নাগরিক জীবন, নিরাপত্তা ও দায়বদ্ধতা

যখন মাটি দুলে ওঠে, তখন আমাদের ব্যবস্থার সত্য উন্মোচিত হয়। শুক্রবার সকালের ভূমিকম্প কেবল প্রাকৃতিক নয়; এটি আমাদের নাগরিক জীবন, নিরাপত্তা ও কাঠামোগত দুর্বলতার এক নির্মম আয়না। সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে অনেকেই রক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু ঢাকা ও ঢাকার বাইরের প্রাণহানি ও হতাহতের খবর আমাদের মনে করিয়ে দেয়— নিরাপত্তা কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না। প্রতিটি প্রাণহানি একটি পরিবারকে ভেঙে দেয়, জীবনের সম্ভাবনা থামিয়ে দেয়। মনে রাখতে হবে— মানুষের জীবন অমূল্য।

ভূমিকম্পে দৃশ্যমান বাস্তবতা

বাংলাদেশ, বিশেষত ঢাকা শহর গত কয়েক দশকে দ্রুত নগরায়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। বহু মানুষ রাজধানীতে ভাড়া বা নিজেদের ভবনে বসবাস করছে, যেখানে নিরাপত্তার মান অনেক ক্ষেত্রে কম।

ভূমিকম্পের সময় স্পষ্ট হয়, অনেক ভবনের কাঠামো দুর্বল, যান্ত্রিকভাবে অযোগ্য এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে অপ্রস্তুত। সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকিতে, আর প্রশাসনের সক্ষমতাও এই ঝুঁকি মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়।

প্রশ্ন জাগে—

  • কেন ঢাকা শহরের অধিকাংশ ভবন এখনও নিরাপদ নয়?
  • কেন মানসম্পন্ন নির্মাণের ন্যূনতম মানদণ্ড উপেক্ষিত হয়?
  • কেন নীতি প্রয়োগে শিথিলতা দেখা যায়?
  • দুর্যোগকালীন অবকাঠামোর তত্ত্বাবধান কোথায়?

এগুলো কেবল যুক্তির প্রশ্ন নয়, এগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস, অসহায়তার অভিব্যক্তি ও বহু বছরের অভিজ্ঞতার বেদনার প্রতিফলন।

অনেকেই বলছেন, ‘নীতিনির্ধারকরা কোথায়? মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে ভবন তৈরির অনুমোদন দেয় কে?’ ক্ষোভটি কঠোর হলেও বাস্তবতারই আর্তনাদ।

নীতিনির্ধারকের দায়িত্ব

নীতিনির্ধারক কেবল সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নন; তারা মানুষের নিরাপত্তার রক্ষক, নগর পরিকল্পনার দিকনির্দেশক এবং সমাজের অগ্রগতির অভিভাবক।

নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানে শুধু আইন প্রয়োগ নয়; এর মধ্যে রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গি, সচেতনতা এবং মানুষের জীবনের মূল্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। একটি দেশের অগ্রগতি কিলোমিটার, বহুতল ভবনের উচ্চতা বা ফ্লাইওভারের সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ হয় না— অগ্রগতি পরিমাপ হয় মানুষের জীবন বাঁচানোর সক্ষমতায়।

যখন স্থাপনা টেকসই নয়, নীতি মানা হয় না— তখন প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্পই মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলে। আজকের ভূমিকম্প সেই সত্যটিই আমাদের সামনে তুলে ধরেছে।

সাধারণ নাগরিক আজ সচেতন, কিন্তু তাদের সক্ষমতা সীমিত। সরকার, প্রশাসন, নীতিনির্ধারক ও পরিকল্পনাকারীরা যে দায়িত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছেন, তার ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে, গণমাধ্যমে ও সাধারণ আলাপচারিতায়।

সরকারি কাঠামো, রক্ষণাবেক্ষণ নীতি এবং নাগরিক সচেতনতা মিলিতভাবে কাজ না করলে দুর্যোগ মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেয়।

  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিকতা, গবেষণা— সব ক্ষেত্রকেই অংশগ্রহণ করতে হবে।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি, জরুরি প্রস্তুতি ও দুর্যোগকালীন মানবিক সহায়তা কার্যকর করতে সমন্বিত উদ্যোগ অপরিহার্য।
  • ভবিষ্যৎ নগর ও মানুষের জীবন রক্ষা— এটাই মূল লক্ষ্য।

