রাজু আলীম
বিশিষ্ট কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতার অনুকরণই এখন যেন সত্যিতে পরিণত হয়েছে ইসরায়েল— ‘নিউটন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না।’
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে কাতারে কাতারে মরছে নারী, শিশু ও নিরস্ত্র মানুষ। বিশ্ববিবেক ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় লাখো মানুষের মার্চ ফর গাজা হলো। কিন্তু ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, ওআইসি ও আরব লিগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
৮০০ কোটি মানুষের চোখের সামনে সম্প্রতি ৬০ হাজারেও বেশি মানুষ হত্যা করা হলো গাজায়। জাতিসংঘের নীরব ভূমিকার বিরুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো কেন আরও সোচ্চার নয়— এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিবেকবান মানুষের মধ্যে।
গাজার এই পরিস্থিতির সুযোগে যদি দেশে দেশে যদি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটে, তার দায় কে নেবে? মিজানুর রহমান আজহারীসহ ওলামা-মাশায়েখরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। আর কি করতে পারে মুসলিম উম্মাহ? মুসলিম বিশ্বের পাশ্চাত্য নির্ভরতার কারণেই কি তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না?
এই যে মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে গাজায়। আন্তর্জাতিক আইন কী বলে? আইনি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের এই বিষয়ে করণীয় কিছু আছে কি? মুসলিমরা আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে কি? নাকি এসব ট্রাইব্যুনালও ইহুদি ও নাসারাদের ইশারায় চলে? জাতিসংঘ ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো কি নিশ্চুপ্? এই দায় কি এড়াতে পারে তারা? ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার দায়িত্ব কি শুধু মুসলমানদের, নাকি বিশ্ব মানব সভ্যতার— এমন হাজারও প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
গাজার পরিস্থিতি মূলত ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ, যা এখন বিশ্ব ভাবনার প্রধান মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ব্যথা উপশমের পথে হাঁটছে না কেউ। এর ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব মানবতা। মুহুর্মুহু ইসরায়েলি হামলায় গাজা স্ট্রিপ নামের ক্ষুদ্র উপকূলীয় ছিটমহলটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা জীবন বাঁচানোর জন্য হাহাকার করছে। বিধ্বংসী বিমান হামলা আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। বিস্ফোরণে উড়ন্ত ধ্বংসাবশেষের আঘাতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ক্ষমতাসীন হামাসের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ইসরায়েল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী গাজায় স্থল অভিযান চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং আইডিএফ, ইসরায়েল প্রতিরক্ষাবাহিনী প্রতিটি হামাস সদস্যকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্বের সব গণমাধ্যম ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়।
নিরীহ নিরস্ত্র গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত লাগাতার আক্রমণের বীভৎসতা বিশ্ববাসীকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। বিশ্ব বিবেক এই নিষ্ঠুরতা দেখে নিষ্ফল উদ্বেগ প্রকাশ করছে। মানবাধিকার কর্মীরা হা-পিত্যেশ করছে। খিস্তি খেউড় করছে। কিন্তু উত্তেজনা প্রশমনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিনই মানুষ মরছে গাজায়। ছবি: সংগৃহীত
পক্ষান্তরে বিদ্রোহী পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ যুদ্ধ লড়ছে আর পরস্পর পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। পক্ষবিশেষের প্রতি সমর্থন-অসমর্থন একান্তই নিজস্ব বিবেচনার ব্যাপার। কিন্তু নিরপরাধের রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, যদিও গাজায় যা ঘটছে তার জন্য কেউ দায় নিতে চায় না, তবুও কমবেশি সবাই দায়ী।
