শান্তিতে নোবেল নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

ড. মিহির কুমার রায়

২০২৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার গণতন্ত্র আন্দোলনের নেতা মারিয়া কোরিনা মাচাদো। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, ‘অন্ধকারের মধ্যেও গণতন্ত্রের আলো জ্বালিয়ে রাখার অসাধারণ সাহস ও প্রতিশ্রুতির জন্য’ তাঁকে এ বছরের শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে।

এখানে উল্লেখ্য, মারিয়া কোরিনা মাচাদো দীর্ঘদিন ভেনেজুয়েলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় লড়াই করে যাচ্ছেন। সামরিক শাসন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর অবিচল অবস্থান এবং ন্যায়ভিত্তিক, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রচেষ্টাই তাঁকে এই সম্মানের যোগ্য করেছে।

দীর্ঘ সময় ধরে ভেনেজুয়েলা একটি তুলনামূলক সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যার ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছে, আর প্রভাবশালী কিছু গোষ্ঠী বিপুল সম্পদ জমাচ্ছে। প্রায় আট মিলিয়ন মানুষ দেশ ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এই দমননীতির মধ্যেও মারিয়া কোরিনা মাচাদো শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছেন।

গণতন্ত্রপন্থী সংগঠন ‘সুমাতে’র প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি দুই দশকেরও আগে থেকেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর মূলমন্ত্র ছিল—‘গোলাগুলির বদলে ব্যালটবক্সই হবে লড়াইয়ের পথ।’ এরপর থেকে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও জনগণের প্রতিনিধিত্বের দাবিতে তিনি নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন।

২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে তিনি ছিলেন বিরোধী জোটের রাষ্ট্রপতি প্রার্থী, কিন্তু সরকার তাঁর প্রার্থিতা বাতিল করে দেয়। পরবর্তীতে তিনি সমর্থন দেন অন্য দলীয় প্রার্থী এডমুন্ডো গঞ্জালেজ উরুতিয়াকে। হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবক রাজনৈতিক বিভাজন অতিক্রম করে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পর্যবেক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ভয়, নিপীড়ন ও গ্রেফতারের আশঙ্কা উপেক্ষা করে তারা ভোটকেন্দ্রে অবস্থান নেন, ফলাফল নথিভুক্ত করেন এবং সরকারের কারচুপির প্রচেষ্টা নস্যাৎ করেন।

নোবেল কমিটি জানিয়েছে, এই শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ আন্দোলন বিশ্বজুড়ে প্রশংসা কুড়িয়েছে। যদিও শাসকগোষ্ঠী ভোটের ফলাফল অস্বীকার করে ক্ষমতায় রয়ে গেছে, তবুও বিরোধী জোটের ঐক্য, সাহস এবং দৃঢ়তা ভেনেজুয়েলায় গণতন্ত্রের নতুন আশার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। কমিটি বলেছে, গণতন্ত্রই স্থায়ী শান্তির পূর্বশর্ত, অথচ আজকের বিশ্বে তা ক্রমেই হুমকির মুখে পড়ছে। একের পর এক দেশে আইন ও ন্যায়বিচারের অপব্যবহার, গণমাধ্যমের দমন, ভিন্নমতের ওপর নিপীড়ন এবং স্বৈরাচারের বিস্তার দেখা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে মাচাদোর মতো সাহসী নারী নেত্রীদের সম্মানিত করা সময়ের দাবি।

গত এক বছর ধরে তিনি গোপনে অবস্থান করছেন, কিন্তু দেশ ছাড়েননি। প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলেও তাঁর উপস্থিতি লাখো মানুষকে অনুপ্রাণিত করছে। নোবেল কমিটি বলেছে, যখন স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতা দখল করে নেয়, তখন স্বাধীনতার পক্ষে যারা দাঁড়িয়ে যায়, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া মানবতার কর্তব্য।

