টাকার মান বৃদ্ধি: দেশের লাভ ও ঝুঁকি

মো. ফেরদাউস মোবারক
প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২৫, ২২: ২৭

৯ থেকে ১৪ জুলাইয়ের মধ্যে টাকার মান কিছুটা বেড়েছে। ডলারের বিপরীতে বিনিময় হার ১২২ দশমিক ৩ টাকা থেকে কমে হয়েছে ১২০ দশমিক ১ টাকা। এরপর অবশ্য টাকার মান কিছুটা কমেছেও।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার (১৫ জুলাই) আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম ১২১ টাকা ৫০ পয়সা এবং সর্বনিম্ন দাম ১২০ টাকা ৮০ পয়সা। প্রতি ডলারের গড় দাম ১২১ টাকা ১১ পয়সা।

এ পরিবর্তনের পেছনে কাজ করেছে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় বৃদ্ধি এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ। এ পরিস্থিতিকে অনেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির মোড় ঘোরানো এক মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। তাই টাকার মান বাড়লে আমদানি খরচ কমে যায়। যেমন— জ্বালানি, ভোজ্য তেল বা কাঁচামালের দাম কমে গেলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের ওপর চাপ কমে।

২০২২ সাল থেকে টাকার মূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ কমে যাওয়ার ফলে ২০২৪ সালে দেশের মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ১০ শতাংশে পৌঁছে যায়। কিন্তু এখন টাকার মান ফের বাড়তে থাকায় আমদানি ব্যয় কমছে, পণ্যের দাম স্থিতিশীল হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর, ক্রয়ক্ষমতা কিছুটা বাড়ছে।

টাকার এ শক্তিশালী অবস্থান বৈদেশিক ঋণের বোঝাও কিছুটা লাঘব করছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে টাকার মূল্য প্রায় ৪৪ দশমিক ৫২ শতাংশ কমে যাওয়ায় বিদেশি ঋণের খরচ অনেক বেড়ে যায়।

২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে ছিল ৪৮ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি এসে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০ বিলিয়নে। টাকার মান বাড়ায় সরকার কিছুটা স্বস্তি পাচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় ব্যাংক ও ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার খরচও কমছে।

এ পরিবর্তন প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভেতরে ভেতরে অনেকটাই মজবুত। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় দাঁড়ায় ৩০ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলারে এবং রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়নে, যা আগের বছরের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

অবৈধ পুঁজির পাচার রোধ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু এবং বিনিয়োগবান্ধব সংস্কারের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আস্থা আবার ফিরেছে। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এখন চীনের তৈরি পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপ করতে যাচ্ছে। ফলে মার্কিন ক্রেতারা বাংলাদেশের পোশাক খাতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশও এই নতুন চাহিদার অংশ পেতে পারে। এমনকি চীনের কিছু উৎপাদকও বাংলাদেশে বিনিয়োগের কথা ভাবতে পারেন খরচ কমাতে।

টাকার মান বৃদ্ধি মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার পরিকল্পনার অংশ। ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে সরকার ডলার বাজারে নিয়ন্ত্রণ জোরদার করেছে এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি ১২১ দশমিক ৫ টাকা হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ১৭১ মিলিয়ন ডলার কিনেছে, যা থেকে বোঝা যায় যে তারা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছে।

তবে এই শক্তিশালী টাকা যেমন একদিকে সুযোগ এনে দিয়েছে, অন্যদিকে কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জও নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের প্রতিযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। কারণ টাকার দাম বাড়ায় বিদেশে বাংলাদেশের পণ্য তুলনামূলকভাবে বেশি দামে পড়ে যাচ্ছে।

রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে, যার প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ডলারের দাম কমে গেলে এবং মার্কিন মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে সেখানকার ভোক্তারা কম খরচ করতে শুরু করবে, যার ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে পারে।

এ ছাড়া প্রবাসী আয়ের ওপরও চাপ বাড়ছে। টাকার মান বাড়লে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ দেশে রূপান্তর করার পর পরিমাণ কমে যায়। এতে প্রবাসীরা টাকা পাঠাতে অনীহা দেখাতে পারেন। অথচ এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ যেন আরও না কমে, সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এ খাতে হস্তক্ষেপ করছে।

বাংলাদেশের রিজার্ভে বৈচিত্র্যও নেই। প্রায় ৯০ শতাংশ রিজার্ভ ডলারে রাখা। ফলে অন্যান্য মুদ্রার ওঠানামা থেকে বাংলাদেশ খুব একটা সুবিধা নিতে পারছে না। যেসব দেশ রিজার্ভে বিভিন্ন মুদ্রা রাখে, তারা বৈশ্বিক বাজারের পরিবর্তনের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে।

