যে, এক সময় এটি ঈশ্বরের অভিশাপ বা শয়তানের শাস্তি বলে ধরে নেওয়া হতো। মানুষ তখন প্লেগ থেকে বাঁচতে নানা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান করত, আত্মত্যাগ করত, এমনকি কখনো কখনো প্লেগকে ছড়ানোর জন্য নির্দোষ সংখ্যালঘুদের দোষারোপ করে তাদের উপর সহিংসতা চালানো হতো।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আর প্লেগকে অভিশাপ ভাবা হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্লেগকে একটি “রোগ যা প্রতিকারযোগ্য” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। সময়মতো অ্যান্টিবায়োটিক চিকিৎসা শুরু করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। তবে সমস্যা হয় যখন রোগ শনাক্তে দেরি হয় অথবা রোগীর অবস্থা অত্যন্ত গুরুতর হয়ে পড়ে।

ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. পিটার বেনেট বলেন, “আজকের দিনে প্লেগ হওয়া মানেই মৃত্যু নয়। বরং অ্যান্টিবায়োটিক ঠিকভাবে ব্যবহার করলে রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখনো বিশ্বের অনেক জায়গায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছেনি, কিংবা চিকিৎসা নিয়ে মানুষ যথেষ্ট সচেতন নয়।”

তিনি আরও বলেন, “প্রতি বছর আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে প্লেগ রোগী পাওয়া যায়। মাদাগাস্কার, ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো কিংবা পেরুর কিছু জায়গায় প্লেগ এখনো সংক্রমণ ঘটায়।” এসব জায়গায় ইঁদুর ও মাছির বিস্তার এবং মানুষের অস্বাস্থ্যকর বাসস্থান রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্লেগ আবারও খবরের শিরোনামে এসেছে। ১২ জুলাই শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনায় এক ব্যক্তির মৃত্য হয়ছে। এছাড়া ২০১৭ সালে মাদাগাস্কারে প্লেগে আক্রান্ত হয় কয়েক হাজার মানুষ এবং মারা যায় শতাধিক। ২০২০ সালে চীনের ইন্নার মঙ্গোলিয়া প্রদেশে বিউবনিক প্লেগে আক্রান্ত হন কয়েকজন। ২০২3 সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকোতে একজন নারীর শরীরে প্লেগ ধরা পড়ে।

এসব খবর আতঙ্ক ছড়ালেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, এখনো এটি মহামারি হয়ে ওঠেনি। তবে তাদের উদ্বেগ অন্য জায়গায়। যেহেতু প্লেগ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ এবং অ্যান্টিবায়োটিকের ওপর নির্ভরশীল, তাই যদি কখনো এর জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে ওঠে, তাহলে এটি ভয়ংকর রূপ নিতে পারে।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন-এর গবেষক ড. লিন্ডা ম্যাকগ্র্যাথ বলেন, “আমরা যদি অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ না করি, তাহলে প্লেগসহ বহু ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে।” তিনি জানান, প্লেগ এখনো জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের আশঙ্কার মধ্যেও পড়ে। কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠী যদি প্লেগের জীবাণু ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়িয়ে দেয়, তবে তা ভয়াবহ বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে।

তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা। প্লেগ প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে ইঁদুর ও মাছির বিস্তার রোধ করা। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, খাবার ঢেকে রাখা, গৃহপালিত প্রাণীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো, এবং প্লেগ-প্রবণ এলাকায় গেলে সতর্কতা অবলম্বন করা খুবই জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, যেসব এলাকায় প্লেগ এখনো দেখা যায়, সেখানে জনস্বাস্থ্য কর্মীদের নিয়মিত নজরদারি, আক্রান্তদের দ্রুত শনাক্ত করে আইসোলেশনে নেওয়া, এবং পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিক মজুত রাখার ব্যবস্থা থাকা দরকার।

সবশেষে বলা যায়, প্লেগ শুধুমাত্র ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, এটি এখনো বর্তমান দুনিয়ায় একটি বাস্তব হুমকি। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে আমরা এখন অনেকটাই নিরাপদ, কিন্তু ঝুঁকি একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।

ড. এলেন রিচার্ডস-এর কথায়, “প্লেগের ইতিহাস আমাদের শেখায়—মানবসভ্যতা যতই উন্নত হোক না কেন, প্রকৃতি যদি চায় তবে আমাদের অসহায় করে দিতে পারে। তাই প্রস্তুত থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

সুতরাং ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তা নিয়ে এবং সচেতনতার মাধ্যমে আমরা পারি এই ভয়ংকর রোগকে দূরে রাখতে। সময় থাকতে সাবধান হওয়াটাই সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

হত্যাচেষ্টা মামলায় জামিন পেলেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস

ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী অপু বিশ্বাস হত্যাচেষ্টা মামলায় আত্মসমর্পণ করে জামিন পেয়েছেন। রবিবার (১৩ জুলাই) তিনি ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে আদালত ১০ হাজার টাকা বন্ডে পুলিশ প্রতিবেদন দাখিল পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন।

৯ ঘণ্টা আগে

যে কারণে নষ্ট হতে পারে কিডনি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্যে বলা হয়েছে, পৃথিবীতে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন কোনো না কোনো কিডনি সমস্যায় ভুগছেন। আর কিডনি ফেলিওর বা সম্পূর্ণ কিডনি অকেজো হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো দীর্ঘদিন ধরে অজান্তে চলা কিছু রোগ ও ভুল জীবনযাপন পদ্ধতি।

১ দিন আগে

ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিলেন আইনস্টাইন

আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদি। নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ইহুদি পরিচয় নিয়েও তিনি ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের বিরোধিতা করেছিলেন।

১ দিন আগে

বাংলাদেশের আলোচিত রাজসাক্ষী

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বহু বছর নীরবতায় ঢাকা ছিল সত্য। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এই মামলার তদন্ত শুরু হলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে উঠে আসেন বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারি মহিতুল ইসলাম।

১ দিন আগে