সাংস্কৃতিক সংঘাত ও বুদ্ধিনাশ: সাম্যের মৃত্যুতে সমাজের আত্মদর্শন

বিল্লাল বিন কাশেম

সাংস্কৃতিক সংঘাত অন্য সব সংঘাতের চেয়ে জটিল ও সুদূরপ্রসারী। কারণ এই সংঘাত কেবল বাহ্যিক নয়; এটি অন্তর্জগতের, চিন্তার, মূল্যবোধের এবং আদর্শের সংঘর্ষ। রাজনৈতিক বা সামরিক সংঘাতে শত্রু ও মিত্র আলাদা করে চেনা যায়, কিন্তু সাংস্কৃতিক সংঘাতে বিভাজন এতটাই সূক্ষ্ম ও ব্যক্তিগত যে অনেক সময় মানুষ নিজেও বুঝতে পারে না— সে নিজেই হয়ে উঠেছে বিভাজনের অস্ত্র।

এই সংঘাতে কোনো পক্ষ বিজয়ী হয় না। সব পক্ষেরই ঘটে বুদ্ধিনাশ। এই বুদ্ধিনাশ কোনো একদিনে হয় না, এটি গড়ে ওঠে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়— শুরু হয় মতপার্থক্য দিয়ে, ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ এবং অবশেষে একে অন্যকে ধ্বংস করার মানসিকতায়।

সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্রদল নেতা সাম্যের মৃত্যু আমাদের সামনে এমনই এক সাংস্কৃতিক সংঘাতের নির্মম প্রতিচ্ছবি তুলে ধরে। সাম্যর মৃত্যু কেবল রাজনৈতিক হত্যা নয়, এটি এক ভয়াবহ মানসিক ও সাংস্কৃতিক বিনাশের দৃষ্টান্ত। তরুণদের চিন্তা, মত, অবস্থান, এমনকি অস্তিত্ব যদি সহ্য না হয়, তাহলে আমাদের সমাজ কোন পথে যাচ্ছে, তা ভাবার সময় এসেছে।

সাংস্কৃতিক সংঘাত: একটি অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ

সাংস্কৃতিক সংঘাত মূলত সমাজে বিরাজমান মতবাদ, মূল্যবোধ, চিন্তা ও জীবনদর্শনের মধ্যে সংঘর্ষ। এই সংঘাত কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম, জাতি, শ্রেণি বা সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নয়, বরং এটি একটি সমাজব্যবস্থার মধ্যে বিরাজমান অন্তর্দ্বন্দ্ব, যেখানে প্রগতিশীলতা বনাম রক্ষণশীলতা, যুক্তিবাদ বনাম অন্ধবিশ্বাস, সহনশীলতা বনাম বিদ্বেষ— এগুলো প্রতিনিয়ত লড়াই করে।

আমাদের সমাজে শিক্ষার বিস্তার হলেও সহনশীলতার সংকোচন ঘটেছে। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশ মানেই এখন ট্রল, কটাক্ষ বা হুমকি। মেধা ও যুক্তির জায়গায় চলে এসেছে দলগত গোঁড়ামি, এবং এ জায়গা থেকেই জন্ম নেয় সাংস্কৃতিক সংঘাত।

সাম্যের মৃত্যু: একটি আত্মঘাতী বাস্তবতা

সাম্য একজন ছাত্রনেতা ছিলেন, তার মত ছিল, অবস্থান ছিল। কিন্তু মতের কারণে কাউকে হত্যা করতে হবে? মতবাদের ভিন্নতা তো গণতন্ত্রের প্রাণ। অথচ এই দেশে এখন মতবাদের পার্থক্য জীবন-ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই পরিস্থিতি কেবল রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যর্থতা নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের বহির্প্রকাশ।

সাম্যের মৃত্যু যদি কেবল ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ হিসেবেই দেখি, তাহলে বড় সত্যটি অদেখা থেকে যাবে। এটি একটি মূল্যবোধের মৃত্যু, একটি প্রজন্মের ভবিষ্যতের ওপর চূড়ান্ত আঘাত। কারণ, আজ সাম্য, কাল হয়তো অন্য কেউ— এই অনিরাপত্তা, এই ভয়, এই নিঃসঙ্গতা তরুণদের বুদ্ধিচর্চা, মতপ্রকাশ, রাজনীতি থেকে দূরে ঠেলে দেয়। এবং এই দূরত্বই একটি সভ্যতাকে পেছনে ঠেলে দেয়।

বুদ্ধিনাশ: সভ্যতার সবচেয়ে ভয়ংকর ক্ষয়

বুদ্ধিনাশের প্রধান লক্ষণ হলো অসহিষ্ণুতা। মানুষ তখন আর যুক্তির আলোয় ভাবতে পারে না, সে ভাবতে চায় না। যারা ভিন্নভাবে ভাবে, তারা হয়ে ওঠে শত্রু। ফলে যে সমাজে মেধা, চিন্তা ও মতামতকে মর্যাদা দেওয়ার কথা, সেখানে চিন্তাশীল মানুষ হয় কোণঠাসা, নয়তো নিঃশেষ।

আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, কীভাবে শিক্ষিত, সচেতন সমাজেও অন্ধ অনুসরণ ও বিদ্বেষ প্রবল হয়ে উঠছে। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, এমনকি পরিবারেও মতভেদ মানে এখন বিরোধ। এবং এই অবস্থা তৈরির জন্য দায়ী কেবল রাজনৈতিক দল নয়, দায়ী আমাদের সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, দায়ী নৈতিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুতি, দায়ী সমাজে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার চর্চাহীনতা।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সংঘাত না সংস্কৃতির চারণভূমি?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একসময় ছিল মুক্তচিন্তা ও সংস্কৃতির চারণভূমি। এখন তা পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণাধীন সংঘাতের মাঠে। এখানেই তৈরি হয় ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, অথচ সেই নেতৃত্ব আজ আতঙ্কে বাস করে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

