কোডিং ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিখিত পরীক্ষার মূল্যায়ন: একটি বিশ্লেষণ

ড. আবিদুর রহমান

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা দিয়েছে, তারা কোডিং পদ্ধতিতে লিখিত পরীক্ষা নেবে। এর আগে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) কোডিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে একাডেমিয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। তাই এর আলাপ ও বিশ্লেষণ প্রাসঙ্গিক মনে করছি।

প্রচলিত পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরা নাম ও রোল নম্বর বা রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখে থাকেন। ফলে যিনি খাতা মূল্যায়ন করছেন, তিনি বুঝতে পারেন বা চিনতে পারেন কোন শিক্ষার্থীর খাতা দেখছেন।

পরীক্ষকের কাছে পরীক্ষার্থীর নাম-পরিচয় অপ্রকাশিত রাখতেই ব্যবহার করা হয় কোডিং পদ্ধতি, যেখানে পরীক্ষার্থীর নাম বা রোল নম্বর কিছুই থাকবে না। এর পরিবর্তে খাতায় থাকবে কয়েকটি সংখ্যার একটি ডিজিট। এতে মূল্যায়নকারী চট করে বুঝতে পারবেন না কার খাতা কাটছেন। এটি অনেকটা জার্নালে পাবলিকেশন প্রসেসের ‘ব্লাইন্ড রিভিউ’ বা ‘অন্ধ মূল্যায়নে’র অনুরূপ।

আপাতদৃষ্টিতে এ পদ্ধতিতে বেশ ভালো মনে হয়। কারণ শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করার কোনো সুযোগ না থাকায় পরীক্ষকের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় কিংবা ধর্মীয়, রাজনৈতিক, লৈঙ্গিক বা আঞ্চলিক পরিচয়সহ কোনোভাবেই পক্ষপাত করার সুযোগ থাকার কথা না। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা নির্মোহভাবেই খাতার মূল্যায়ন করেন। তা সত্ত্বেও যেকোনো ধরনের পক্ষপাতের শঙ্কা দূর করতেই এ পদ্ধতির প্রচলন।

তবে জগতের সব নতুন সম্ভাবনাই একই সঙ্গে নতুন সংকট ও নিয়ে আসে! কোডিং পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নও ব্যতিক্রম নয়। এ পদ্ধতিতেও তাই কিছু আপত্তির কারণ থাকতে পারে।

কোডিং পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সংকট হলো ‘ফিলোসফিক্যাল’ বা দার্শনিক! আপনি আপনার কলিগ বা শিক্ষককে বিশ্বাস করছেন না। শিক্ষার্থী তার গুরুকে আস্থায় রাখছেন না। এটি বিশ্বাসের সংকটকে প্রবল করবে।

যিনি কোর্স পড়াবেন, তিনিই সবচেয়ে ভালোভাবে প্রশ্ন করতে পারেন। এটিই স্বাভাবিক ও যৌক্তিক যে তার মূল্যায়নই যথাযথ হওয়ার কথা। তাছাড়া যে শিক্ষক কোর্স পড়াবেন, মূল্যায়নে তাকে অনাস্থায় রাখলে তার ফল শুভ হবে কি?

আজ থেকে শত বছর আগে ব্রিটিশরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল্যায়নের যে প্রক্রিয়া চালু করে গেছে, বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় তা এখনো আঁকড়ে ধরে আছে। এখনো প্রথম পরীক্ষক ও দ্বিতীয় পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন করেন। এ দুজনের দেওয়া নম্বরের ব্যবধান ২০ শতাংশের বেশি হলে উত্তরপত্র চলে যায় তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে।

কোডিং প্রক্রিয়ায় উত্তরপত্র মূল্যায়নের একটি বড় আপত্তির জায়গা হতে পারে, এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীর আর আপিল করার সুযোগ নেই। অথচ কেবল ব্রিটিশরা নয়, সারা দুনিয়াতে কোথাও এমন নিয়ম আর চালু নেই। এমনকি বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও এগুলোর চর্চা নেই।

আফসোসের বিষয়, আমরা এখনো শতাব্দী প্রাচীন সেকেলে পদ্ধতিতে পড়ে আছি। ফলে পরীক্ষা আয়োজন, সমাপন ও মূল্যায়নে অধিক সময় ও জটিলতা বাড়ছে।

এখানেই শেষ নয়, কোডিং পদ্ধতিতে কেবল লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর বাইরে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশন, মৌখিক পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষার কোনোটিতেই কোডিং বা ছদ্মবেশ নেওয়ার কোনো উপায় নেই!

