খাদ্য ও পুষ্টি

খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া কি উচিত?

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
জিরা পানিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ছবি: এআইয়ের তৈরি।

খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া অনেকের কাছে একটি জনপ্রিয় অভ্যাস। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে ভেষজ উপাদান বা মসলা দিয়ে তৈরি নানা ধরনের পানীয় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষদের কাছে বেশ পরিচিত। জিরা বা কিউমিন সিড (Cumin seed) আমাদের রান্নাঘরের এক বহুল ব্যবহৃত মসলা। মসলার স্বাদ ও গন্ধ বাড়ানোর পাশাপাশি জিরার রয়েছে বহু প্রাচীনকাল থেকে স্বীকৃত ঔষধি গুণ। আয়ুর্বেদ, ইউনানি কিংবা প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতেও জিরার ব্যবহার দেখা যায়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এখন ধীরে ধীরে প্রমাণ করছে, জিরায় আসলেই এমন কিছু উপাদান আছে যা হজমে সহায়তা করে, শরীরের প্রদাহ কমায় এবং এমনকি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকেও সক্রিয় রাখে। তবে প্রশ্ন হলো—খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া কি আসলেই স্বাস্থ্যকর? নাকি এটি কেবল প্রচলিত কোনো বিশ্বাস মাত্র?

জিরায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এ, ভিটামিন সি, লৌহ, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফাইবার। এগুলো একসঙ্গে শরীরের হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে এবং পেটের গ্যাস, ফাঁপা ভাব বা বদহজমের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। খালি পেটে এক গ্লাস গরম পানিতে জিরা ভিজিয়ে রেখে সকালে সেই পানি পান করলে অনেকেই আরাম বোধ করেন। এতে পেট হালকা লাগে এবং সারা দিনের জন্য শরীরে এক ধরনের সতেজতা কাজ করে।

গবেষকেরা বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের গবেষণা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (NCBI)-তে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, জিরায় উপস্থিত ফাইটো-কেমিক্যাল উপাদানগুলো হজমে সহায়ক এনজাইম সক্রিয় করে তোলে। মার্কিন পুষ্টিবিদ ড. মেরি জেন ব্রাউন এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন—“জিরা খালি পেটে খাওয়া হলে এটি দ্রুত পাকস্থলীতে গিয়ে হজম প্রক্রিয়া সক্রিয় করে এবং খাবার গ্রহণের আগে শরীরকে প্রস্তুত করে তোলে।”

শুধু হজম নয়, জিরা পানি খালি পেটে খাওয়ার আরেকটি বড় উপকার হলো ওজন নিয়ন্ত্রণ। ভারতের দিল্লি ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দেখিয়েছেন, প্রতিদিন সকালে খালি পেটে জিরা পানি খেলে শরীরে ফ্যাট বার্নিং প্রক্রিয়া কিছুটা ত্বরান্বিত হয়। তাদের মতে, জিরায় থাকা সক্রিয় উপাদান থার্মোজেনেসিস প্রক্রিয়াকে উদ্দীপিত করে, যা ক্যালোরি পোড়াতে সাহায্য করে। আর এতে করে ধীরে ধীরে ওজন কমার সুযোগ তৈরি হয়। এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের পুষ্টি গবেষক ড. লরা টেলর বলেন—“জিরা পানি খাবারের আগে খাওয়ার ফলে ক্ষুধা কিছুটা কমে আসে, আর এভাবে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করতে পারে।”

জিরা পানির আরও একটি উপকারিতা হলো শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেওয়া। সকালে খালি পেটে এই পানি খেলে লিভার ও কিডনি সক্রিয় হয়ে শরীরের ভেতরে জমে থাকা ক্ষতিকর উপাদান ধীরে ধীরে বের করে দেয়। এটি মূলত প্রাকৃতিক ডিটক্সিফিকেশনের কাজ করে। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব হেলথ-এর গবেষক ড. জন অ্যান্ডারসন জানিয়েছেন—“নিয়মিত খালি পেটে জিরা পানি পান করলে শরীরে প্রদাহজনিত ঝুঁকি কমে এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত হয়।”