সাংস্কৃতিক সংঘাত যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে থাকবে, ততদিন আমাদের সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। শিক্ষাঙ্গনে যদি সহনশীলতা, যুক্তিবাদ, সমালোচনামূলক চিন্তা চর্চা না হয়, তাহলে সেই সমাজ মুক্ত ও সুস্থ হতে পারে না।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম: সংঘাতের ডিজিটাল রূপ

আগে সাংস্কৃতিক সংঘাত মুখোমুখি দ্বন্দ্বে সীমাবদ্ধ থাকত। এখন ডিজিটাল যুগে এটি ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স, ইনস্টাগ্রামসহ নানা প্ল্যাটফর্মে। মানুষ নিজেকে মুক্তমতদাতা ভাবলেও আসলে সে বন্দি হয়ে গেছে একটি ‘ইকো চেম্বার’-এ, যেখানে শুধু নিজের মতোই কথা শোনা যায়, আর ভিন্ন মত মানেই ‘ব্লক’, ‘রিপোর্ট’ অথবা অনলাইনে গণনিন্দা।

এ পরিস্থিতিও সাংস্কৃতিক সংঘাতের এক ভয়ংকর রূপ। এটি মানসিক চাপ তৈরি করে, সমাজকে ভাগ করে দেয় এবং সহমর্মিতা কিংবা শ্রদ্ধাবোধ ধ্বংস করে দেয়।

আমরা কোথায় যাচ্ছি?

একটি সভ্যতা যদি প্রশ্ন করতে না পারে, বিরোধিতা করতে না পারে, আত্মসমালোচনা করতে না পারে— তবে সে সমাজ অচিরেই নীরব স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়। আজ আমাদের সমাজে যেটা ঘটছে, তা মূলত সাংস্কৃতিক স্বৈরতন্ত্রের উত্থান। এবং এই স্বৈরতন্ত্র কোনো একক সরকারের নয়, এটি আমাদের নিজ নিজ গোষ্ঠীর, দলের, সম্প্রদায়ের— যারা নিজের মত ছাড়া কিছুই মানতে রাজি নয়।

সাম্যের মৃত্যু আমাদের চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা হয়তো আরেকটি সংখ্যায় গুনে নিয়ে তা ভুলে যাব। বুদ্ধিনাশের চূড়ান্ত রূপই তো এটিই—আমরা কষ্টও ভুলে যেতে শিখে গেছি।

করণীয়: সহনশীলতার চর্চা ও সংস্কৃতি নির্মাণ

এই সাংস্কৃতিক সংঘাত থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো—সহনশীলতা, সমালোচনার সংস্কৃতি ও আন্তঃসংলাপের প্রসার। আমাদের দরকার শিক্ষায়, গণমাধ্যমে, পরিবারে, এমনকি রাজনীতিতেও সহিষ্ণুতা শেখানো ও চর্চার বাস্তব উদাহরণ সৃষ্টি করা।

ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, বাক্-স্বাধীনতা রক্ষা, মেধার মূল্যায়ন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি আমাদের সংস্কৃতির অংশ হতে হবে। প্রতিটি হত্যার প্রতিক্রিয়ায় শুধু বিচার নয়, সংস্কৃতি ও মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

পরিশেষ বলব, সাংস্কৃতিক সংঘাত নিছক একটি সমাজতাত্ত্বিক ধারণা নয়, এটি একটি জীবন্ত বাস্তবতা—যার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই সাম্যের মৃত্যুতে। সেই মৃত্যু যেন কেবল একজন তরুণের নয়, বরং আমাদের বিবেক, আমাদের মানবিকতা, আমাদের বুদ্ধির অপমৃত্যু।

এই বুদ্ধিনাশ যদি আমরা চিনতে না পারি, প্রতিরোধ করতে না পারি, তাহলে সামনে আরও অনেক সাম্য, আরও অনেক স্বপ্ন, আরও অনেক সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে অন্ধকারে।

আমাদের এখনই দরকার নতুন এক সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণ, যেখানে মতভেদ থাকবে, কিন্তু শত্রুতা নয়; যেখানে প্রশ্ন থাকবে, কিন্তু বিদ্বেষ নয়; যেখানে চিন্তা থাকবে, কিন্তু হিংসা নয়। তাহলেই হয়তো আমরা ফেরত পেতে পারি আমাদের বুদ্ধিমত্তা, মানবতা, ও সভ্যতা।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও গণসংযোগবিদ

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং বিকেন্দ্রীকরণ

একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি তার জনশক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা (Demographic Stability) অর্জন করা এখন আর কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অং

১৮ দিন আগে

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন জামায়াতে ইসলামি। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা গেলে জামায়াত তখন বিএনপির শক্ত বা সবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি অন্যান্য ইসলামি দলগুলো সঙ্গে নিয়ে জামায়াত দরকষাকষির সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারে।

১৯ দিন আগে

হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরি ধানকে বাঁচাতে হবে

ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক আগে যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে। এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্

১৯ দিন আগে

আর্থিক সংকটে ক্ষুদ্র-শিল্প উদ্যোক্তারা: সমাধান জরুরি

গত বছরের জুনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৪–১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও এক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমন দফায় দফায় সুদহার বৃদ্ধির ফলে বড় প্রতিষ্ঠানও চাপে পড়তে পারে এবং বহু প্রতিষ্ঠান রুগ্ন তালিকাভুক্ত হবে। উল্লেখযোগ্য, ২০২০ সালের এপ্রিলে স

২০ দিন আগে