ঢাকায় পুষ্টি সম্মেলনে যত প্রাপ্তি

ডা. মো. ফজলেরাব্বি খান
প্রকাশ: ০৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৫: ১৮

পুষ্টি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান সবার কাছে পৌঁছে দিতে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো পুষ্টি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো গত ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি। দিনব্যাপী সায়েন্টিফিক সেশনে প্রায় এক হাজার সেবা প্রদানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন পুষ্টিবিদ, দেশি-বিদেশি খাদ্য ও পুষ্টিবিষয়ক উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান অংশ নেন।

দুই দিনে ৯টি সেশনে ২৫টি বিষয় নিয়ে ২৪ জন খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ আলোচনা করেছেন। জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেশনে দুই দিনে ছয়টি করে ১২টি বিষয়ে আলোচনা করেছেন দেশের খ্যাতনামা পুষ্টিবিদরা। পুষ্টি সম্পর্কে সাধারণ ভুলগুলো শুধরে নেওয়া ছাড়াও সাধারণ মানুষ জেনেছে পুষ্টি কীভাবে রোগকে প্রতিরোধ করতে পারে। সেশনে স্বাস্থ্যকর রান্নাসহ পুষ্টি সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

ঢাকার শাহবাগে শহিদ আবু সাঈদ আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাডানের প্রেসিডেন্ট ও নিউট্রিশন সামিটের চিফ অ্যাডভাইজার জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধান সমন্বয়ক ডা. মো. ফজলে রাব্বি খান সামিট আয়োজনের যথার্থতা তুলে ধরেন।

বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচকের সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছর বয়সী ২৪ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অন্যদিকে একই বয়সের ১১ শতাংশ শিশু কৃশকায়, অর্থাৎ উচ্চতা অনুযায়ী ওজন কম।

গবেষণার এ তথ্য তুলে ধরে ডা. ফজলে রাব্বি খান বলেন, পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা খুবই কম। কী খাব, কী খাব না কিংবা ওজন-উচ্চতা অনুযায়ী আমাদের দৈনিক কত কিলো ক্যালরি খাবার খাওয়া উচিত— এগুলো আমরা বেশির ভাগ মানুষ জানিই না। খাদ্য ও বিভিন্ন রোগের মধ্যে জটিল সম্পর্কগুলো সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা তো আরও পরের বিষয়। সম্মিলিত একটি যথাযথ উদ্য়োগই পারে এ সমস্য়া থেকে উত্তরণ ঘটাতে।

জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান উদ্বোধনী বক্তব্যে স্বল্প ওজনের পাশাপাশি স্থূলতা বা মুটিয়ে যাওয়ার কারণে সৃষ্ট সমস্যাগুলোর কথা তুলে ধরেন। পাশাপাশি খাদ্যে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। এসবের পেছনে তিনি দায়ী করেন যথাযথ পুষ্টিজ্ঞান না থাকাকে। পুষ্টিবিদদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে এর জন্য আলাদা কাউন্সিল তৈরি এখন সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেন।

Nutrition-Summit-Inaugeration-06-04-2025

ঢাকায় নিউট্রিশন সামিট উদ্বোধন করছেন জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। ফাইল ছবি

সাফিনা রহমানের সভাপতিত্বে সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাডাস মহাসচিব এম সাইফুদ্দীন আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. সাইদুল আরেফিন, বারডেমের প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা শামসুন্নাহার মহুয়া, এফএইচ আই ৩৬০-এর অ্যালাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের কান্ট্রি ম্যানেজার ডা. জেবা মাহমুদ, ঢাবির খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. নাজমা শাহীন এবং বিইউএইচএসের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. জাহিদ হাসান।

সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বাংলাদেশের পুষ্টি খাতকে শক্তিশালী করতে পুষ্টিবিষয়ক অংশীজনদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনে সবার ক্ষমতায়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠক। এতে আলোচনায় অংশ নেন বাডাসের প্রেসিডেন্ট জাতীয় অধ্যাপক এ কে আজাদ খান, নিউট্রিশন সামিটের উপদেষ্টা অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু সাঈদ, আইইডিসিআরের উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মোশতাক হোসেন, নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর সায়কা সিরাজ, আইসিডিডিআরবির পুষ্টি গবেষণা বিভাগের সাবেক সিনিয়র বিজ্ঞানী মো. ইকবাল হোসেন ও পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো।