একদিকে রক্তপিপাসু ইসরায়েলিদের জাতিগত আত্মশ্লাঘা, অন্যদিকে হিংস্র হামাসের ধর্মান্ধ জিঘাংসা— নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর দুই তরফ থেকেই বাড়ছে চাপ। উপরন্তু ইসরায়েলকে দেওয়া মার্কিনিদের নির্লজ্জ প্রশ্রয়, মার্কিন-মিত্রদের প্রকাশ্য উদাসীনতা, জাতিসংঘের কুমিরের কান্না এবং আরব লীগের কৃত্রিম উদ্বেগ প্রতিহিংসার আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছুই এই অন্তহীন পৈশাচিকতা থেকে মুক্তির পথ দেখায় না। আর এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প কী হতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে, গাজা ভূখণ্ডে ইহুদিদের এই বিরামহীন আক্রমণ ইসরায়েলের ওপর ভয়াবহ আকস্মিক হামলাকারী হামাস যোদ্ধাদের ওপর একটি যথোচিত প্রতি-আক্রমণ। কিন্তু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের পূর্ণাঙ্গ কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে হামাসের এই আকস্মিক আক্রমণকে অপ্ররোচিত সামরিক আগ্রাসন বলে মনে হবে না। বরং তা দীর্ঘদিনের ইসরায়েলি আক্রমণ, আটক, নির্যাতন, উচ্ছেদ ও হত্যার বিরুদ্ধে হামাস পরিচালিত পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও আক্রোশজাত সুপরিকল্পিত এক প্রতি আক্রমণ এবং ইসরায়েলের কঠোর সামরিক প্রতিশোধ থেকে মুক্তির সশস্ত্র উপায়।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের গল্প প্রায় ৭০ বছর ধরে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির আগে ব্রিটিশ নির্দেশিত (১৯২০-৪৭) ফিলিস্তিনে বসবাস করত এবং তাদের বংশধররা ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য প্রাণপণে লড়াই করছে। অন্যদিকে ইহুদিরা তাদের তথাকথিত ওল্ড টেস্টামেন্ট রাজ্য পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বদ্ধপরিকর।
একদিকে আরব বেদুইনদের অদম্য সাহস, একগুঁয়েমি ও ধর্মীয় উন্মাদনা; অন্যদিকে ইহুদিবাদীদের আত্মম্ভরিতা, সামরিক শক্তি এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাব— দুইয়ে মিলিয়ে একে অন্যকে কয়েক দশক ধরে শত্রু ভাবাপন্ন করে রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঙ্কেল স্যামের সক্রিয় সমর্থন, যা ইসরায়েলকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম আধিপত্যের বিপ্রতীপে। এভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিন সমস্যা একটি অসম্ভব জটিল সমস্যা হিসেবে থিতু হতে থাকে, যার স্থায় সমাধান সুদূরপ্রসারী।
এই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রক্তপাত আর কতদিন চলবে? বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ মোটামুটি নিষ্পত্তি হয়েছে। পর্যায়ক্রমিক আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির পর মিশর ইসরায়েলের কাছ থেকে ১৯৭৯ সালে সিনাই উপত্যকা ফিরে পেয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বৈরিতা এ ধরনের পারস্পরিক মীমাংসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কিন্তু সেজন্যে একে অন্যকে বুঝতে হবে, সমঝোতার মনোভাব নিয়ে সংকট নিরসনে আগ্রহী হতে হবে, যা অসলো চুক্তিতে (১৯৯৩-১৯৯৫) বিধৃত হয়েছিল।
হতাশাজনক ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এ পর্যন্ত সম্পাদিত চুক্তিগুলো অবশ্যই পারস্পরিক সহনশীলতার জন্য সামান্য পথ প্রশস্ত করেছে, যা এই সন্ধিক্ষণে ইতিবাচক মনে করা যেতে পারে। উভয়ের উচিত রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করা। সাড়ে সাত দশক এই উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট যে তাদের কেউই অন্যকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পারবে না এবং আধিপত্যবাদ ও সন্ত্রাসবাদ থেকে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।
ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলের আইজাক রবিন ( ১৯৯২-১০৯৫) এবং শিমন পেরেজ অসলো চুক্তি তৈরিতে ভূমিকার জন্য যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (১৯৯৪) পান। তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছিলেন। তাদের অনুসারীদের উচিত শান্তি আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত রাখা।
বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি এখন সংঘাতের প্রকোপে অসুস্থ ও ক্লান্ত। বিভিন্ন উপায়ে দ্বিজাতি সমাধানের দিকে যেতে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাই নেতানিয়াহু ও হামাসের এই পারস্পরিকতা ও সমতার দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত।
ইসরায়েলকে তার জাতিগত অহমিকা, আধিপত্যবাদী নীতি ও নরহত্যা যজ্ঞ এবং হামাসকে তার জঙ্গিবাদী মানস থেকে মুক্ত হতে হবে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে চলা আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রনির্মাণের আন্দোলনকে ম্লান করে দিয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ও সাধারণভাবে আরব বিশ্বের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য থাকতে হবে।
জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের আবেদনের বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নেওয়া হয়েছিল। মিডল ইস্ট কোয়ার্টেট জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আহ্বান জানিয়েছে যে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি পক্ষের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নতুন শান্তি আলোচনার জন্য মিলিত হওয়া উচিত। কিন্তু এ সব উদ্যোগ আমাদের জন্যে খুব একটা আশাপ্রদ হতে পারেনি।
সব আলোচনা প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে নেতানিয়াহু নিরীহ ফিলিস্তিনিদের পঙ্গু ও হত্যা করার জন্য অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ নামে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছেন। পরপর দুটি মহাযুদ্ধে জার্মানি ছিল খলনায়ক। ইসরায়েল কি তবে তৃতীয়টিতে ভিলেন হতে চলেছে?
বাংলাদেশ তার জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সমর্থক। কিংবদন্তি ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বাংলাদেশের আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। তিনি ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন এবং তাদের কাছে মেডিকেল টিম পাঠিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষও তাদের পাশে আছে। লাখ লাখ বাংলাদেশি যারা মানুষ ইহুদি নেকড়েদের ভর্ৎসনা করছে এবং প্রতিরোধকারী ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় লাখো মানুষ নেমে যে সংহতি ও প্রতিবাদ জানাল, তা থেকে নিশ্চয়ই শক্তিশালী বার্তা পেল বিশ্ববাসী। সেই বার্তা, যা থেকে শিক্ষা নিতে পারে মুখ বুঁজে থাকা ৫৭টি ইসলামি রাষ্ট্র, আরব লীগ ও ওআইসির বিশ্ব নেতারা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
বিশিষ্ট কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতার অনুকরণই এখন যেন সত্যিতে পরিণত হয়েছে ইসরায়েল— ‘নিউটন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না।’
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে কাতারে কাতারে মরছে নারী, শিশু ও নিরস্ত্র মানুষ। বিশ্ববিবেক ঘুমিয়ে থাকলেও জেগে উঠেছে বাংলাদেশ। ঢাকায় লাখো মানুষের মার্চ ফর গাজা হলো। কিন্তু ৫৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র, ওআইসি ও আরব লিগের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
৮০০ কোটি মানুষের চোখের সামনে সম্প্রতি ৬০ হাজারেও বেশি মানুষ হত্যা করা হলো গাজায়। জাতিসংঘের নীরব ভূমিকার বিরুদ্ধে আরব রাষ্ট্রগুলো কেন আরও সোচ্চার নয়— এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বিবেকবান মানুষের মধ্যে।
গাজার এই পরিস্থিতির সুযোগে যদি দেশে দেশে যদি জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটে, তার দায় কে নেবে? মিজানুর রহমান আজহারীসহ ওলামা-মাশায়েখরা রাস্তায় নেমে এসেছেন। আর কি করতে পারে মুসলিম উম্মাহ? মুসলিম বিশ্বের পাশ্চাত্য নির্ভরতার কারণেই কি তারা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারে না?