কমিটি আরও জানায়, আলফ্রেড নোবেলের ইচ্ছাপত্রে শান্তি পুরস্কারের জন্য তিনটি মূল মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছিল— জাতির মধ্যে ঐক্য আনা, সামরিকীকরণের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং শান্তিপূর্ণ পরিবর্তনের প্রতি অঙ্গীকার। মারিয়া কোরিনা মাচাদো এই তিন ক্ষেত্রেই নিজের দৃঢ়তা প্রমাণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, গণতন্ত্রের উপকরণই শান্তির উপকরণ হতে পারে। তাঁর নেতৃত্বে ভেনেজুয়েলার জনগণ বিশ্বাস পেয়েছে যে, সাহস, সংলাপ এবং ভোটের শক্তিই একদিন দেশটিকে মুক্ত করবে। মাচাদো এখন শুধু ভেনেজুয়েলার নয়, বরং সারা বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষের আশার প্রতীক।

তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়েও সমালোচনা চলছে। অনেকে বলছেন, এবারও পুরস্কারটি যেন পশ্চিমা শক্তি ও মার্কিন নীতির সমর্থনে বিতরণ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি, দেশটির বিপুল তেল মজুদ, সাধারণ জনগণের কষ্ট—সবকিছুই এক জটিল চিত্র তৈরি করেছে।

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভেনেজুয়েলা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পরিমাণ তেল মজুদ ধারণ করে, প্রায় ৩০৩ বিলিয়ন ব্যারেল! তা হলে দেশটির ধনী হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে জনগণ দরিদ্র; উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির মধ্যে জীবনযাপন করছে । প্রশ্ন হলো, এত তেল থাকার পরও দেশটি গরিব কেন?

রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি পেত্রোলিওস দে ভেনেজুয়েলা এসএ (পিডিভিএসএ)-এর অদক্ষতা ও দুর্নীতিই এর মূল কারণ। আবার দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেও কোম্পানিটি কার্যকর হতে পারছে না—রয়টার্সের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়। তবে পশ্চিমা মিডিয়ার বাইরে গিয়ে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের নেতিবাচক প্রভাবও বড় ভূমিকা রেখেছে।

বিভিন্ন সূত্র বলছে, মাচাদো স্পষ্টভাবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পক্ষে। তিনি মনে করেন, বিদেশি কোম্পানিকে তেল খাতে আনলে এবং মার্কিন চাপের সমর্থন নিলে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিদেশি কোম্পানির হাতে সম্পদ চলে গেলে দেশীয় দক্ষতা গড়ে ওঠে না। আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য, ওষুধ ও বিদ্যুতের সরবরাহ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। সাধারণ মানুষ, যারা তেলের দেশভুক্ত, তারাই ভোগান্তি অনুভব করছে।

রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের মধ্যে অপরিশোধিত তেল বরাদ্দের জন্য অবিশ্বস্ত মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে লেনদেনের ফলে ২০২০ সাল থেকে ভেনেজুয়েলার রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পিডিভিএসএ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি রাজস্ব হারিয়েছে।

এখন আসি নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার বিষয়ে—যেখানে সাধারণত মানবাধিকার ও শান্তির প্রচেষ্টার জন্য এ পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু যখন পুরস্কার এমন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়, যিনি বিদেশি হস্তক্ষেপের পক্ষে এবং বেসরকারিকরণ সমর্থন করেন, তখন পুরস্কারের উদ্দেশ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। দেশের সাধারণ মানুষ যারা হাইপার-ইনফ্লেশন, খাদ্য সংকট, বিদ্যুৎ ঘাটতি, দৈনন্দিন কষ্টের মধ্যে আছেন, তাঁদের ওপর মাচাদোর নীতির প্রভাব মারাত্মক।

তবে তাঁর জনতুষ্টির নীতি ও পশ্চিমা সমর্থনের কৌশল এখনও জনজীবন উন্নয়নে সহায়ক হয়নি। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকও মাচাদোর নীতির সমালোচনা করছেন। পশ্চিমা সমর্থন নিশ্চিত করার জন্য এমন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে বা হচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের ক্ষতির কারণ—এটি নোবেল শান্তি পুরস্কারের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

যখন বিশ্বের লাখো সচেতন মানুষ গাজায় গণহত্যা বন্ধে করণীয় সব ধরনের চেষ্টা করছে, তখন মাচাদো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি নীতিকেই সমর্থন করেছেন। ২০২০ সালে মাচাদোর ‘ভেন্তে ভেনেজুয়েলা’ ও নেতানিয়াহুর ‘লিকুদ’ পার্টির মধ্যে একটি চুক্তিও হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘রাজনৈতিক, আদর্শগত ও সামাজিক বিষয়’, ‘নীতি, ভূরাজনীতি ও নিরাপত্তা’ ক্ষেত্রে সহায়তার উদ্দেশ্যে এই সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে।’

