অরুণাভ বিশ্বাস
বাংলার উত্তরাঞ্চলের এক নিসর্গমণ্ডিত গ্রামীণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে সোমপুর বিহার। এটি শুধু ইট আর পাথরের স্থাপত্য নয়, এটি আসলে বাঙালি বৌদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সাক্ষী। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত এই বিহারকে সাধারণ মানুষ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার নামেই বেশি চেনে। একসময় এখানে হাজার হাজার ভিক্ষু, গবেষক, আর তীর্থযাত্রী ভিড় জমাতেন। আজ সেটি দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ, কিন্তু তার ভগ্ন প্রাচীরগুলো এখনও যেন অতীতের মহিমা শোনায়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অষ্টম শতকের শেষ দিকে পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল এই বিশাল বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তখন পাল রাজারা ছিলেন শক্তিশালী এবং তাঁদের শাসনামলকে বলা হয় বাংলার ‘স্বর্ণযুগ’। ধর্মপালের শাসনে বৌদ্ধ ধর্ম, বিশেষত মহাযান মতবাদ, নতুন করে প্রসার লাভ করে। সোমপুর বিহারও তারই প্রতিফলন। বিশাল এই স্থাপত্য কেবল ধর্মীয় কেন্দ্রই ছিল না, এটি ছিল জ্ঞানচর্চারও অন্যতম কেন্দ্র। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি তখনকার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার ছিল।
সোমপুর বিহারের মূল স্থাপনাটি আয়তাকার, যার মাঝখানে আছে একটি বিশাল স্তূপ। চারপাশে ঘিরে রয়েছে ১৭৭টি কক্ষ, যেগুলোতে ভিক্ষুরা থাকতেন। অনেকেই এটিকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠ নয়, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত ও শিল্পকলার শিক্ষা হতো। অর্থাৎ এটি ছিল এক ধরনের বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র।
বিদেশি গবেষকেরা সোমপুর বিহার নিয়ে গভীরভাবে লিখেছেন। বিখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ড. দীপক কুমার চক্রবর্তী বলেছেন—“পাহাড়পুরের স্থাপত্য আমাদের প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবনের আভাস দেয়। এর ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায়, বৌদ্ধ ধর্ম এখানে কেবল আধ্যাত্মিক চর্চা নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।”
আরেকজন গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক জন ম্যাকলেনান উল্লেখ করেছেন—“সোমপুর বিহারের গঠনকৌশল প্রমাণ করে যে পাল রাজারা শুধু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তাঁরা উচ্চমানের স্থাপত্যশিল্পেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ধরনের স্থাপত্য তিব্বত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে প্রভাব ফেলেছিল।”
সোমপুর বিহারকে ঘিরে রয়েছে কিছু কিংবদন্তিও। স্থানীয় লোকজন মনে করে, এখানে দেবতাদের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হতো। আবার অনেকে বলেন, এটি ছিল এমন এক জায়গা, যেখানে দূরদেশের মানুষ এসে শিক্ষা গ্রহণ করত। চীন থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত বলে ধারণা করা হয়।
সোমপুর বিহারের ধ্বংসের ইতিহাসও কম নাটকীয় নয়। তুর্কি আক্রমণকারীরা একসময় এই বিহার ধ্বংস করে দেয়। আগুনে পুড়ে যায় অসংখ্য পুঁথি, শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী এটি হারিয়ে ছিল ধ্বংসাবশেষের আড়ালে। পরে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা উনিশ শতকে এসে এ স্থানকে খনন করেন এবং তখনই প্রকাশ পায় এর মহিমা।
১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো সোমপুর বিহারকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। আজ এটি শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, এটি বিশ্বমানবতার এক ঐতিহাসিক সম্পদ। প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন। ভগ্ন হলেও বিহারের স্থাপত্য এখনও মুগ্ধ করে। ইটের নকশা, প্রাচীরে খোদাই করা বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, আর স্তূপের বিশালতা মানুষকে নিয়ে যায় বহু শতক আগের বৌদ্ধ জগতে।
