
স ম গোলাম কিবরিয়া

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বিশ্ব রাজনীতির এক বড় ইতিহাস। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারসহ মার্কিন সামরিক নেতাদের অনেকেই যুদ্ধের ৯ মাস নির্ঘুম কাটান। নানা ফন্দি-ফিকির করেও তারা বাঙালির স্বাধীনতা দমিয়ে রাখতে পারেনি।
চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। অন্যদিকে ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অধিকাংশ দেশ পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নৃশংসতা দেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, সহানুভূতি জানায় এবং সমর্থন জোগায়।
অনেক দেশের বিবেকবান মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। নানা দেশের কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে। মার্কিন জনগণের অনেকেই অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।
যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে রবি শঙ্করের উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। সেই কনসার্টে বব ডিলান, জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, এরিক ক্ল্যাপটনসহ সংগীত জগতের মহাতারকারা বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছেন। কিন্তু ২৮ বছর বয়সী এক ফরাসি তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমান ছিনতাই করে শোরগোল ফেলে দেন বিশ্বজুড়ে। তিনি একাত্ম হয়েছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিমান। বোয়িং–৭২০বি বিমানটির নাম ‘সিটি অব কুমিল্লা’। ১৭ জন যাত্রী ও ছয়জন ক্রু রয়েছে বিমানে। লন্ডন থেকে প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে যাবে করাচি। এর মধ্যে অর্লি বিমানবন্দর থেকে উঠবে পাঁচজন যাত্রী। সেই পাঁচজনের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী ফরাসি যুবক জঁ ক্যা বিমানে উঠে বসলেন।
স্থানীয় সময় তখন বেলা ১১টা ৫০ মিনিট। আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি নিতে পাইলট বিমানটি চালু করেছেন। জঁ ক্যা দাঁড়িয়ে গেলেন। পকেট থেকে পিস্তল বের করে তিনি ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যুহ ফাঁকি দিয়ে পিস্তল নিয়েই তিনি বিমানে উঠেছেন। হুমকি দিয়ে জানালেন— কেউ তার নির্দেশ অমান্য করলে সঙ্গে থাকা বোমা দিয়ে পুরো বিমানবন্দর উড়িয়ে দেবেন।
বিমানের ওয়্যারলেসটি কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জঁ নির্দেশ দিলেন বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দিতে। এসব সামগ্রী নিয়ে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত ও শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এই দাবি নিয়ে কোনো আপস চলবে না।’
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়লেন না। ওই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা মুহূর্তে পুরো ফ্রান্স ছাড়িয়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সসহ বিশ্বের প্রভাবশালী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কিছুক্ষণ পরপর ঘটনার হালনাগাদ সংবাদ দিতে লাগল।
বিশ্বজুড়ে চলা যুদ্ধবিরোধী ও মানবতার পক্ষের আন্দোলনকারীদের কাছে জঁ— বাবরি দোলানো সেই যুবক— রীতিমতো হিরো হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে ফ্রান্সের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা অর্লি বিমানবন্দরে জড়ো হতে লাগলেন। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হলেন।
বিমানটিকে মুক্ত করতে ফরাসি সরকার নতুন এক ফাঁদ পাতল। জঁ ক্যার দাবি অনুযায়ী ওষুধ আনতে ফরাসি রেডক্রসকে খবর দিল। রেডক্রস আরেক ফরাসি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অর্দে দ্য মানতে’র সহায়তায় বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি নিয়ে হাজির হয়।
ওই গাড়ির চালক ও স্বেচ্ছাসেবকের পোশাক পরে বিমানটিতে প্রবেশ করলেন ফরাসি পুলিশের বিশেষ শাখার চারজন সদস্য। তারা ওষুধের বাক্সে পেনিসিলিন রয়েছে বলে সেগুলো বিমানের ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে রাখতে থাকেন। একপর্যায়ে বাক্স নামাতে সহায়তার নাম করে জঁ ক্যার হাতে একটি বাক্স তুলে দেন। এরপরই তার ওপর আক্রমণ শুরু করেন পুলিশের সদস্যরা।
ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রাত ৮টায় জঁ পুলিশের হাতে আটক হন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অর্লি পুলিশ স্টেশনে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে জঁ জানান— ইচ্ছা করেই তিনি ৩ ডিসেম্বর বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। কারণ ওই দিন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ওই বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
আলজেরীয় সৈনিক বাবার একমাত্র সন্তান জঁ ক্যা। মা-বাবা দুজনই প্রয়াত। একাত্তরের জুনের মাঝামাঝি তিনি বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীর হয়ে বিদ্যুৎপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে ইয়েমেনে চাকরি শেষে দেশে ফিরেছেন। যুদ্ধে আহত শিশু ও শরণার্থীদের কষ্ট তাকে তাড়িয়ে বেড়াত।
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু করার পর থেকে জঁ ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল রাখছিলেন। ফরাসি পত্রিকায় বাঙালিদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বর্ণনা তাকে ব্যথিত করত। বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু করার উপায় খুঁজতে গিয়েই বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে তিনি অনুপ্রেরণা পান আন্দ্রে মালরোর বাংলাদেশ নিয়ে লেখা ও বক্তৃতা থেকে।
আন্দ্রে মালরো তার এই ‘খ্যাপাটে অনুরাগী’কে মুক্ত করতে সব চেষ্টা করেন। মালরোর আইনজীবী বন্ধু বিনা পারিশ্রমিকে জঁ ক্যার পক্ষে লড়াইয়ে নামেন। তিনি ছিনতাই হওয়া ওই পাকিস্তানি বিমানের সব যাত্রী ও ক্রুদের সাক্ষ্য নেন। তারা সবাই একবাক্যে বলেন, জঁ ক্যা তাঁদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি, এমনকি কারও দিকে সরাসরি পিস্তল তাক করেননি। তিনি উলটো বলেন, তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত শিশু ও শরণার্থীদের ওষুধ পাঠানোর জন্য বিমানটি ছিনতাই করেছেন— তারা যেন সহযোগিতা করেন।
এরপরও জঁ শেষ রক্ষা পাননি। ফরাসি আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। কারাগারে থাকতেই আন্দ্রে মালরোর নেতৃত্বে ফ্রান্স ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বহু আইনি লড়াইয়ের পর তার শাস্তির মেয়াদ তিন বছর কমানো হয় এবং ১৯৭৩ সালে তিনি মুক্তি পান।
জঁ যখন মুক্ত হলেন, বাংলাদেশ তখন স্বাধীন। এরপর জঁ কোথায় গেলেন, কী করলেন— সে খোঁজ কেউ রাখেনি। জানা যায়, জেল থেকে বের হয়ে তিনি লেবাননে যান। সেখানে নানা সামাজিক অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। এরপর স্পেন, অস্ট্রেলিয়া পেরিয়ে ভারতের দিল্লিতে আসেন। সেখানে এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করেন। দিল্লিতে নানা সামাজিক কাজে জড়িত থাকায় ভারত সরকারের রোষের মুখে পড়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে দরিদ্র ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে মুরগির স্যুপ বিলি করতেন।
ফরাসি পত্রিকার তথ্য অনুসারে, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন জঁ। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি। ১৯৮৫ সালে কলকাতা ত্যাগ করে হিমালয়ের পাদদেশে একটি গুহায় দেড় বছর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কলকাতায় ফিরে বিভিন্ন গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। খবর পেয়ে ভারত সরকার ১৯৮৬ সালে তাকে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়।
ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে জঁ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে একটি নৌকায় সংসার পাতেন। ওই নৌকাতেই তার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি আবারও কোথায় যেন হারিয়ে যান। বহু বছর পর ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জনপ্রিয় দৈনিক লা ফিগারোতে একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়— সামাজিক আন্দোলন কর্মী ও লেখক জঁ ক্যা ৬৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। ২৭ ডিসেম্বর প্যারিসের নিম্নমধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ‘লজে টার্ন-এট-গারোন্নে’তে পারিবারিকভাবে স্মরণসভা হবে।
লা ফিগারো জানায়— বহু দেশে বহু কাজে যুক্ত হলেও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিমান ছিনতাই করা।
