তারেক রহমানের হাত ধরেই কি জিয়ার রাজনৈতিক দর্শনের পুনরুত্থান?

আখতারুল ইসলাম
আপডেট : ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ২০: ০৪

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে দর্শনভিত্তিক রাজনীতির প্রবক্তা। তিনি তার সাড়ে চার বছরের শাসনামলে রাজনৈতিক দর্শনের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা বাংলাদেশের আর কোন শাসকের কাছ থেকে পাওয়া সম্ভব হয়নি। জিয়া মনে করতেন, ‘প্রত্যেকটি দলের অবশ্যই রাজনৈতিক দর্শন থাকা উচিত। যাদের দর্শন ভালো লাগবে, জনগণ তাদের কাছেই যাবে। আর এই দর্শনের মূল বিন্দু হবে জনগণ।’

জিয়া আরও মনে করতেন, দর্শন বা নীতি অপরিবর্তনীয় হলে হবে না। সময়ের সঙ্গে ও প্রয়োজন সাপেক্ষে তা পরিবর্তন করতে হবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় উত্তর-কাঠামোবাদ নামে পরিচিত। তিনি মার্কসবাদ ও লেনিনবাদকে ব্যর্থ দর্শন বলে পরিগণিত করেছেন। কারণ মার্কসবাদ-লেনিনবাদ অপরিবর্তনশীল, যে কারণে এই দর্শন সফল হওয়ার সাম্ভাবনা নেই। তার বিশ্বাস ছিল, কোনো দর্শন তখনই সফল হতে পারে যখন তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও জনগণের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হতে পারে।

জিয়াউর রহমান উদার গণতন্ত্রের কথা বলেছেন। তিনি যখন ক্ষমতা নেন, তখন দেশে দৈনিক পত্রিকা ছিল মাত্র চারটি, রাজনৈতিক দল ছিল একমাত্র বাকশাল। তার শাসনামলে পত্রিকার সংখ্যা উন্নীত হয় ৪৪৪টিতে, রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২টি। তিনি সবাইকে তাদের দর্শন প্রচার করার সুযোগ দিতেন। আর বিচার করার ক্ষমতা দিয়েছিলেন জনগণের হাতে, যা উদার গণতন্ত্রের পরিচয় বহন করে।

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদেরও প্রবক্তা। এর ভিত্তি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন জাতিগত চেতনা, ভাষার ঐতিহ্য, ধর্মীয় অধিকার, আঞ্চলিকতাবোধ, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও সংগ্রামের উন্মাদনা।

স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতেও বিশ্বাস করতেন বিএনপির এই প্রতিষ্ঠাতা। তিনি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জন্য কিছু পূর্বশর্ত নির্ধারণ করেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে— ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, জণগণের ধর্ম, আঞ্চলিক অবস্থান, অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, পরাশক্তি ও তাদের নীতি, আমাদের ওপর পরাশক্তির হস্তক্ষেপের পরিধি। জিয়াউর রহমানের দর্শন ছিল— এসব ফ্যাক্টরে যদি আমরা ৫০ শতাংশের বেশি স্বাধীন থাকি তাহলেই কেবল আমরা স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে পারব।

জিয়াউর রহমান পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ‘এক্কাদোক্কা গেম পলিসি’ অনুসরণ করতেন। এক্কাদোক্কা খেলায় যেমন খুব সাবধানে, সতর্কতার সঙ্গে পা না ফেলে দাড়ি মাড়ালেই খেলা শেষ হয়ে যায়, তেমনি পররাষ্ট্রনীতিতেও খুব সাবধানে ও সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলার নীতিতে বিশ্বাস করতেন তিনি। লক্ষ্য ছিল— দেশের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। অর্থাৎ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সতর্ক থেকে বিপদমুক্ত নীতিতে যেমন পা ফেলতে হবে, তেমনি দেশের কল্যাণ-দশের কল্যাণও নিশ্চিত করতে হবে।