করণীয় পদক্ষেপ

  • বাস্তবতার স্বীকারোক্তি: দুর্বল কাঠামো উপেক্ষা করলে বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
  • নীতি-প্রয়োগে কঠোরতা: মানদণ্ড অমান্যকারী নির্মাতা ও মালিকদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহনশীলতা।
  • মানুষকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার: উন্নয়ন নয়— মানুষই কেন্দ্রে।
  • দুর্যোগ-প্রতিরোধী পরিকল্পনা: নগর পরিকল্পনা, নিকাশব্যবস্থা, নিরাপত্তা, উদ্ধার ও সতর্কতা ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক।
  • সচেতন নাগরিক অংশগ্রহণ: জনগণের জন্য তথ্য ও প্রস্তুতিমূলক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে।
  • স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা: সরকারি প্রকল্প ও নীতির কার্যকারিতা নিয়মিত মূল্যায়ন।

যে শিক্ষা আমরা নিতে পারি

  • সতর্কতা ও প্রস্তুতি কখনো অপ্রয়োজনীয় হয় না।
  • মানুষের জীবনকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে নীতি ও আইন প্রয়োগে আন্তরিকতা অপরিহার্য।
  • দুর্যোগ-পরবর্তী ব্যবস্থা তাত্ত্বিক নয়— বাস্তব, কার্যকর ও সহনশীল হতে হবে।

মানুষের প্রাণ নিরাপদ না হলে, উন্নয়নের প্রতিটি ইট নীরব বিদ্রূপ হয়ে দাঁড়ায়।

মানুষের দায়িত্ব ও সচেতনতা

যে সমাজ মানুষকে রক্ষা করতে পারে, সেই সমাজই ভবিষ্যৎ রক্ষায় সক্ষম।

শুধু প্রশাসন নয়—নাগরিক সমাজকেও অংশ নিতে হবে। সব স্তরে প্রশিক্ষণ, সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক মূল্যবোধ— সবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি স্বাস্থ্যবান, সচেতন ও দায়িত্বশীল সমাজই দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সক্ষম।

আজকের কম্পন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে— দুর্যোগ প্রস্তুতি শুধু প্রযুক্তি বা পরিকল্পনার বিষয় নয়; এটি সামাজিক মূল্যবোধ, দায়বদ্ধতা এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়।

[উপস্থাপিত তথ্য, বিশ্লেষণ ও মতামত সম্পূর্ণরূপে লেখকের ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি। এটি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সরকারি বা বেসরকারি কর্তৃপক্ষের অবস্থান বা দাবি নয়।]

লেখক: ব‍্যাংকার ও সমাজ পর্যবেক্ষক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

কোডিং ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিখিত পরীক্ষার মূল্যায়ন: একটি বিশ্লেষণ

কোডিং পদ্ধতিতে কেবল লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর বাইরে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশন, মৌখিক পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষার কোনোটিতেই কোডিং বা ছদ্মবেশ নেওয়ার কোনো উপায় নেই!

১৩ দিন আগে

নারী কমিশনকে সাক্ষাৎই দেয়নি সংবিধান সংস্কার কমিশন

একটি কমিশন আমাদের সময় দেয়নি— সংবিধান কমিশন। আমি জানি না কেন তারা সময় দেয়নি। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, সংবিধান সংস্কারে নারীদের আবার কী বলার থাকতে পারে! তারা আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না-ই করতে পারতেন, কিন্তু সময় দেওয়াটা ছিল শোভন আচরণের অংশ। সেই সৌজন্যটুকু আমরা পাইনি।

১৫ দিন আগে

প্রসঙ্গ— সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট

এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা যে ভয়াবহ রূপ লাভ করবে, সেটা এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আচরণবিধি ঠিক রেখে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার সার্বিক দায়-দায়িত্ব নিলে অনেক কিছু রোধ করা যেত।

১৫ দিন আগে

এই গণভোটের প্রশ্ন বোধগম্য নয়

প্রকৃত অর্থে এগুলো একটি রাজনৈতিক কাঠামোর প্রশ্ন। এটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা দ্রব্যমূল্যের মতো বিষয় নয়। তেমন হলে সাধারণ মানুষের স্বার্থ যুক্ত থাকত। কিন্তু এটি উচ্চমধ্যবিত্তের প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা। কীভাবে সাধারণ মানুষ এতে ভোট দিবে পক্ষে-বিপক্ষে, সেটি আমিও বুঝতে পারছি না।

২৯ অক্টোবর ২০২৫