এই যে মানবতাবিরোধী অপরাধ চলছে গাজায়। আন্তর্জাতিক আইন কী বলে? আইনি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ও মুসলিম বিশ্বের এই বিষয়ে করণীয় কিছু আছে কি? মুসলিমরা আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালে যেতে পারে কি? নাকি এসব ট্রাইব্যুনালও ইহুদি ও নাসারাদের ইশারায় চলে? জাতিসংঘ ও বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থাগুলো কি নিশ্চুপ্? এই দায় কি এড়াতে পারে তারা? ফিলিস্তিনে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার দায়িত্ব কি শুধু মুসলমানদের, নাকি বিশ্ব মানব সভ্যতার— এমন হাজারও প্রশ্নের উত্তর দেবে কে?
গাজার পরিস্থিতি মূলত ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে চলমান যুদ্ধ, যা এখন বিশ্ব ভাবনার প্রধান মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু ব্যথা উপশমের পথে হাঁটছে না কেউ। এর ফলে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিশ্ব মানবতা। মুহুর্মুহু ইসরায়েলি হামলায় গাজা স্ট্রিপ নামের ক্ষুদ্র উপকূলীয় ছিটমহলটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা জীবন বাঁচানোর জন্য হাহাকার করছে। বিধ্বংসী বিমান হামলা আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলোকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। বিস্ফোরণে উড়ন্ত ধ্বংসাবশেষের আঘাতে অসংখ্য মানুষ হতাহত হয়েছে।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ক্ষমতাসীন হামাসের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিশোধ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে ইসরায়েল। প্রতিরক্ষামন্ত্রী গাজায় স্থল অভিযান চালানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং আইডিএফ, ইসরায়েল প্রতিরক্ষাবাহিনী প্রতিটি হামাস সদস্যকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। বিশ্বের সব গণমাধ্যম ব্রেকিং নিউজ দিচ্ছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়।
নিরীহ নিরস্ত্র গাজাবাসীদের বিরুদ্ধে সংঘটিত লাগাতার আক্রমণের বীভৎসতা বিশ্ববাসীকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। বিশ্ব বিবেক এই নিষ্ঠুরতা দেখে নিষ্ফল উদ্বেগ প্রকাশ করছে। মানবাধিকার কর্মীরা হা-পিত্যেশ করছে। খিস্তি খেউড় করছে। কিন্তু উত্তেজনা প্রশমনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
ইসরায়েলি হামলায় প্রতিদিনই মানুষ মরছে গাজায়। ছবি: সংগৃহীত
পক্ষান্তরে বিদ্রোহী পক্ষগুলো তাদের নিজ নিজ যুদ্ধ লড়ছে আর পরস্পর পরস্পরের ঘাড়ে দোষ চাপাচ্ছে। পক্ষবিশেষের প্রতি সমর্থন-অসমর্থন একান্তই নিজস্ব বিবেচনার ব্যাপার। কিন্তু নিরপরাধের রক্তক্ষরণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়, যদিও গাজায় যা ঘটছে তার জন্য কেউ দায় নিতে চায় না, তবুও কমবেশি সবাই দায়ী।
একদিকে রক্তপিপাসু ইসরায়েলিদের জাতিগত আত্মশ্লাঘা, অন্যদিকে হিংস্র হামাসের ধর্মান্ধ জিঘাংসা— নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর দুই তরফ থেকেই বাড়ছে চাপ। উপরন্তু ইসরায়েলকে দেওয়া মার্কিনিদের নির্লজ্জ প্রশ্রয়, মার্কিন-মিত্রদের প্রকাশ্য উদাসীনতা, জাতিসংঘের কুমিরের কান্না এবং আরব লীগের কৃত্রিম উদ্বেগ প্রতিহিংসার আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো ব্যাপার হয়ে উঠেছে। কিন্তু কিছুই এই অন্তহীন পৈশাচিকতা থেকে মুক্তির পথ দেখায় না। আর এভাবে চলতে থাকলে সম্ভাব্য দৃশ্যকল্প কী হতে যাচ্ছে, তা সহজেই অনুমেয়।
অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে, গাজা ভূখণ্ডে ইহুদিদের এই বিরামহীন আক্রমণ ইসরায়েলের ওপর ভয়াবহ আকস্মিক হামলাকারী হামাস যোদ্ধাদের ওপর একটি যথোচিত প্রতি-আক্রমণ। কিন্তু ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের পূর্ণাঙ্গ কাহিনির পরিপ্রেক্ষিতে হামাসের এই আকস্মিক আক্রমণকে অপ্ররোচিত সামরিক আগ্রাসন বলে মনে হবে না। বরং তা দীর্ঘদিনের ইসরায়েলি আক্রমণ, আটক, নির্যাতন, উচ্ছেদ ও হত্যার বিরুদ্ধে হামাস পরিচালিত পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ও আক্রোশজাত সুপরিকল্পিত এক প্রতি আক্রমণ এবং ইসরায়েলের কঠোর সামরিক প্রতিশোধ থেকে মুক্তির সশস্ত্র উপায়।
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বের গল্প প্রায় ৭০ বছর ধরে বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। ফিলিস্তিনিরা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র তৈরির আগে ব্রিটিশ নির্দেশিত (১৯২০-৪৭) ফিলিস্তিনে বসবাস করত এবং তাদের বংশধররা ইসরায়েলি দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির জন্য প্রাণপণে লড়াই করছে। অন্যদিকে ইহুদিরা তাদের তথাকথিত ওল্ড টেস্টামেন্ট রাজ্য পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে বদ্ধপরিকর।
একদিকে আরব বেদুইনদের অদম্য সাহস, একগুঁয়েমি ও ধর্মীয় উন্মাদনা; অন্যদিকে ইহুদিবাদীদের আত্মম্ভরিতা, সামরিক শক্তি এবং যুদ্ধংদেহী মনোভাব— দুইয়ে মিলিয়ে একে অন্যকে কয়েক দশক ধরে শত্রু ভাবাপন্ন করে রেখেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আঙ্কেল স্যামের সক্রিয় সমর্থন, যা ইসরায়েলকে ক্রমেই ঠেলে দিচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম আধিপত্যের বিপ্রতীপে। এভাবে ইসরায়েল ফিলিস্তিন সমস্যা একটি অসম্ভব জটিল সমস্যা হিসেবে থিতু হতে থাকে, যার স্থায় সমাধান সুদূরপ্রসারী।
এই ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রক্তপাত আর কতদিন চলবে? বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির নিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিরোধ মোটামুটি নিষ্পত্তি হয়েছে। পর্যায়ক্রমিক আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির পর মিশর ইসরায়েলের কাছ থেকে ১৯৭৯ সালে সিনাই উপত্যকা ফিরে পেয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন বৈরিতা এ ধরনের পারস্পরিক মীমাংসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কিন্তু সেজন্যে একে অন্যকে বুঝতে হবে, সমঝোতার মনোভাব নিয়ে সংকট নিরসনে আগ্রহী হতে হবে, যা অসলো চুক্তিতে (১৯৯৩-১৯৯৫) বিধৃত হয়েছিল।
হতাশাজনক ব্যর্থতা সত্ত্বেও ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে এ পর্যন্ত সম্পাদিত চুক্তিগুলো অবশ্যই পারস্পরিক সহনশীলতার জন্য সামান্য পথ প্রশস্ত করেছে, যা এই সন্ধিক্ষণে ইতিবাচক মনে করা যেতে পারে। উভয়ের উচিত রক্ষণশীল মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করা। সাড়ে সাত দশক এই উপলব্ধির জন্য যথেষ্ট যে তাদের কেউই অন্যকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পারবে না এবং আধিপত্যবাদ ও সন্ত্রাসবাদ থেকে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।
ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত ও ইসরাইলের আইজাক রবিন ( ১৯৯২-১০৯৫) এবং শিমন পেরেজ অসলো চুক্তি তৈরিতে ভূমিকার জন্য যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার (১৯৯৪) পান। তারা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ার উন্নয়নে অনেক অবদান রেখেছিলেন। তাদের অনুসারীদের উচিত শান্তি আন্দোলনের চেতনাকে সমুন্নত রাখা।
বেশিরভাগ ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি এখন সংঘাতের প্রকোপে অসুস্থ ও ক্লান্ত। বিভিন্ন উপায়ে দ্বিজাতি সমাধানের দিকে যেতে তাদের ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। তাই নেতানিয়াহু ও হামাসের এই পারস্পরিকতা ও সমতার দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত।