জিয়াউর রহমান দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের জনগোষ্ঠীর জন্যও নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন। খাল খনন কর্মসূচি, কৃষিতে নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ, গণশিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন, পোশাক শিল্পের সূচনা, বিদেশে শ্রমিক রপ্তানির মতো উদ্যোগের পত্তন হয় তার হাত ধরেই।

নারীর ক্ষমতায়নেও জিয়াউর রহমানের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। স্বনির্ভর গ্রাম সরকারে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করলে তিনি বিরোধিতাকারীদের দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ‘অর্ধেক মানুষকে ঘরে বসিয়ে রেখে দেশের উন্নয়ন সম্ভব না।’ বহু বিরোধিতা উপেক্ষা করেই তিনি মূল কাঠামোয় নারীদের অন্তর্ভুক্ত করতে শুরু করেন।

রাজনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ, বহুত্ববাদ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নিরলস চেষ্টা করে গেছেন জিয়াউর রহমান। বিশ্বাসের স্বাধীনতার সঙ্গে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করাসহ তার সব রাজনৈতিক দর্শন তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে গঠন করেছিলেন রাজনৈতিক প্রশিক্ষণকেন্দ্র। তরুণদের নেতৃত্বে নিয়ে আসা ও তরুণ নেতৃত্বে আস্থা স্থাপনের জন্য ‘ট্রাস্ট ইন ইয়ুথ’ নীতি প্রণয়ন করেছিলেন। দুঃখের বিষয়, এসব সম্ভাবনাময় দর্শনের অকালমৃত্যু ঘটে তার শাহাদাতবরণের মধ্য দিয়ে।

আশা জাগানিয়া বিষয়— এত বছর পর তার এসব সম্ভাবনাময় দর্শনের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা জেগেছে, সেটি তারই বড় ছেলে তারেক রহমানের হাত ধরে। পদবিতে মা খালেদা জিয়া বিএনপি চেয়ারপারসন হলেও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায় কার্যত বিএনপির প্রধান তারেক রহমানই। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে দেশের বাইরে তিনি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের প্রায় দেড় বছর পর দলীয় লাখো নেতাকর্মীর সংবর্ধনায় সিক্ত হয়ে দেশে ফিরেছেন তিনি।

কিন্তু কেন বলছি তারেক রহমানের হাত ধরে তার বাবা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন পুনরুত্থানের সম্ভাবনার কথা? গত কয়েক বছরে তারেক রহমান দলীয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, সেসব বক্তব্যের মধ্যে মিলবে এর জবাব।

তারেক রহমান বিভিন্ন সময় বিচ্ছিন্নভাবে দেশকে নিয়ে নানা রাজনৈতিক পরিকল্পনার কথা তুলে ধরলেও ২০২৩ সালের জুলাইয়ে সেসব পরিকল্পনাকে কাঠামোবদ্ধ করে বিএনপি। ঘোষণা করা হয় রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের জন্য ৩১ দফা। সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন, রাষ্ট্রক্ষমতায় ভারসাম্য, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, প্রশাসনিক সংস্কারসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, প্রযুক্তি, পরিবেশ, তারুণ্য, নারী— সবকিছুই স্থান পেয়েছে এই ৩১ দফায়।

তারেক রহমানের এই ৩১ দফার মূল যে ভিত্তি, সেটি হলো ১৯ দফা, যেটি ক্ষমতায় আসার পর দেশ গড়ার জন্য ঘোষণা করেছিলেন জিয়াউর রহমান। এর সঙ্গে খালেদা জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’-এর আলোকেই তারেক রহমান প্রণয়ন করেন ৩১ দফা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বলে থাকেন, জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শনের প্রতিফলন ছিল যে ১৯ দফা, তার প্রতিফলন রয়েছে তারেক রহমানের ৩১ দফাতেও।

কেবল এই রাষ্ট্রকাঠামোর ঘোষণা নয়, তারেক রহমানের বক্তব্য-কাজ-আচরণেও জিয়াউর রহমানের দর্শনের প্রতিফলন রয়েছে। এর প্রমাণ মিলেছে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রথম ভাষণেও। প্রায় ১৬ মিনিট বক্তৃতা করেছেন তিনি। সেখানে দলের প্রসঙ্গ এসেছে, নেতাকর্মীদের প্রসঙ্গ এসেছে। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি এসেছে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা, সাধারণ মানুষের কথা।