আলোচনায় আরও অংশ নেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের ওয়ার্কিং গ্রুপ সদস্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সেল, সরকারি ফলিত মানব বিজ্ঞান কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক খাদ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সৈয়দা সালিহা সালেহীন সুলতানা, নিউট্রিশন সলিউশনের উপদেষ্টা ও পাবলিক নিউট্রিশন অ্যান্ড হেলথ কনসালট্যান্ট ডা. মো. মহসিন আলী, এফএইচ আই ৩৬০-এর অ্যালাইভ অ্যান্ড থ্রাইভের কান্ট্রি ম্যানেজার ডা. জেবা মাহমুদ, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিটি নিউট্রিশন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ফারজানা সালেহ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের মহাসচিব আইয়ুব ভূঁইয়া এবং নিউট্রিশন সামিটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. মো. ফজলে রাব্বি খান।

আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে ১০টি প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। এরই মধ্যে এসব প্রস্তাবনা সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবনাগুলো হলো—

  • সর্বজনীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিশ্চিত করতে মূল স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে পুষ্টিব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ের অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনবল নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করে একজন পরিচালক নিয়োগ করে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে;
  • জনসাধারণকে স্বাস্থ্যকর খাবার, সঠিক ক্যালরি পরিমাপ, জাংক ফুডের প্রভাব এবং খাদ্য ও রোগের মধ্যে জটিল সম্পর্ক বিষয়ে সম্য়ক ধারণা দিতে সব পক্ষের সমন্বয়ে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর উদ্য়োগ নিতে হবে। এ ধরনের পুষ্টি কর্মসূচির সক্ষমতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক সংস্থা বা সরকারের অর্থায়ন যুক্ত করা যেতে পারে;
  • পুষ্টির সঙ্গে যুক্ত বর্তমান ও ভবিষ্য়ৎ উদীয়মান পুষ্টিবিজ্ঞানী, পুষ্টিবিদ ও স্বাস্থ্য-পুষ্টি শিক্ষাবিদদের জন্য আধুনিক পুষ্টির হালনাগাদ ও সমন্বিত জ্ঞান, পুষ্টি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এবং স্থানীয় খাদ্য-পুষ্টি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে দেশের পুষ্টি খাতকে আরও প্রাণবন্ত করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী দেশের স্নাতক পর্যায়ে পুষ্টি পাঠ্যক্রমকে ঢেলে সাজাতে হবে;
  • পুষ্টিবিদদের পেশাদার মান বৃদ্ধি ও দক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য মানসম্মত শিক্ষা, নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক অনুশীলনের ব্যবস্থা করে সরকার নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানের (জাতীয় লাইসেন্সিং ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা) মাধ্যমে নিবন্ধন বা স্বীকৃতির দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে, কেবল যোগ্য ও স্বীকৃত ব্যক্তিরাই যেন পুষ্টি পরিষেবা প্রদান করেন এবং সব পরিষেবার জন্য জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়;
  • পুষ্টিবিজ্ঞানী, পুষ্টিবিদ ও পুষ্টি শিক্ষাবিদদের জন্য পেশাদারিত্ব বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করে সংশ্লিষ্টদের জন্য একটি কাঠামোগত কর্মজীবনের পথ বা ধাপ দৃশ্যমান করতে হবে;
  • স্বাস্থ্যকর খাবার ও জাংক ফুড সংস্কৃতির বিস্তার রোধে শিশুকাল থেকেই স্বাস্থ্যকর খাবার ও অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং খাদ্য় বৈচিত্র্য সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এ জন্য স্কুল পাঠ্যক্রমে বয়স অনুযায়ী পুষ্টি বিষয়ক লেখা, প্রবন্ধ বা গল্প অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব শিশুকে দৈনিক একবার হলেও সঠিক পুষ্টিমানের আদর্শ খাদ্য সরবরাহ করতে হবে। সুপরিকল্পিত উপায়ে জাংক ফুডের বিজ্ঞাপনের ব্যপকতা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে;
  • প্রতিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল ও সম্ভব হলে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পুষ্টিবিদ বা স্বাস্থ্য শিক্ষাবিদ পদ তৈরির জন্য সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে হবে। কম ওজন, অতি ওজন বা স্থূল ব্যক্তিদের এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রয়োজন সাপেক্ষে পুষ্টিবিদের কাছে রেফার করার জন্য চিকিৎসকদের উৎসাহিত করতে হবে;
  • বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টির অবস্থা সম্পর্কে একটি নিজস্ব ও গ্রহণযোগ্য তথ্যভাণ্ডার তৈরি করতে হবে যেন মহামারি সংক্রান্ত তথ্য অন্বেষণ করার জন্য বিশ্বাসযোগ্য বৈজ্ঞানিক নকশার ওপর ভিত্তি করে যথাযথ গবেষণা করা যায় এবং গবেষণালব্ধ ফলাফল দ্বারা কৌশলগত নীতি গ্রহণ করা যায়;
  • সাধারণ খাদ্য আউটলেটে প্রতিটি খাদ্য আইটেমের ক্যালরি মান ও অন্যান্য পুষ্টির তথ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। খাদ্য বিপণন প্রবিধানের মাধ্যমে বৈচিত্র্যময়, স্বাস্থ্যকর খাবারের বিকল্পগুলোকে প্রচার করতে হবে, পুষ্টি-সংবেদনশীল সামাজিক নিরাপত্তা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে এবং স্বাস্থ্য, কৃষি ও শিক্ষা জুড়ে আন্তঃক্ষেত্রীয় সমন্বয় জোরদার করতে হবে; এবং
  • সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির ভিত্তিতে এসব প্রস্তাবনার ভিত্তিতে গৃহিত নানা কর্মসূচি নিরীক্ষণ এবং পরিমাপ করার জন্য একটি পুষ্টি তত্ত্বাবধান সংস্থা স্থাপন করে কার্যকর তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করতে হবে।