ইসরায়েলকে তার জাতিগত অহমিকা, আধিপত্যবাদী নীতি ও নরহত্যা যজ্ঞ এবং হামাসকে তার জঙ্গিবাদী মানস থেকে মুক্ত হতে হবে। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে চলা আন্তঃদলীয় দ্বন্দ্ব ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রনির্মাণের আন্দোলনকে ম্লান করে দিয়েছে। বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ও সাধারণভাবে আরব বিশ্বের মধ্যে ইস্পাত কঠিন ঐক্য থাকতে হবে।
জাতিসংঘের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য ফিলিস্তিনিদের আবেদনের বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নেওয়া হয়েছিল। মিডল ইস্ট কোয়ার্টেট জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া আহ্বান জানিয়েছে যে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি পক্ষের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে নতুন শান্তি আলোচনার জন্য মিলিত হওয়া উচিত। কিন্তু এ সব উদ্যোগ আমাদের জন্যে খুব একটা আশাপ্রদ হতে পারেনি।
সব আলোচনা প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করে নেতানিয়াহু নিরীহ ফিলিস্তিনিদের পঙ্গু ও হত্যা করার জন্য অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ নামে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছেন। পরপর দুটি মহাযুদ্ধে জার্মানি ছিল খলনায়ক। ইসরায়েল কি তবে তৃতীয়টিতে ভিলেন হতে চলেছে?
বাংলাদেশ তার জন্মের পর থেকেই ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের সমর্থক। কিংবদন্তি ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে বাংলাদেশের আজীবন বন্ধুত্ব ছিল। তিনি ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আরব দেশগুলোর প্রতি বাংলাদেশের সমর্থন ঘোষণা করেছিলেন এবং তাদের কাছে মেডিকেল টিম পাঠিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের মানুষও তাদের পাশে আছে। লাখ লাখ বাংলাদেশি যারা মানুষ ইহুদি নেকড়েদের ভর্ৎসনা করছে এবং প্রতিরোধকারী ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের উৎসাহ দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঢাকার রাস্তায় লাখো মানুষ নেমে যে সংহতি ও প্রতিবাদ জানাল, তা থেকে নিশ্চয়ই শক্তিশালী বার্তা পেল বিশ্ববাসী। সেই বার্তা, যা থেকে শিক্ষা নিতে পারে মুখ বুঁজে থাকা ৫৭টি ইসলামি রাষ্ট্র, আরব লীগ ও ওআইসির বিশ্ব নেতারা।
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
এ নির্দেশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই একে রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর দাবির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডা সচল রাখার কৌশল হিসেবে দেখছেন।
৩ দিন আগেঅনেক দিন ধরেই মুদ্রিত সংবাদপত্র পাঠক হারানো শঙ্কার মধ্যে আছে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের দ্রুত বিকাশ এই শঙ্কা তৈরি করেছে। দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপটি যেন এই শঙ্কাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, বেশির ভাগ পাঠকই এখন খবরের কাগজের অনলাইন সংস্করণ পড়েন এবং তা পড়েন মোবাইল ফোনে, যার পরিমাণ প্রায় ৬
৪ দিন আগেদেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত— এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।
৪ দিন আগেসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যেসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল, এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, পরিচালন কাঠামো এবং গ্রাহক আস্থা সেই প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রম। ফলস্বরূপ, এক্সিম ব্যাংককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
৬ দিন আগে