তারেক রহমানের প্রথম যে ভাষণ, সেখানে কাউকে আক্রমণ করেননি, দোষারোপ করেননি, কোনো অপ্রয়োজনীয় কথা বা প্রসঙ্গই টানেননি। বরং পাহাড় থেকে সমতল, চিকিৎসক থেকে দিনমজুর, একাত্তর থেকে চব্বিশের বীর শহিদ— সবার কথা উঠে এসেছে তার ভাষণে। বারবারই বলেছেন দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা, কোনো ধরনের উসকানিতে পা না দিয়ে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার কথা। স্পষ্ট ভাষায় বললেন, দেশ ও দেশের মানুষকে এগিয়ে নিতে ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান।’ সে ‘প্ল্যান’ও একা বাস্তবায়ন করতে চাইলেন না, বরং তা বাস্তবায়নে চাইলেন নিজের দলসহ সব গণতান্ত্রিক শক্তির সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিশেষ করে তারুণ্যের শক্তির সহায়তা।

প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানও নিজের রাজনৈতিক দর্শক ১৯ দফা নিয়ে ‘প্ল্যান’ করেছিলেন দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। স্বপ্ন দেখেছিলেন অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী ও বিশ্ব দরবারে মর্যাদাসম্পন্ন একটি রাষ্ট্রের, যেখানে দলমত, শ্রেণিপেশা, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই সুখেশান্তিতে বসবাস করতে পারবে। তার সেই রাজনৈতিক দর্শন আর পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশ, জনতা।

৩১ দফা আর ১৭ বছর পর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণে বাবার সেই রাজনৈতিক দর্শন, পরিকল্পনা আর স্বপ্নের স্মৃতিই ফিরিয়ে এনেছেন তারেক রহমান। জনরায়ের মাধ্যমে সুযোগ পেলে সেই স্মৃতিকে তিনি বাস্তবে পরিণত করতে পারবেন কি না, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরও কয়েক বছর। এখনকার জন্য কেবল তারেক রহমানের কাছে প্রত্যাশা— যে সম্ভাবনার ঝিলিক তিনি দেখিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন হোক তার হাত ধরেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১০ দিন আগে

সহিংসতার রাজনীতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?

রাজনৈতিক সহিংসতার চক্র যত বড় হয়, ততই সংকুচিত হয় নাগরিকদের নিরাপত্তা, গণতান্ত্রিক অধিকার, ভিন্নমতের পরিসর এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। সামাজিক আস্থাও ক্ষয়ে যায়। আজ একজন হাদি আক্রান্ত,আগামীকাল কে বা কারা টার্গেট হবেন তা কেউ জানে না। সহিংসতা যখন ধীরে ধীরে রাজনৈতিক কৌশলে পরিণত হয়, ‘ব্যবহারযোগ্য হাতিয়ার’ হ

১০ দিন আগে

অস্তিত্ব সংকটে শিক্ষা ক্যাডার ও উচ্চশিক্ষা

আজ যদি ঢাকা সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটির দাবি মেনে এই মডেলে বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করা হয়, তবে খুব দ্রুতই জেলা পর্যায়েও একই দাবি উঠবে। টাঙ্গাইল সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি, ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি কিংবা রাজশাহী কলেজ, বিএম কলেজ, সিলেটের এমসি কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি আসবে।

১৭ দিন আগে

ভারতকে ছাড়াই নতুন দক্ষিণ এশীয় জোটের পরিকল্পনা পাকিস্তানের, আদৌ সফল হবে?

মূলত এটি দক্ষিণ এশিয়াকে ঘিরে চীনকে যুক্ত করে একটি বিকল্প আঞ্চলিক জোট গঠনের প্রস্তাব, যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান আঞ্চলিক সংগঠন সার্ক গত বহু বছর ধরেই ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে কার্যত অচল হয়ে রয়েছে।

২০ দিন আগে