দেশের প্রথম পুষ্টিবিষয়ক এই সম্মেলনে সার্বিক পুষ্টি পরিস্থিতির চিত্র অনেকটাই এই খাতের অংশীজনদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। সর্বসম্মতিক্রমে সম্মেলন থেকে যে পরামর্শগুলো প্রস্তাব করা হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের পুষ্টির চিত্র ধীরে ধীরে অনেকটাই পালটে দেওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: প্রধান সমন্বয়ক, পুষ্টি সম্মেলন

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

ট্রাম্পকে টেক্কা দিতে পারবেন মাস্ক?

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান— এই দুই দলের বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। তবে মাস্ক বলছেন, বাস্তবে এই দুই দল একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। ‘তারা ভিন্ন পোশাক পরে একসঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে— এটাই ইউনিপার্টি,’— বলেন মাস্ক।

৫ দিন আগে

গণমাধ্যমে নারী-শিশুদের নিয়ে ‘দায়িত্বহীনতা’

বাংলাদেশের গণমাধ্যম অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাঠক-দর্শক আকৃষ্ট করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাংবাদিকতার নীতি পরিপন্থি কাজ করছে।

৬ দিন আগে

মহররমের প্রথম ১০ দিন: ইতিহাস, আমল ও করণীয়

বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর জন্য এই ১০ দিন শুধু আবেগ নয়, আত্মশুদ্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসারও উপলক্ষ্য। ইসলামি ইতিহাসে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যেমন— আশুরা দিবস, তেমনিভাবে ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাত এ মাসকে দিয়েছে অমরতা।

১১ দিন আগে

নীরবেই চলে গেলেন ভাষাবিজ্ঞানী শফিউল আলম

আমি শফিউল আলম স্যারের সরাসরি ছাত্র। আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে এ ভবিষ্যৎবাণী করেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কথাটা সত্য হলো। ২০২৫ সালের ২৪শে জুন তিনি পরলোকে গমন করলেন, অত্যন্ত চুপিসারে, কাউকে না জানিয়ে। ২৩শে জুন দিবাগত রাত ৩টায়—ঘড়ির কাঁটায় তখন ২৪শে জুন শুরু হয়েছে। এ নিয়ে কোনো কাগজে খবর প্রকাশিত হয়নি। আমাদ

১৩ দিন আগে