কেন আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারছি না

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
জুলাই জাতীয় সনদে সই করতে অপারগতা জানিয়ে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে চার বাম দল। ছবি: রাজনীতি ডটকম

[জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দীর্ঘ আলোচনায় তৈরি হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫। তবে এ সনদের বিভিন্ন প্রস্তাবে 'নোট অব ডিসেন্ট' বা মতভিন্নতা রয়ে গেছে৷ সনদ বাস্তবায়নে গণভোটের দিন-তারিখ নিয়েও ঐকমত্য আসেনি। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ) স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, তারা এ সনদে সই করবে না৷ বাম এই চার দলের জোট কেন এই সনদে সই করবে না, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছে। সে ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো রাজনীতি ডটকমের পাঠকদের জন্য।]

১৭ অক্টোবর বিকেলে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই সনদে স্বাক্ষর প্রদান অনুষ্ঠান। আমন্ত্রিত হয়েও আমরা অংশগ্রহণ করতে পারছি না কেন— সে বিষয়ে দেশবাসীকে অবহিত করা প্রয়োজন।

গত বছর ৫ আগস্ট দেশে ছাত্র–শ্রমিক–জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল, অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কার, গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং একটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। সরকার এ লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। প্রথমে ৬টি কমিশনের সুপারিশ নিয়ে ৩০-৩৭টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা ৩ জুন শুরু হয়ে ৩০ জুলাই শেষ হয়। তৃতীয় পর্যায়ে জুলাই জাতীয় সনদের বাস্তবায়ন নিয়ে ৫ দিন আলোচনা হয়, যা ৮ অক্টোবর সমাপ্ত হয়।

১৫ অক্টোবর বিকেলে ঐকমত্য কমিশনের আকস্মিক আহ্বানে আমরা ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের নেতা ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপস্থিত হই। প্রধান উপদেষ্টা অধ‍্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। কিন্তু আমাদের দলগুলোর কাউকেই বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমরা মনে করি, ইচ্ছাকৃতভাবেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ভিন্নমতের কণ্ঠ বন্ধ করতে এই আচরণ করেছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অগণতান্ত্রিক।

প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, সব দল যেসব বিষয়ে একমত হবে, শুধুমাত্র সেগুলোকেই ঐকমত্য হিসেবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ১৪ অক্টোবর আমাদের কাছে পাঠানো চূড়ান্ত সনদে দেখা যায়, সর্বসম্মত নয় এমন প্রস্তাবগুলোও যুক্ত করা হয়েছে এবং আমাদের দেওয়া নোট অব ডিসেন্ট যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

আমাদের আপত্তির মূল কারণগুলো হলো—

১. শুধুমাত্র সর্বসম্মত বিষয়ে সবার স্বাক্ষর নেওয়া উচিত; ভিন্নমতগুলো অতিরিক্ত প্রতিবেদন হিসেবে সংযুক্ত থাকতে পারে।

২. মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাস সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি, আমাদের সংশোধনী উপেক্ষা করা হয়েছে।

৩. সনদের শেষ অংশে পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করতে বলা হয়েছে, কিন্তু ভিন্নমত থাকা অবস্থায় সেটি যৌক্তিক নয়।

৪. সনদকে সংবিধানের তফসিলে যুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়েছে, আমরা কেবল সর্বসম্মত সনদ সংবিধানে যুক্ত করার পক্ষে।

৫. “জুলাই সনদ নিয়ে কেউ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে না”— এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

৬. সংবিধানের ১৫০(২) অনুচ্ছেদে থাকা স্বাধীনতার ঘোষণা ও প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স বাদ দেওয়ার সুপারিশ বাংলাদেশের অস্তিত্বের ভিত্তিকে বিপন্ন করে।

৭. অভ্যুত্থান-পরবর্তী ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রেফারেন্সে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত সনদে বাদ দেওয়া হয়েছে।

উপরোক্ত বিষয়ে সমাধান না হওয়ায় আমাদের পক্ষে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব নয়। বিশেষত সংবিধানে বিদ্যমান চার মূলনীতি— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ— এবং ১৫০(২) অনুচ্ছেদের তফসিল পরিবর্তনের প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করতে পারি না। আদালতে প্রশ্ন তোলার অধিকার হরণকারী কোনো অঙ্গীকারেও আমরা স্বাক্ষর করব না।

তবে জুলাই সনদে যে সব বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি, সেগুলো বাস্তবায়নে আমরা জাতির কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতীয় সংসদের ভেতরে ও বাইরে এসব বিষয় বাস্তবায়নে আমরা দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।

চার দলের পক্ষে—

কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন, সভাপতি ও আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি;

বজলুর রশীদ ফিরোজ, সাধারণ সম্পাদক, বাসদ;

মাসুদ রানা, সমন্বয়ক, বাসদ (মার্কসবাদী); এবং

ডা. মুশতাক হোসেন, সদস্য, স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাসদ

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

হিংসা এমন আগুন যা নিজেকেই দগ্ধ করে

হীনমন্যতায় আক্রান্তরা মনে করছে, অন্যের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাদের পথে বাধা হবে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষের অসুস্থ চর্চায় নিজেদের কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিরূপ আচরণ ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বের অবমাননা হচ্ছে এবং সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে না।

৬ দিন আগে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম— অনির্বাণ আলো হয়ে জেগে থাকবে সমাজে-সাহিত্যে

অন্ধকার সময়েও সে ছিল আমাদের আলোকবর্তিকা, যে দেখিয়েছে— সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার নয়, নৈতিক সাহসেরও একটি ক্ষেত্র। অন্যায় ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সে ছিল দৃঢ়, কিন্তু তার ভাষা ছিল সবসময় কোমল, গভীর ও আলোকিত।

৬ দিন আগে

চে গুয়েভারা— মৃত্যুতেও চিরভাস্মর

সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, চে যুদ্ধের সময় আহত হয়ে মারা যান। সে বিবৃতি কেউ বিশ্বাস করেনি। সরকার গোপনে তার মুখের ছাপ তুলে ও দুই হাত কেটে রাখে প্রমাণ হিসেবে, যেন তার কবর কোনো বিপ্লবী তীর্থে পরিণত না হয়।

৮ দিন আগে

গণশুনানির নামে নাটক চলছে কি আগের ধারায়?

বিগত সরকারের সময় এসব বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হয়ে যাওয়ায় আমরা অনেক সময় প্রতিবাদ জানিয়ে গণশুনানিতে যাইনি। অনেকের আশা ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে গণশুনানি করবে। কিন্তু না— তা হলো না। সরকার অতীতের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরাচারী সরকারের পথ

৯ দিন আগে