জঁ ক্যার তিরোধান— না প্যারিস, না বাংলাদেশ, কেউ স্মরণ রাখেনি। একাত্তরে বিশ্ব কাঁপানো সেই দুঃসাহসীর জীবনের শেষ বছরগুলো কেটেছে একান্ত পারিবারিক পরিসরে। তবে তিনি যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তা বৃথা যায়নি। ৮ ডিসেম্বর, জঁ জেলে থাকা অবস্থাতেই ফরাসি রেডক্রস ও নাইটস হাসপাতাল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও শিশুখাদ্য পাঠায়। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে জনমত তীব্র হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ে। বিস্ময়করভাবে জঁ-এর মৃত্যু হয় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই— দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর।
ফরাসি যুবকের বিমান ছিনতাই-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বাঘা যতীনের নাতি পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও। তিনি ফ্রান্সে বসবাস করতেন এবং লেখক ও গবেষক ছিলেন। জঁ ক্যার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তিনিও গ্রেপ্তার হন।
আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ফরাসি যুবক জঁ ক্যা’র স্মৃতির প্রতি।
তথ্যসূত্র


বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশাল ক্যানভাসে আঁকা বিশ্ব রাজনীতির এক বড় ইতিহাস। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলো পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা কিসিঞ্জারসহ মার্কিন সামরিক নেতাদের অনেকেই যুদ্ধের ৯ মাস নির্ঘুম কাটান। নানা ফন্দি-ফিকির করেও তারা বাঙালির স্বাধীনতা দমিয়ে রাখতে পারেনি।
চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নিলেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। অন্যদিকে ভারত, সোভিয়েত রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্সসহ অধিকাংশ দেশ পাকিস্তানিদের গণহত্যা ও নৃশংসতা দেখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে, সহানুভূতি জানায় এবং সমর্থন জোগায়।
অনেক দেশের বিবেকবান মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহযোগিতা করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। নানা দেশের কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা সোচ্চার হয়েছেন বাংলাদেশের পক্ষে। মার্কিন জনগণের অনেকেই অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন।
যুদ্ধে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে রবি শঙ্করের উদ্যোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। সেই কনসার্টে বব ডিলান, জন লেনন, পল ম্যাককার্টনি, এরিক ক্ল্যাপটনসহ সংগীত জগতের মহাতারকারা বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করেছেন। কিন্তু ২৮ বছর বয়সী এক ফরাসি তরুণ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিমান ছিনতাই করে শোরগোল ফেলে দেন বিশ্বজুড়ে। তিনি একাত্ম হয়েছিলেন আমাদের মুক্তিসংগ্রামে।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) একটি বিমান। বোয়িং–৭২০বি বিমানটির নাম ‘সিটি অব কুমিল্লা’। ১৭ জন যাত্রী ও ছয়জন ক্রু রয়েছে বিমানে। লন্ডন থেকে প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে যাবে করাচি। এর মধ্যে অর্লি বিমানবন্দর থেকে উঠবে পাঁচজন যাত্রী। সেই পাঁচজনের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী ফরাসি যুবক জঁ ক্যা বিমানে উঠে বসলেন।
স্থানীয় সময় তখন বেলা ১১টা ৫০ মিনিট। আকাশে ওড়ার প্রস্তুতি নিতে পাইলট বিমানটি চালু করেছেন। জঁ ক্যা দাঁড়িয়ে গেলেন। পকেট থেকে পিস্তল বের করে তিনি ইঞ্জিন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যুহ ফাঁকি দিয়ে পিস্তল নিয়েই তিনি বিমানে উঠেছেন। হুমকি দিয়ে জানালেন— কেউ তার নির্দেশ অমান্য করলে সঙ্গে থাকা বোমা দিয়ে পুরো বিমানবন্দর উড়িয়ে দেবেন।
বিমানের ওয়্যারলেসটি কেড়ে নিয়ে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে জঁ নির্দেশ দিলেন বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দিতে। এসব সামগ্রী নিয়ে তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত ও শরণার্থীদের কাছে পৌঁছে দেবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এই দাবি নিয়ে কোনো আপস চলবে না।’
দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা ধরে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়লেন না। ওই বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা মুহূর্তে পুরো ফ্রান্স ছাড়িয়ে ইউরোপ হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। ফ্রান্সসহ বিশ্বের প্রভাবশালী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো কিছুক্ষণ পরপর ঘটনার হালনাগাদ সংবাদ দিতে লাগল।
বিশ্বজুড়ে চলা যুদ্ধবিরোধী ও মানবতার পক্ষের আন্দোলনকারীদের কাছে জঁ— বাবরি দোলানো সেই যুবক— রীতিমতো হিরো হয়ে উঠলেন। তার সঙ্গে দেখা করতে ফ্রান্সের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা অর্লি বিমানবন্দরে জড়ো হতে লাগলেন। তাদের কেউ কেউ গ্রেপ্তারও হলেন।
বিমানটিকে মুক্ত করতে ফরাসি সরকার নতুন এক ফাঁদ পাতল। জঁ ক্যার দাবি অনুযায়ী ওষুধ আনতে ফরাসি রেডক্রসকে খবর দিল। রেডক্রস আরেক ফরাসি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অর্দে দ্য মানতে’র সহায়তায় বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি নিয়ে হাজির হয়।
ওই গাড়ির চালক ও স্বেচ্ছাসেবকের পোশাক পরে বিমানটিতে প্রবেশ করলেন ফরাসি পুলিশের বিশেষ শাখার চারজন সদস্য। তারা ওষুধের বাক্সে পেনিসিলিন রয়েছে বলে সেগুলো বিমানের ভেতরের বিভিন্ন জায়গায় সাজিয়ে রাখতে থাকেন। একপর্যায়ে বাক্স নামাতে সহায়তার নাম করে জঁ ক্যার হাতে একটি বাক্স তুলে দেন। এরপরই তার ওপর আক্রমণ শুরু করেন পুলিশের সদস্যরা।
ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে রাত ৮টায় জঁ পুলিশের হাতে আটক হন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অর্লি পুলিশ স্টেশনে। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদে জঁ জানান— ইচ্ছা করেই তিনি ৩ ডিসেম্বর বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। কারণ ওই দিন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট ওই বিমানবন্দরে নেমেছিলেন। নিরাপত্তাকর্মীরা তখন তাকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।
আলজেরীয় সৈনিক বাবার একমাত্র সন্তান জঁ ক্যা। মা-বাবা দুজনই প্রয়াত। একাত্তরের জুনের মাঝামাঝি তিনি বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। তখন তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীর হয়ে বিদ্যুৎপ্রযুক্তিবিদ হিসেবে ইয়েমেনে চাকরি শেষে দেশে ফিরেছেন। যুদ্ধে আহত শিশু ও শরণার্থীদের কষ্ট তাকে তাড়িয়ে বেড়াত।
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর হামলা শুরু করার পর থেকে জঁ ঘটনাপ্রবাহ খেয়াল রাখছিলেন। ফরাসি পত্রিকায় বাঙালিদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের বর্ণনা তাকে ব্যথিত করত। বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কিছু করার উপায় খুঁজতে গিয়েই বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। এ বিষয়ে তিনি অনুপ্রেরণা পান আন্দ্রে মালরোর বাংলাদেশ নিয়ে লেখা ও বক্তৃতা থেকে।
আন্দ্রে মালরো তার এই ‘খ্যাপাটে অনুরাগী’কে মুক্ত করতে সব চেষ্টা করেন। মালরোর আইনজীবী বন্ধু বিনা পারিশ্রমিকে জঁ ক্যার পক্ষে লড়াইয়ে নামেন। তিনি ছিনতাই হওয়া ওই পাকিস্তানি বিমানের সব যাত্রী ও ক্রুদের সাক্ষ্য নেন। তারা সবাই একবাক্যে বলেন, জঁ ক্যা তাঁদের সঙ্গে কোনো খারাপ ব্যবহার করেননি, এমনকি কারও দিকে সরাসরি পিস্তল তাক করেননি। তিনি উলটো বলেন, তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাহত শিশু ও শরণার্থীদের ওষুধ পাঠানোর জন্য বিমানটি ছিনতাই করেছেন— তারা যেন সহযোগিতা করেন।
এরপরও জঁ শেষ রক্ষা পাননি। ফরাসি আদালত তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন। কারাগারে থাকতেই আন্দ্রে মালরোর নেতৃত্বে ফ্রান্স ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বহু আইনি লড়াইয়ের পর তার শাস্তির মেয়াদ তিন বছর কমানো হয় এবং ১৯৭৩ সালে তিনি মুক্তি পান।
জঁ যখন মুক্ত হলেন, বাংলাদেশ তখন স্বাধীন। এরপর জঁ কোথায় গেলেন, কী করলেন— সে খোঁজ কেউ রাখেনি। জানা যায়, জেল থেকে বের হয়ে তিনি লেবাননে যান। সেখানে নানা সামাজিক অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন। এরপর স্পেন, অস্ট্রেলিয়া পেরিয়ে ভারতের দিল্লিতে আসেন। সেখানে এক মার্কিন নারীকে বিয়ে করেন। দিল্লিতে নানা সামাজিক কাজে জড়িত থাকায় ভারত সরকারের রোষের মুখে পড়ে কলকাতায় চলে আসেন। সেখানে দরিদ্র ও বস্তিবাসী শিশুদের জন্য বিনা মূল্যে মুরগির স্যুপ বিলি করতেন।