ফলে ৭ অক্টোবরের হামলাকে ‘সন্ত্রাসী’ বলা এবং গাজায় গণহত্যা নিয়ে মাচাদোর নীরবতার সমালোচনা এখনও হচ্ছে বিভিন্ন মহলে। এখন সেই মাচাদোই পেয়ে গেলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার—যিনি প্রকৃত অর্থে শান্তি, মানবাধিকার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটা অবদান রেখেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে।

পুরস্কার পাওয়ার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় ভেনেজুয়েলার রাজনীতিবিদ মারিয়া কোরিনা বলেন, “এই অর্জন আমার একার নয়, পুরো সমাজের।” বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ক্রিশ্চিয়ান বার্গ হার্পভিকেন তাঁর ভিডিও বার্তাটি প্রকাশ করেছেন। ভিডিওতে মারিয়াকে পাঁচবার “ওহ মাই গড” বলতে শোনা যায়। তিনি বলেন, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি।

নোবেল কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে মারিয়া বলেন, “এটা পুরো সমাজের অর্জন। আমি তার মাঝে একজন ব্যক্তি মাত্র। আমি এর প্রাপ্য নই।” তিনি আরও বলেন, “এই খবর আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। আমি এই সম্মানের জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাতে চাই।”

২০১৯ সালে যখন তরুণ রাজনীতিক হুয়ান গুইদো নিজেকে অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু মাদুরো তখনও ক্ষমতায়। এরপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা, অর্থনৈতিক চাপ কিংবা রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েও মাদুরোকে টলাতে পারেনি ওয়াশিংটন।

এখন মাচাদোর নোবেল জয় সেই প্রেক্ষাপটে অনেকের কাছে “একটি কূটনৈতিক সাফল্য” যা যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের প্রতিপক্ষকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়, আর মাদুরোকে আরও কোণঠাসা করে। কারণ, নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর বিজয়ীর যে বৈশ্বিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়, তা রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করাও সহজ।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

বদলাচ্ছে চাকরির বাজার— প্রয়োজন বাস্তব দক্ষতা

যুক্তরাষ্ট্রের আইটি খাত আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে— দক্ষতা থাকলে ডিগ্রি নয়, কাজই কথা বলে। তাই এখনই সময় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরি সংস্কৃতি ও সামাজিক মানসিকতাকে পুনর্গঠন করার। কারণ, এ শতাব্দীর অর্থনীতি আর ডিগ্রির ওপর দাঁড়িয়ে নেই, এটি দাঁড়িয়ে আছে শেখার সক্ষমতার ওপর।

৫ দিন আগে

হিংসা এমন আগুন যা নিজেকেই দগ্ধ করে

হীনমন্যতায় আক্রান্তরা মনে করছে, অন্যের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাদের পথে বাধা হবে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষের অসুস্থ চর্চায় নিজেদের কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিরূপ আচরণ ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বের অবমাননা হচ্ছে এবং সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে না।

৭ দিন আগে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম— অনির্বাণ আলো হয়ে জেগে থাকবে সমাজে-সাহিত্যে

অন্ধকার সময়েও সে ছিল আমাদের আলোকবর্তিকা, যে দেখিয়েছে— সাহিত্য কেবল নান্দনিকতার নয়, নৈতিক সাহসেরও একটি ক্ষেত্র। অন্যায় ও অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সে ছিল দৃঢ়, কিন্তু তার ভাষা ছিল সবসময় কোমল, গভীর ও আলোকিত।

৭ দিন আগে

চে গুয়েভারা— মৃত্যুতেও চিরভাস্মর

সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, চে যুদ্ধের সময় আহত হয়ে মারা যান। সে বিবৃতি কেউ বিশ্বাস করেনি। সরকার গোপনে তার মুখের ছাপ তুলে ও দুই হাত কেটে রাখে প্রমাণ হিসেবে, যেন তার কবর কোনো বিপ্লবী তীর্থে পরিণত না হয়।

৯ দিন আগে