অনেকেই অভিযোগ করেন, সকালে খালি পেটে কিছু খেলেই পেটে অস্বস্তি হয় বা এসিডিটি বেড়ে যায়। তবে জিরা পানি এ ধরনের সমস্যাও কমাতে পারে। কারণ এতে এমন কিছু উপাদান আছে যা পাকস্থলীর এসিডের ভারসাম্য রক্ষা করে। জার্মানির হামবুর্গ ইউনিভার্সিটির গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের গবেষক ড. হেলগা মুলার এ প্রসঙ্গে বলেন—“জিরা পানি পাকস্থলীর অম্লত্ব নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং এসিড রিফ্লাক্স কমাতে কার্যকর হতে পারে।”

তবে সব কিছুর যেমন সুবিধা আছে, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। জিরা পানি সবার জন্য উপযুক্ত নাও হতে পারে। যাদের শরীর অতিরিক্ত দুর্বল বা রক্তচাপ খুব কম, তাদের জন্য নিয়মিত খালি পেটে জিরা পানি পান কখনো কখনো মাথা ঘোরা বা অবসাদ ডেকে আনতে পারে। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জিরা পানি খেলে ডায়রিয়া বা পেট খারাপের সমস্যা দেখা দেয়। তাই বিশেষজ্ঞরা বলেন, অভ্যাস হিসেবে খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া যেতে পারে, তবে তা যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়। প্রতিদিন এক গ্লাসই যথেষ্ট।

এই বিষয়ে কানাডার স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. অ্যালেক্স হেনরি বলেন—“জিরা একটি নিরাপদ প্রাকৃতিক উপাদান হলেও এর অতিরিক্ত সেবন শরীরের জন্য ভালো নয়। যারা জিরা পানি খেতে চান, তারা খালি পেটে এক গ্লাস খেতে পারেন। তবে কোনো রোগে ভুগলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।”

খালি পেটে জিরা পানি খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। কেউ কেউ ওজন কমানোর আশায় এটি খাচ্ছেন, আবার কেউ খাচ্ছেন হজমের সমস্যার সমাধান হিসেবে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি কোনো জাদুকরী ওষুধ নয়, বরং একটি সহায়ক অভ্যাস। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের পাশাপাশি যদি খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া হয়, তবেই এর আসল উপকার মিলবে।

সবশেষে বলা যায়, খালি পেটে জিরা পানি খাওয়া একটি সহজ, প্রাকৃতিক এবং নিরাপদ অভ্যাস হতে পারে। এটি হজম শক্তি বাড়ায়, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখে, শরীর পরিষ্কার করে এবং পেটে অস্বস্তি কমাতে সহায়তা করে। তবে এর ব্যবহার যেন পরিমিত হয়, আর যাদের বিশেষ ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা আছে, তারা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। বিদেশি গবেষকদের মতে, জিরা পানি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে একটি স্বাস্থ্যকর অভ্যাস হিসেবে, তবে একে কখনোই অলৌকিক সমাধান ভাবা উচিত নয়।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

হার্নিয়া সার্জারি নিয়ে কিছু কথা

৬ ঘণ্টা আগে

চলে গেলেন ‘কেজিএফ’-এর ডন দিনেশ মাঙ্গালোর

কন্নড় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির প্রখ্যাত অভিনেতা দিনেশ মাঙ্গালোর আর নেই। ‘কেজিএফ চ্যাপ্টার ১’-এ ডন শেঠির ভূমিকায় অভিনয় করে যিনি দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই জনপ্রিয় অভিনেতা সোমবার (২৫ আগস্ট) ভোররাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৫৫ বছর।

৬ ঘণ্টা আগে

তবুও সন্ধ্যা নামে

সময় প্রতিদিন আসে ঋণদাতার বেশে, ক্যালেন্ডারের পাতায় লিখে যায় তাগিদ: আজও বেঁচে আছ, কালও বাঁচতে হবে— কিন্তু কোথা থেকে আনবে আলো,

১ দিন আগে

স্বর্ণে মরিচা পড়ে না কেন?

সোনা আসলে এক ধরনের ‘নোবেল মেটাল’। নোবেল মেটাল বলতে বোঝায় এমন ধাতু, যা সাধারণ পরিবেশে খুব সহজে অক্সিজেন, পানি বা অ্যাসিডের সঙ্গে প্রতিক্রিয়ায় যায় না। সোনার বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অত্যন্ত স্থিতিশীল। সোনার পরমাণুগুলো এমনভাবে সাজানো যে, বাইরের অক্সিজেন বা আর্দ্রতা সহজে এর সঙ্গে রাসায়নিক বন্ধনে যুক্ত হতে পার

১ দিন আগে