
শাহরিয়ার শরীফ

রাজনৈতিক হত্যা, হামলা ও সহিংসতার চিরচেনা ছায়া যেন আবারও ফিরে এলো। প্রশ্ন উঠেছে— এ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি আবার সেই পুরনো, ভীতিকর চক্রে ফিরে যাচ্ছি?
জুমার নামাজের পর ঢাকার বিজয়নগরে দিনদুপুরে মোটরসাইকেলে এসে দুর্বৃত্তরা গুলি করল শরিফ ওসমান হাদিকে— যিনি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক, নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে। হামলাকারীরা মিশে গেল মানুষের কাতারে। আর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল প্রতিক্রিয়া, বিতর্ক আর উদ্বেগ।
ওসমান হাদি ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা একজন তরুণ, যিনি মাদরাসায় পড়ালেখা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তবে তার পরিচিতি বাড়তে থাকে জুলাই আন্দোলনের পর।
ডানপন্থি রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া গেলেও ওসমান হাদি নিজেকে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেননি। বরং ৫ আগস্টের পর গড়ে তোলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’— একটি সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম, যা স্বল্প সময়েই বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ভারতবিরোধিতা, আধিপত্যবাদের বিরোধিতা, জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি, জুলাই ঘোষণাপত্র— সব মিলিয়ে তার ভাষ্য ও অবস্থান দ্রুত তাকে আলোচিত করে তোলে।
টকশো, সরাসরি বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদি জনপ্রিয়তা যেমন পান, তেমনি সমালোচনাও পিছু ছাড়েনি। তার ভাষা, স্লোগান ও উপস্থাপনার ধরন অনেকের কাছে ছিল আক্রমণাত্মক; অন্যদিকে তরুণদের অনেকে তাকে দেখেছেন সাহসী ও অনমনীয় কণ্ঠ হিসেবে।
জুলাই আন্দোলনের পর হাদি সক্রিয়ভাবে শাহবাগে বিভিন্ন সমাবেশে নেতৃত্ব দেন— জুলাই শোক স্মরণ, শহিদ ও আহতদের স্বীকৃতির দাবি, সাংবিধানিক সংস্কারের আহ্বান এবং জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের মতো বিষয় সামনে আনেন। ইনকিলাব মঞ্চের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে, আর হাদি হয়ে ওঠেন জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিসরের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। বিতর্কও অবশ্য তার পিছু ছাড়েনি।
হাদি প্রকাশ্যে আরও অনেক কার্যক্রমে যুক্ত হন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন হাদি ও তার সমর্থকরা। গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ওপর হামলা হলে তিনি কিছু অশোভন শব্দও ব্যবহার করেছিলেন, যা নিয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাও ও স্মারকলিপি প্রদান, বঙ্গভবনের সামনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে মাঠ গরম রাখা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন— সবই হাদিকে রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
হাদি সবশেষ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনি প্রচার ও জনসংযোগও শুরু করেছিলেন। প্রচারে তার কৌশলও অদ্ভুত— মসজিদে গিয়ে পরিচয় দেওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চাওয়া— এসব দ্রুত ভাইরাল হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অনুদান সংগ্রহের তথ্য ও প্রচার খরচ প্রকাশ্যে জানাতে থাকেন।
নানা বিতর্কও জড়িয়ে যায় ওসমান হাদির সঙ্গে— মতিঝিলের এ জি বি কলোনিতে তার ওপর ময়লা পানি ছোড়া হয়। ফোনে হুমকি পান তিনি, জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করেন বারবার। পালটা আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে তিনি সমালোচিত হন। জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক উত্তাপে হাদি ক্রমে হয়ে ওঠেন এমন একটি চরিত্র— যাকে ঘিরে কেউ খুশি, কেউ বিভক্ত, কেউ কিছুটা বিভ্রান্ত।
এ প্রেক্ষাপটে বিজয়নগরে হাদির ওপর গুলির ঘটনা নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেল দুই ধরনের তীব্র প্রতিক্রিয়া। একদল বলছে— মানুষ যতই বিতর্কিত হোক, রাজনৈতিক কারণে তার ওপর হামলা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য; তারা হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে।
আরেকদল আবার হাদির ভাষা, কৌশল ও আচরণের কারণে এ ঘটনাকে একটি ‘অনিবার্য ফলাফল’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে। এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর বিভাজন তুলে ধরে। কিন্তু সত্যটি হলো— কেউ যত বিতর্কিতই হোক, কেউ যতই পাল্টা বক্তব্য দিক না কেন, তার ওপর গুলি চালানো কখনোই কোনো রাজনৈতিক বা নৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে না।
রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকতেই পারে, থাকা উচিতও। কিন্তু ভিন্নমতের জবাব যদি গুলি, ছুরি, দাঙ্গা বা হামলা হয়ে আসে— তাহলে আমরা গণতন্ত্রের পথে নই; বরং অন্ধকারের দিকে হাঁটছি।
এর আগে গণসংযোগ চালানোর সময় চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-বায়েজিদ) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও দলের মহানগরের আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। গত ৫ নভেম্বর এ ঘটনায় নিহত হন একজন, আহত আরও দুজন। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে হামলা, গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম ও পাবনার ঘটনা দুটির ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি, অপরাধজগতের বিভেদসহ বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করে হচ্ছে। তবে হাদির ওপর গুলির ঘটনা কী তাহলে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা?
দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছে। তাদের বাইরে রেখে নির্বাচন হলে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণাও এসেছে। এরই অংশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে রাজনীতিবিদদের অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
যেহেতু হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী, সেহেতু ঘুরেফিরে ওই আসনের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বারবার আলোচনায় আসছে। ওই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মির্জা আব্বাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন হাদিকে দেখতে। সেখানে তাকে লক্ষ্য করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেওয়া হয়। একই পরিস্থিতির মুখে পড়েন জামাতের আমির শফিকুর রহমানও।
ঢাকা-৮ আসনে জামায়াত প্রার্থী হিসেবে ড. মো. হেলাল উদ্দিনের নাম ঘোষণা করেছে। তবে এ আসন থেকে ডাকসু ভিপি সাদিক কাইয়ুমের জামায়াতের হয়ে নির্বাচন করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। জামায়াত অবশ্য এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি।
মির্জা আব্বাসের কঠোর সমালোচক হাদি। আবার সাদিক কাইয়ুমকে স্বাগত জানালেও মনের মধ্যে তার কষ্টের ছাপ রয়েছে। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন ও চিন্তা-চেতনায় সাদিক ও হাদি অনেকটাই কাছাকাছি।
আরেক দল এনসিপির প্রথম তালিকায় ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের স্যালুট জানিয়ে আলোচনায় আসা রিকশাচালক মোহাম্মদ সুজন সেখানে মনোনয়ন চান। সবাই মনে করেছিল, তাকে হয়তো ঢাকা-৮ আসনে এনসিপি প্রার্থী হিসেবে দেখা যাবে। তবে সুজন এনসিপির মনোনয়ন পাবেন কিনা, সে টি নিশ্চিত নয়।
সব মিলিয়ে নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ঢাকা-৮ আসন। তবে হাদির ওপর এই হামলার কারণ আসনের ভেতরের না বাইরের, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য এই হামলার মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র দেখছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবো না। আঘাত যাই আসুক, যত ঝড় তুফান আসুক, কোনো শক্তিই আগামী নির্বাচনকে বানচাল করতে পারবে না।’
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন এ ধরনের হামলার ঘটনাকে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিশোধ এখন যেন এক দীর্ঘস্থায়ী চক্রে আটকে গেছে—একপক্ষ আঘাত করে, আরেকপক্ষ পালটা আঘাত করে। ক্রমে এই আঘাত-প্রতিঘাত বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও এখন সাধারণ নাগরিকেরা উদ্বেগের মধ্যে থাকেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অসুস্থ মাকে দেখতে না আসার কারণ হিসেবে সম্প্রতি যা বলেছেন তারও অর্থ দাঁড়ায় নিরাপত্তার প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার দৃষ্টান্ত রয়েছে এই জাতির সামনে।
রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হয়ে ওঠে, তখন বিপদের সীমা আর থাকে না।
যে রাজনীতি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা সম্ভব নয়। রাজনীতি হওয়া উচিত যুক্তির প্রতিযোগিতা, নীতির প্রতিযোগিতা, পরিকল্পনার প্রতিযোগিতা এবং মানুষের সমর্থন অর্জনের প্রতিযোগিতা। কিন্তু যদি রাজনীতির নিয়ম ঠিক করে প্রতিহিংসার দানব তাহলে ক্ষতি সবারই— সাধারণ মানুষের, সামাজিক স্থিতির, রাষ্ট্রীয় স্থাপত্যের। এই দানব দল দেখে না, মতাদর্শ দেখে না, বয়স দেখে না। আজ যার বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে, কাল তার পক্ষেও তা ফিরে আসতে পারে— সহিংসতা কখনো কারো নিজস্ব সম্পদ নয়।
হাদিকে আজ সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেওয়ার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার সুস্থতা কামনা করি। তিনি ফিরলেও কীভাবে ফিরবেন সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন সহিংসতার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা। সহিংসতার আগুন যখন জ্বলে ওঠে, তখন কেউই নিরাপদ থাকে না। আজকের হামলা যদি আমরা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে বসি, তাহলে আগামী দিনের আরও বড় সহিংসতার জন্য পথ তৈরি করে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই। এই আগুনে আমরা সবাই পুড়তে থাকব, আর দেশ ক্রমে ডুবে যাবে বিভাজন ও অস্থিরতার গভীর অতলে।

রাজনৈতিক হত্যা, হামলা ও সহিংসতার চিরচেনা ছায়া যেন আবারও ফিরে এলো। প্রশ্ন উঠেছে— এ রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি আবার সেই পুরনো, ভীতিকর চক্রে ফিরে যাচ্ছি?