গবেষকদের মতে, সোমপুর বিহার এক অর্থে নালন্দা ও বিক্রমশীলার বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। ভারতের এই দুটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সোমপুর বিহারের স্থাপত্য আর শিক্ষা পদ্ধতির মিল পাওয়া যায়। তাই অনেকে একে ‘বাংলার নালন্দা’ নামেও অভিহিত করেন।
বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যান্ড্রু হার্ডিং একবার মন্তব্য করেছিলেন—“সোমপুর বিহার আমাদের শেখায়, জ্ঞান আর বিশ্বাস যখন একসাথে চলে, তখনই সৃষ্টি হয় সভ্যতার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য। এই বিহার প্রমাণ করে, মানুষ জ্ঞানের জন্য কত দূর পাড়ি দিতে পারে।”
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সোমপুর বিহার আমাদের জন্য শুধু ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতীক। এর প্রতিটি ইট মনে করিয়ে দেয়, একসময় বাংলাদেশ ছিল এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এই গৌরবকে ধরে রাখা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে জানানো আমাদের দায়িত্ব।
সোমপুর বিহার তাই কেবল ধ্বংসাবশেষ নয়, এটি জীবন্ত ইতিহাস। এর ভগ্নপ্রাচীর আমাদের শেখায়, সভ্যতা ক্ষণস্থায়ী হলেও এর আলো কখনও নিভে যায় না। যে আলো একসময় পাহাড়পুরে জ্বলে উঠেছিল, আজও তা আমাদের পথ দেখায়।
সূত্র: বাংলাপিডিয়া
বাংলার উত্তরাঞ্চলের এক নিসর্গমণ্ডিত গ্রামীণ প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছে সোমপুর বিহার। এটি শুধু ইট আর পাথরের স্থাপত্য নয়, এটি আসলে বাঙালি বৌদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অনন্য সাক্ষী। নওগাঁ জেলার পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত এই বিহারকে সাধারণ মানুষ পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার নামেই বেশি চেনে। একসময় এখানে হাজার হাজার ভিক্ষু, গবেষক, আর তীর্থযাত্রী ভিড় জমাতেন। আজ সেটি দাঁড়িয়ে আছে নিস্তব্ধ, কিন্তু তার ভগ্ন প্রাচীরগুলো এখনও যেন অতীতের মহিমা শোনায়।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, অষ্টম শতকের শেষ দিকে পাল বংশের দ্বিতীয় রাজা ধর্মপাল এই বিশাল বৌদ্ধ বিহারের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তখন পাল রাজারা ছিলেন শক্তিশালী এবং তাঁদের শাসনামলকে বলা হয় বাংলার ‘স্বর্ণযুগ’। ধর্মপালের শাসনে বৌদ্ধ ধর্ম, বিশেষত মহাযান মতবাদ, নতুন করে প্রসার লাভ করে। সোমপুর বিহারও তারই প্রতিফলন। বিশাল এই স্থাপত্য কেবল ধর্মীয় কেন্দ্রই ছিল না, এটি ছিল জ্ঞানচর্চারও অন্যতম কেন্দ্র। ইতিহাসবিদদের মতে, এটি তখনকার সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ বিহার ছিল।
সোমপুর বিহারের মূল স্থাপনাটি আয়তাকার, যার মাঝখানে আছে একটি বিশাল স্তূপ। চারপাশে ঘিরে রয়েছে ১৭৭টি কক্ষ, যেগুলোতে ভিক্ষুরা থাকতেন। অনেকেই এটিকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠ নয়, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত ও শিল্পকলার শিক্ষা হতো। অর্থাৎ এটি ছিল এক ধরনের বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র।
বিদেশি গবেষকেরা সোমপুর বিহার নিয়ে গভীরভাবে লিখেছেন। বিখ্যাত ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ড. দীপক কুমার চক্রবর্তী বলেছেন—“পাহাড়পুরের স্থাপত্য আমাদের প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় জীবনের আভাস দেয়। এর ধ্বংসাবশেষ দেখে বোঝা যায়, বৌদ্ধ ধর্ম এখানে কেবল আধ্যাত্মিক চর্চা নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল।”