বাইরের কারণেও ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। যদিও টাকার দাম বাড়ায় আমদানিকৃত পণ্যের দাম কিছুটা কমেছে, কিন্তু মার্কিন শুল্ক নীতির পরিবর্তন বা বিশ্বব্যাপী সরবরাহ চেইনে কোনো ধাক্কা লাগলে আবারও দাম বাড়তে পারে। যদি ডলারের দাম আরও কমে এবং যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বাড়ে, তবে সেখানকার ভোক্তারা কম পণ্য কিনবে। ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আরও কমে যেতে পারে।

এই টাকার দাম বৃদ্ধির ঘটনা এমন একটি সময়ে ঘটছে, যখন রাজনৈতিকভাবে দেশ কিছুটা অস্থিতিশীল। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি মজবুত করেছে। কিন্তু জনগণের মনোভাব এখনো বিভক্ত। সোহাগ হত্যাকাণ্ড ও দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে চলমান উত্তেজনা মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াচ্ছে।

অনেকে মনে করেন, টাকার দাম বাড়ার ফলে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন আমদানিকারক ও ব্যবসায়ী শ্রেণি। কিন্তু প্রবাসী আয় প্রেরক ও রপ্তানিকারকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ বৈষম্য সামাজিক অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলতে পারে।

এই টাকার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের পূর্ববর্তী অব্যবস্থাপনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-জনিত বৈশ্বিক ধাক্কার প্রভাব থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০২৫ সালের মে থেকে বাজারভিত্তিক বিনিময় হার চালু করেছে। এতে বিনিময় হার সম্পর্কে স্বচ্ছতা এসেছে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা কিছুটা ফিরেছে। তবে টাকার মান বৃদ্ধি ধরে রাখতে গিয়ে রপ্তানি প্রতিযোগিতা হারানোর আশঙ্কা রয়ে গেছে।

এ পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। রপ্তানির বাজার বৈচিত্র্য আনতে হবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে অন্য বাজার খুঁজতে হবে।

প্রবাসী আয় ধরে রাখতে হলে তাদের জন্য উৎসাহমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে—ডিজিটাল হস্তান্তর সহজ করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাতেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। শুধু ডলারের ওপর নির্ভর না করে অন্যান্য মুদ্রাও রাখতে হবে। সর্বোপরি, দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য দরকার দুর্নীতি দমন, প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।

সবশেষে বলা যায়, টাকার মান বাড়া যেমন একদিকে আশার আলো দেখাচ্ছে—দাম কমছে, ঋণ পরিশোধ সহজ হচ্ছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ছে— তেমনই এর মধ্যে রয়েছে রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের ঝুঁকিও। একে স্থায়ী উন্নয়নে পরিণত করতে হলে প্রয়োজন দূরদর্শী নীতি, ধারাবাহিক সংস্কার এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। তা না হলে এই সাময়িক সাফল্য হারিয়ে যেতে পারে এবং মানুষের আস্থা আরও একবার চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়তে পারে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

নির্বাচনি ভারসাম্যে হাঁটছেন অধ্যাপক ইউনূস

এ নির্দেশের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই একে রাজনৈতিক অস্থিরতা সামাল দেওয়া, প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর দাবির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা এবং অনিশ্চয়তার মধ্যেও ইউনূসের সংস্কার এজেন্ডা সচল রাখার কৌশল হিসেবে দেখছেন।

৪ দিন আগে

মুদ্রিত সংবাদপত্র কি অপসৃত হয়ে যাবে

অনেক দিন ধরেই মুদ্রিত সংবাদপত্র পাঠক হারানো শঙ্কার মধ্যে আছে। অনলাইন নিউজ পোর্টালের দ্রুত বিকাশ এই শঙ্কা তৈরি করেছে। দেশব্যাপী পরিচালিত জরিপটি যেন এই শঙ্কাকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। জরিপ থেকে জানা যাচ্ছে, বেশির ভাগ পাঠকই এখন খবরের কাগজের অনলাইন সংস্করণ পড়েন এবং তা পড়েন মোবাইল ফোনে, যার পরিমাণ প্রায় ৬

৫ দিন আগে

স্বপ্নের ডানায় ভর করে শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ভাঙা কি আদৌ সম্ভব?

দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত— এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।

৬ দিন আগে

এক্সিম ব্যাংক— ঘুরে দাঁড়ানোর অনন্য নজির

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যেসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল, এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, পরিচালন কাঠামো এবং গ্রাহক আস্থা সেই প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রম। ফলস্বরূপ, এক্সিম ব্যাংককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

৭ দিন আগে