ফরাসি পত্রিকার তথ্য অনুসারে, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশেও এসেছিলেন জঁ। স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন দেখে ক্ষুব্ধ হন তিনি। ১৯৮৫ সালে কলকাতা ত্যাগ করে হিমালয়ের পাদদেশে একটি গুহায় দেড় বছর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। কলকাতায় ফিরে বিভিন্ন গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে। খবর পেয়ে ভারত সরকার ১৯৮৬ সালে তাকে দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়।
ভারত থেকে বিতাড়িত হয়ে জঁ ক্যারিবিয়ান দ্বীপে একটি নৌকায় সংসার পাতেন। ওই নৌকাতেই তার চতুর্থ সন্তানের জন্ম হয়। এরপর তিনি আবারও কোথায় যেন হারিয়ে যান। বহু বছর পর ২০১২ সালের ২৪ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জনপ্রিয় দৈনিক লা ফিগারোতে একটি বিজ্ঞপ্তি ছাপা হয়— সামাজিক আন্দোলন কর্মী ও লেখক জঁ ক্যা ৬৯ বছর বয়সে মারা গেছেন। ২৭ ডিসেম্বর প্যারিসের নিম্নমধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকা ‘লজে টার্ন-এট-গারোন্নে’তে পারিবারিকভাবে স্মরণসভা হবে।
লা ফিগারো জানায়— বহু দেশে বহু কাজে যুক্ত হলেও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল একাত্তরের ৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিমান ছিনতাই করা।
জঁ ক্যার তিরোধান— না প্যারিস, না বাংলাদেশ, কেউ স্মরণ রাখেনি। একাত্তরে বিশ্ব কাঁপানো সেই দুঃসাহসীর জীবনের শেষ বছরগুলো কেটেছে একান্ত পারিবারিক পরিসরে। তবে তিনি যে ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, তা বৃথা যায়নি। ৮ ডিসেম্বর, জঁ জেলে থাকা অবস্থাতেই ফরাসি রেডক্রস ও নাইটস হাসপাতাল বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ২০ টন ওষুধ ও শিশুখাদ্য পাঠায়। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে জনমত তীব্র হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সাধারণ মানুষের সমর্থন বাড়ে। বিস্ময়করভাবে জঁ-এর মৃত্যু হয় বিজয়ের মাস ডিসেম্বরেই— দিনটি ছিল ২৩ ডিসেম্বর।
ফরাসি যুবকের বিমান ছিনতাই-পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে যুক্ত হয়েছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বাঘা যতীনের নাতি পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ও। তিনি ফ্রান্সে বসবাস করতেন এবং লেখক ও গবেষক ছিলেন। জঁ ক্যার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তিনিও গ্রেপ্তার হন।
আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা ফরাসি যুবক জঁ ক্যা’র স্মৃতির প্রতি।
তথ্যসূত্র


ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। এই অভিনেত্রী ও তার ভাই আলিসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার একটি আদালত। পারিবারিক ব্যবসার পার্টনার হিসেবে রাখার বিনিময়ে ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হুমকি-ধামকি এবং ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১৭ দিন আগে
হত্যাচেষ্টা, মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে সাবেক স্ত্রী রিয়া মনির রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় করা মামালায় জামিন পেয়েছেন আলোচিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম।
১৮ দিন আগে
বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান। ক্যারিয়ারে কোটি কোটি ভক্তের পাশাপাশি নাম-যশ-খ্যাতি কি নেই তার! বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নায়কও বলা হয় তাকে। এবার এই বলিউড সুপারস্টারের নামে দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে একটি আকাশচুম্বী টাওয়ার। এটি নির্মাণ করছে দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট সংস্থা ‘দানিউব’।
১৮ দিন আগে
গ্রেপ্তার হয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও অভিনেতা আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে স্ত্রী রিয়া মনির দায়ের করা মামলায় হাতিরঝিল থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
১৮ দিন আগে