আরেকজন গবেষক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক জন ম্যাকলেনান উল্লেখ করেছেন—“সোমপুর বিহারের গঠনকৌশল প্রমাণ করে যে পাল রাজারা শুধু ধর্মের পৃষ্ঠপোষকই ছিলেন না, তাঁরা উচ্চমানের স্থাপত্যশিল্পেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ধরনের স্থাপত্য তিব্বত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তারে প্রভাব ফেলেছিল।”
সোমপুর বিহারকে ঘিরে রয়েছে কিছু কিংবদন্তিও। স্থানীয় লোকজন মনে করে, এখানে দেবতাদের প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হতো। আবার অনেকে বলেন, এটি ছিল এমন এক জায়গা, যেখানে দূরদেশের মানুষ এসে শিক্ষা গ্রহণ করত। চীন থেকে শুরু করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে আসত বলে ধারণা করা হয়।
সোমপুর বিহারের ধ্বংসের ইতিহাসও কম নাটকীয় নয়। তুর্কি আক্রমণকারীরা একসময় এই বিহার ধ্বংস করে দেয়। আগুনে পুড়ে যায় অসংখ্য পুঁথি, শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য। শতাব্দীর পর শতাব্দী এটি হারিয়ে ছিল ধ্বংসাবশেষের আড়ালে। পরে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিকরা উনিশ শতকে এসে এ স্থানকে খনন করেন এবং তখনই প্রকাশ পায় এর মহিমা।
১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো সোমপুর বিহারকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করে। আজ এটি শুধু বাংলাদেশের গর্ব নয়, এটি বিশ্বমানবতার এক ঐতিহাসিক সম্পদ। প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন। ভগ্ন হলেও বিহারের স্থাপত্য এখনও মুগ্ধ করে। ইটের নকশা, প্রাচীরে খোদাই করা বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি, আর স্তূপের বিশালতা মানুষকে নিয়ে যায় বহু শতক আগের বৌদ্ধ জগতে।
গবেষকদের মতে, সোমপুর বিহার এক অর্থে নালন্দা ও বিক্রমশীলার বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে একসূত্রে বাঁধা। ভারতের এই দুটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সোমপুর বিহারের স্থাপত্য আর শিক্ষা পদ্ধতির মিল পাওয়া যায়। তাই অনেকে একে ‘বাংলার নালন্দা’ নামেও অভিহিত করেন।
বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অ্যান্ড্রু হার্ডিং একবার মন্তব্য করেছিলেন—“সোমপুর বিহার আমাদের শেখায়, জ্ঞান আর বিশ্বাস যখন একসাথে চলে, তখনই সৃষ্টি হয় সভ্যতার সর্বোচ্চ সৌন্দর্য। এই বিহার প্রমাণ করে, মানুষ জ্ঞানের জন্য কত দূর পাড়ি দিতে পারে।”
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সোমপুর বিহার আমাদের জন্য শুধু ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতীক। এর প্রতিটি ইট মনে করিয়ে দেয়, একসময় বাংলাদেশ ছিল এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। এই গৌরবকে ধরে রাখা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে জানানো আমাদের দায়িত্ব।
সোমপুর বিহার তাই কেবল ধ্বংসাবশেষ নয়, এটি জীবন্ত ইতিহাস। এর ভগ্নপ্রাচীর আমাদের শেখায়, সভ্যতা ক্ষণস্থায়ী হলেও এর আলো কখনও নিভে যায় না। যে আলো একসময় পাহাড়পুরে জ্বলে উঠেছিল, আজও তা আমাদের পথ দেখায়।
সূত্র: বাংলাপিডিয়া
সারজিস আলম বলেন, এক দিন হইত, দুই দিন হইত কিচ্ছু বলতাম না। তিন দিনের তিন দিনই এটা হইছে। যারা এটা করছে, তারা হচ্ছে রাজনৈতিক... (প্রকাশ অযোগ্য শব্দ)। এই রাজনৈতিক দেউলিয়াদের আমরা দেখে নেব তাদের কলিজা কত বড় হইছে। কলিজা ছিঁড়ে রাস্তায় ফেলে রাখব।
১ দিন আগেনতুন ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, আগামী মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) মানববন্ধন হবে ঢাকাসহ দেশের সব বিভাগীয় শহরে। পরদিন বুধবার (১৫ অক্টোবর) একই কর্মসূচি পালন করা হবে দেশের সব জেলা সদরে।
১ দিন আগে