জুমার নামাজের পর ঢাকার বিজয়নগরে দিনদুপুরে মোটরসাইকেলে এসে দুর্বৃত্তরা গুলি করল শরিফ ওসমান হাদিকে— যিনি ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক, নিজেকে পরিচয় দিতেন ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে। হামলাকারীরা মিশে গেল মানুষের কাতারে। আর মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ল প্রতিক্রিয়া, বিতর্ক আর উদ্বেগ।
ওসমান হাদি ঝালকাঠির নলছিটি থেকে উঠে আসা একজন তরুণ, যিনি মাদরাসায় পড়ালেখা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তবে তার পরিচিতি বাড়তে থাকে জুলাই আন্দোলনের পর।
ডানপন্থি রাজনীতিতে খুঁজে পাওয়া গেলেও ওসমান হাদি নিজেকে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেননি। বরং ৫ আগস্টের পর গড়ে তোলেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’— একটি সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম, যা স্বল্প সময়েই বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। ভারতবিরোধিতা, আধিপত্যবাদের বিরোধিতা, জুলাই অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি, জুলাই ঘোষণাপত্র— সব মিলিয়ে তার ভাষ্য ও অবস্থান দ্রুত তাকে আলোচিত করে তোলে।
টকশো, সরাসরি বক্তব্য ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাদি জনপ্রিয়তা যেমন পান, তেমনি সমালোচনাও পিছু ছাড়েনি। তার ভাষা, স্লোগান ও উপস্থাপনার ধরন অনেকের কাছে ছিল আক্রমণাত্মক; অন্যদিকে তরুণদের অনেকে তাকে দেখেছেন সাহসী ও অনমনীয় কণ্ঠ হিসেবে।
জুলাই আন্দোলনের পর হাদি সক্রিয়ভাবে শাহবাগে বিভিন্ন সমাবেশে নেতৃত্ব দেন— জুলাই শোক স্মরণ, শহিদ ও আহতদের স্বীকৃতির দাবি, সাংবিধানিক সংস্কারের আহ্বান এবং জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের মতো বিষয় সামনে আনেন। ইনকিলাব মঞ্চের কার্যক্রম ছড়িয়ে পড়ে, আর হাদি হয়ে ওঠেন জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিসরের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা। বিতর্কও অবশ্য তার পিছু ছাড়েনি।
হাদি প্রকাশ্যে আরও অনেক কার্যক্রমে যুক্ত হন। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙায় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন হাদি ও তার সমর্থকরা। গত ১৬ জুলাই গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতাদের ওপর হামলা হলে তিনি কিছু অশোভন শব্দও ব্যবহার করেছিলেন, যা নিয়ে পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
ভারতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশন ঘেরাও ও স্মারকলিপি প্রদান, বঙ্গভবনের সামনে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভে নেতৃত্ব, আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের দাবিতে মাঠ গরম রাখা, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠনের প্রতি প্রকাশ্য সমর্থন— সবই হাদিকে রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
হাদি সবশেষ ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনি প্রচার ও জনসংযোগও শুরু করেছিলেন। প্রচারে তার কৌশলও অদ্ভুত— মসজিদে গিয়ে পরিচয় দেওয়া, বাতাসা-মুড়ি নিয়ে প্রচার, দরজায় দরজায় গিয়ে ভোট চাওয়া— এসব দ্রুত ভাইরাল হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অনুদান সংগ্রহের তথ্য ও প্রচার খরচ প্রকাশ্যে জানাতে থাকেন।
নানা বিতর্কও জড়িয়ে যায় ওসমান হাদির সঙ্গে— মতিঝিলের এ জি বি কলোনিতে তার ওপর ময়লা পানি ছোড়া হয়। ফোনে হুমকি পান তিনি, জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করেন বারবার। পালটা আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করে তিনি সমালোচিত হন। জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক উত্তাপে হাদি ক্রমে হয়ে ওঠেন এমন একটি চরিত্র— যাকে ঘিরে কেউ খুশি, কেউ বিভক্ত, কেউ কিছুটা বিভ্রান্ত।