তাহলে একই বিভাগের একই শিক্ষকদের দিয়ে আংশিক কোডিং ও আংশিক ডিকোডিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে রাখার ফল শুভ হবে কি? ফলে কোর্স শিক্ষকই পড়ানোর পাশাপাশি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন এবং শিক্ষার্থীদেরও উত্তরপত্র নিয়ে আপিলের সুযোগ থাকা উচিত বলেই অভিমত আসছে।

নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (নোবিপ্রবি) দুটি বিভাগে কোডিং পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। তবে এ নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কারণ এ পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে রোল নম্বরের পরিবর্তে উত্তরপত্রে কেবল সফটওয়্যার জেনারেটেড ৮ সংখ্যার একটি কোড বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অনেকেই মনে করছেন, কোডিং পদ্ধতিতে মূল্যায়নের জন্য এটি যথাযথ পদ্ধতি নয়। কারণ একই সেমিস্টারের সব পরীক্ষায় একই শিক্ষার্থী একই কোডে পরীক্ষা দিচ্ছেন। আগের পদ্ধতির সঙ্গে পার্থক্য বলতে কেবল রোল নম্বরের পরিবর্তে উত্তরপত্রে বসছে একটি সংখ্যা।

শিক্ষার্থী যদি জেনে যান যে তার কোড নম্বর কী, পরীক্ষকও যদি জেনে যান যে কোন কোডের বিপরীতে কোন শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিচ্ছে, তাহলে এ পদ্ধতির নাম আর যাই হোক, কোডিং নয়। তাহলে কোডিং পদ্ধতিতে যদি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতেই হয়, তাহলে সমাধান কী?

প্রকৃত কোডিং করতে হলে শিক্ষার্থী জানবেন না তার কোড নম্বরটি কী, জানবেন না শিক্ষকও। ফলে এটি বাস্তবায়ন করতে হলে তৃতীয় কোনো পক্ষকে যুক্ত করতেই হবে। সেই তৃতীয় পক্ষ হতে পারে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর বা ডিন অফিস বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মনোনীত অন্য কেউ। এর অর্থ, তৃতীয় কোনো পক্ষের ওপর ‘আস্থা’ রাখতেই হবে যে পক্ষটি জানবে কোন পরীক্ষার কোড নম্বরটি কত।

পরিহাস এই, শিক্ষাগুরুর মূল্যায়ন প্রক্রিয়াকে সংশয়ে নিয়ে যে কোডিংয়ে আমরা আস্থা রাখতে চাচ্ছি, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চায়নে আবার ‘আস্থা’য় নিতে হচ্ছে তৃতীয় কোনো পক্ষকেই! এভাবে আমাদের অবিশ্বাস বিশ্বাস হয়ে বারেবারে আমাদের কাছেই ফিরে আসছে।

এ ক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে কম্পিউটার সফটওয়্যারের মাধ্যমে উত্তরপত্রে রোল নম্বরের বিপরীতে বারকোড সংযুক্ত করা। সন্দেহ নেই, এতে পরীক্ষা আয়োজন ও মূল্যায়নে ব্যয় বাড়বে। ফলাফল মূল্যায়নে আগের চেয়ে বেশি সময়ও লাগবে। কোডিং ও ডিকোডিং প্রক্রিয়া ও ব্যবস্থাপনায় বাড়তি খরচও যুক্ত হবে।

পরিশেষে বলব, বিচারকের ওপর আস্থা না থাকলে পুরো বিচারব্যবস্থার ওপর যেমন বিশ্বাস গড়ে ওঠে না, একইভাবে শিক্ষককে অবিশ্বাস করে যে মূল্যায়নব্যবস্থা আমরা চিন্তা করছি সেটিও হয়তো টেকসই হবে না। তাই ঢালাওভাবে কোডিং পদ্ধতি প্রবর্তন না করে এটি নিয়ে অধিকতর বিশ্লেষণ, চিন্তা-প্রতিচিন্তা, মত-দ্বিমতের আরও অনেক সুযোগ আছে বলেই মনে হয়।

লেখক: অধ্যাপক, ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, নোবিপ্রবি

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

আইন করে বৈষম্য টিকিয়ে রাখার ধারাই অব্যাহত থাকবে?

দিন দিন দারিদ্র্য বাড়ছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নতুন কর্মসংস্থান নেই। এ পরিস্থিতিতে বেতন বাড়ার খবর মুদ্রাস্ফীতি আরেকবার বাড়িয়ে দেবে কি না, সেটা সময় বলে দেবে।

১৭ দিন আগে

প্রধান উপদেষ্টাকে পাঠানো ছয় মানবাধিকার সংগঠনের চিঠিতে যা আছে

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় সাইডলাইনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি পাঠানো হয়, যার মধ‍্যে সরকারের জন্য অস্বস্তিকর কিছু বিষয় রয়েছে।

২০ দিন আগে

‘জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ জুলাই জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে খুব শিগগিরই একটি আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা প্রকাশের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

২২ দিন আগে

শান্তিতে নোবেল নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

অনেকে বলছেন, এবারও পুরস্কারটি যেন পশ্চিমা শক্তি ও মার্কিন নীতির সমর্থনে বিতরণ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি, দেশটির বিপুল তেল মজুদ, সাধারণ জনগণের কষ্ট—সবকিছুই এক জটিল চিত্র তৈরি করেছে।

২৪ দিন আগে