এ প্রেক্ষাপটে বিজয়নগরে হাদির ওপর গুলির ঘটনা নতুন করে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেল দুই ধরনের তীব্র প্রতিক্রিয়া। একদল বলছে— মানুষ যতই বিতর্কিত হোক, রাজনৈতিক কারণে তার ওপর হামলা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য; তারা হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে।
আরেকদল আবার হাদির ভাষা, কৌশল ও আচরণের কারণে এ ঘটনাকে একটি ‘অনিবার্য ফলাফল’ হিসেবে দেখার চেষ্টা করছে। এই দুই ধরনের প্রতিক্রিয়াই বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার গভীর বিভাজন তুলে ধরে। কিন্তু সত্যটি হলো— কেউ যত বিতর্কিতই হোক, কেউ যতই পাল্টা বক্তব্য দিক না কেন, তার ওপর গুলি চালানো কখনোই কোনো রাজনৈতিক বা নৈতিক প্রতিক্রিয়া হতে পারে না।
রাজনীতিতে ভিন্নমত থাকতেই পারে, থাকা উচিতও। কিন্তু ভিন্নমতের জবাব যদি গুলি, ছুরি, দাঙ্গা বা হামলা হয়ে আসে— তাহলে আমরা গণতন্ত্রের পথে নই; বরং অন্ধকারের দিকে হাঁটছি।
এর আগে গণসংযোগ চালানোর সময় চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-বায়েজিদ) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও দলের মহানগরের আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। গত ৫ নভেম্বর এ ঘটনায় নিহত হন একজন, আহত আরও দুজন। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীর অনুসারীদের মধ্যে হামলা, গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম ও পাবনার ঘটনা দুটির ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি, অপরাধজগতের বিভেদসহ বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করে হচ্ছে। তবে হাদির ওপর গুলির ঘটনা কী তাহলে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা?
দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছে। তাদের বাইরে রেখে নির্বাচন হলে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণাও এসেছে। এরই অংশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে বলে রাজনীতিবিদদের অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। এমনকি তারা নিজেদের নিরাপত্তা নিয়েও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
যেহেতু হাদি ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী, সেহেতু ঘুরেফিরে ওই আসনের নির্বাচনের প্রেক্ষাপট বারবার আলোচনায় আসছে। ওই আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মির্জা আব্বাস ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন হাদিকে দেখতে। সেখানে তাকে লক্ষ্য করে ভুয়া ভুয়া স্লোগান দেওয়া হয়। একই পরিস্থিতির মুখে পড়েন জামাতের আমির শফিকুর রহমানও।
ঢাকা-৮ আসনে জামায়াত প্রার্থী হিসেবে ড. মো. হেলাল উদ্দিনের নাম ঘোষণা করেছে। তবে এ আসন থেকে ডাকসু ভিপি সাদিক কাইয়ুমের জামায়াতের হয়ে নির্বাচন করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। জামায়াত অবশ্য এখন পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়নি।
মির্জা আব্বাসের কঠোর সমালোচক হাদি। আবার সাদিক কাইয়ুমকে স্বাগত জানালেও মনের মধ্যে তার কষ্টের ছাপ রয়েছে। আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলন ও চিন্তা-চেতনায় সাদিক ও হাদি অনেকটাই কাছাকাছি।
আরেক দল এনসিপির প্রথম তালিকায় ঢাকা-৮ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি। কোটাবিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের স্যালুট জানিয়ে আলোচনায় আসা রিকশাচালক মোহাম্মদ সুজন সেখানে মনোনয়ন চান। সবাই মনে করেছিল, তাকে হয়তো ঢাকা-৮ আসনে এনসিপি প্রার্থী হিসেবে দেখা যাবে। তবে সুজন এনসিপির মনোনয়ন পাবেন কিনা, সে টি নিশ্চিত নয়।
সব মিলিয়ে নানা কারণে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে ঢাকা-৮ আসন। তবে হাদির ওপর এই হামলার কারণ আসনের ভেতরের না বাইরের, তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
সরকার ও রাজনৈতিক নেতারা অবশ্য এই হামলার মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোটকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র দেখছেন। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আমরা কোনো অবস্থাতেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র সফল হতে দেবো না। আঘাত যাই আসুক, যত ঝড় তুফান আসুক, কোনো শক্তিই আগামী নির্বাচনকে বানচাল করতে পারবে না।’
জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন এ ধরনের হামলার ঘটনাকে নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র বলে মনে করছে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিশোধ এখন যেন এক দীর্ঘস্থায়ী চক্রে আটকে গেছে—একপক্ষ আঘাত করে, আরেকপক্ষ পালটা আঘাত করে। ক্রমে এই আঘাত-প্রতিঘাত বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছে যে রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও এখন সাধারণ নাগরিকেরা উদ্বেগের মধ্যে থাকেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অসুস্থ মাকে দেখতে না আসার কারণ হিসেবে সম্প্রতি যা বলেছেন তারও অর্থ দাঁড়ায় নিরাপত্তার প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মরহুম জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার দৃষ্টান্ত রয়েছে এই জাতির সামনে।
রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হয়ে ওঠে, তখন বিপদের সীমা আর থাকে না।
যে রাজনীতি মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারে না, সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা সম্ভব নয়। রাজনীতি হওয়া উচিত যুক্তির প্রতিযোগিতা, নীতির প্রতিযোগিতা, পরিকল্পনার প্রতিযোগিতা এবং মানুষের সমর্থন অর্জনের প্রতিযোগিতা। কিন্তু যদি রাজনীতির নিয়ম ঠিক করে প্রতিহিংসার দানব তাহলে ক্ষতি সবারই— সাধারণ মানুষের, সামাজিক স্থিতির, রাষ্ট্রীয় স্থাপত্যের। এই দানব দল দেখে না, মতাদর্শ দেখে না, বয়স দেখে না। আজ যার বিরুদ্ধে ব্যবহার হচ্ছে, কাল তার পক্ষেও তা ফিরে আসতে পারে— সহিংসতা কখনো কারো নিজস্ব সম্পদ নয়।
হাদিকে আজ সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর নেওয়ার কথা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তার সুস্থতা কামনা করি। তিনি ফিরলেও কীভাবে ফিরবেন সেটি এখন বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন সহিংসতার রাজনীতি থেকে বের হয়ে আসা। সহিংসতার আগুন যখন জ্বলে ওঠে, তখন কেউই নিরাপদ থাকে না। আজকের হামলা যদি আমরা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে বসি, তাহলে আগামী দিনের আরও বড় সহিংসতার জন্য পথ তৈরি করে দিচ্ছি আমরা নিজেরাই। এই আগুনে আমরা সবাই পুড়তে থাকব, আর দেশ ক্রমে ডুবে যাবে বিভাজন ও অস্থিরতার গভীর অতলে।

এখানে সরকারের ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব আছে। তার মন্তব্যের কারণ কী, সেটি সরকার জানতে চাইতে পারে এবং পরিষ্কার করতে পারে। কারণ এর বাইরে অন্য কোনো বিশেষ জটিলতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
১৫ দিন আগে
দীর্ঘ সময় ধরে তারেক রহমান দেশের বাইরে। এটি এখন বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। তৃণমূলের বহু নেতাকর্মী বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। সত্যি বলতে, তিনি দেশে ফিরলে দল অবশ্যই নতুন উদ্দীপনা পাবে। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতেও দলের সাংগঠনিক কাজ থেমে নেই— এটাই গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
১৫ দিন আগে
ওয়ান-ইলেভেনের সময় যেসব শক্তি তাকে গ্রেপ্তার করেছিল এবং নির্যাতন করেছিল, তাদের সঙ্গে সেই পুরনো বিরোধ এখনো পুরোপুরি মিটেনি। সেই সময়ের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা এতে জড়িত ছিলেন, তাদের একটি অংশ আজও ‘সম্মতি’ দিচ্ছেন না— এমন ধারণা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাদের হয়তো নিজেদের কিছু স্বার্থ বা অবস্থান রয়ে
১৫ দিন আগে