অর্থনীতিকে শক্ত করতে প্রয়োজন নির্বাচিত সরকার

রাজু আলীম
প্রকাশ: ১২ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ২৪

বলা হতো, দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর বাংলাদেশের অর্থনীতি অতিকায় ফানুসে চড়ে উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে গেছে বহু দূর। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে শুভঙ্করের ফাঁকির মতোই দেখা গেল ইউরিয়া থেরাপি দিয়ে মোটা-তাজা করা অতিকায় অর্থনীতির বাঘ ঝিমুচ্ছে বিশেষ সহায়তার খুঁটি ধরে। দিন শেষে সবই যেন রূপকথার গল্প।

কৈয়ের তেলে কৈ ভাজার অর্থনীতিতে মাছ এবং তেল— দুটোই পাচারের হাত ধরে চলে গেছে সীমানা পেরিয়ে। থেকে গেছে জ্বলন্ত চুলা আর ফুটন্ত কড়াই। বাংলাদেশের শুভাঙ্করী অর্থনৈতিক পথযাত্রার চুপসে যাওয়া, শুরু যদিও হঠাৎ করে নয়। ঋণের পয়সার ঘিয়ে ভাজা স্বল্পমেয়াদি ভঙ্গুর উন্নয়নে হাতুড়ির ঘা পড়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ কয়েক বছর ধরেই।

ওই সময়ের পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা কমে ৫ দশমিক ৭৮ শতাংশে নামে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।

হঠাৎ ওপরে ওঠার পর ক্রমান্বয়ে পড়তে থাকা অর্থনীতির চাকা পেচিয়ে যায় দুর্নীতি, অনিয়ম আর ব্যপক স্বেচ্ছাচারিতার দায়ে। মেগা প্রজেক্ট থেকে মেগা পাচারের পর, করোনাকালীন সময়ের পর বসে যাওয়া বাংলাদেশের রিজার্ভ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দুর্নীতির জ্বরে আক্রান্ত অর্থনীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার সংকট কাটাতে বাংলাদেশেকে হাজির করানো হয় বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফের দরবারে। কিন্তু বিধিবাম। বিশ্বব্যাংক আর আইএমএফের প্রেসক্রিপশনেও রুগ্ন রিজার্ভকে আর চাঙা করতে পারেনি সাবেক সরকার।

এখানেই শেষ নয়। মেগা প্রজেক্টের মেগা দুর্নীতি সচল রাখতে দেশের আভ্যন্তরীণ খাত, ব্যাংক খাত থেকে নেওয়া ঋণ ও আর্থিক অনিয়ম অনেকটাই সংশ্লিষ্ট খাত এবং একই সঙ্গে সরকার কফিনেও শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। ১৬ বছর ধরে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ কোটি টাকারও বেশি টাকা বিদেশে পাঠানোর পর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা তখন অনেকটা কুজোর চিৎ হয়ে ঘুমানোর স্বপ্নের মতো।

সংকট কাটাতে প্রয়োজন বিশাল অঙ্কের টাকা। ঠিক তখনই আসে হাওয়ায় টাকা ছাপানোর উর্বর পরিকল্পনা। যে কথা সেই কাজ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফলাফল আরও খারাপ। এরই মধ্যে অনেকটা ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো ব্যপক আকারে ফাঁকা করে ফেলা হয় সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, তারল্য সংকট, জ্বালানি সংকটের বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রস্ফীতি, মূল্যস্ফীতিতে অর্থনীতি-বাণিজ্য অনেকটাই লাইফ সাপোর্টে।

ফিরে আসা যাক বর্তমান সময়ে। দেশের অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের পর আওয়ামী সরকারের রেখে যাওয়া বিধ্বস্তপ্রায় অর্থনীতির বোঝা এখন অন্তর্বর্তী সরকারের ঘাড়ে। দিন শেষে দেশের অর্থনীতির সার্বিক প্রভাব পড়ে দেশের জনগণের ওপর। সেদিক থেকে বাজারের অস্থিরতা কমাতে সাধারণ ভোক্তা পর্যায় থেকে দৃষ্টি দিতে শুরু করেছে সরকার।

বাজার স্থিতিশীল রাখতে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ওপর কর ও শুল্ক হ্রাস করে জনমনে কিছুটা স্বস্তিও এনেছে সরকার। রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দামে ঊর্ধ্বগতির চিত্র ছিল কম। কিছু পণ্যের দাম স্থিতিশীল। শাকসবজির দাম কমলেও চিনি, ডাল, ছোলা, বেসনের দাম স্থিতিশীল।

অন্যদিকে বৃহৎ অর্থনৈতিক দুরবস্থাকে কাটিয়ে উঠতে স্বল্প সময়ে যথাসম্ভব চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অন্তর্বতী সরকারের উপদেষ্টারা। এর ধারাবাহিকতায় ব্যাংকিং খাতে দৃষ্টি দিলেও কেবলমাত্র ব্যাংকিং খাতে সৃষ্ট রুগ্নদশাকে কাটিয়ে উঠে দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে ৫-১০ বছর সময় লাগতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।

গভর্নর আরও বলেছেন, ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ আরও বেড়েছে। বিগত আওয়ামী সরকারের আমলে লুকিয়ে রাখা খেলাপিগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ২০ দশমিক ২০ শতাংশ।

২৬ ফেব্রুয়ারি গভর্নর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল এক লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে সমস্যা কাটিয়ে শৃঙ্খলা আনতে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নিয়মানুবর্তিতা আনার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।

ব্যাংকব্যবস্থা থেকে এখনো সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস (জুলাই-ডিসেম্বরে) ব্যাংকগুলো থেকে সরকার ছয় হাজার ৭৪৪ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে। এতে গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা।

শুধু ব্যাংক নয়, সরকারের ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণও বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) ব্যাংকের বাইরে থেকে ২৪ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে সরকার। গত অর্থবছরের একই সময়ে নিট ঋণ নেওয়া হয়েছিল সাত হাজার ৯০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভাপতি এবং ঢাকা ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল হাই সরকার সার্বিক পরিস্থিতিতে বলেছেন, অর্থনীতি চাঙা করতে আমাদের প্রয়োজন আস্থার জায়গাটি তৈরি করা, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আরও সম্পৃক্ত করা। এর জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীলতা। আর তার জন্য একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।

ব্যাংকিং খাতে এত সমস্যার ভিড়েও রয়েছে সুসংবাদ। দেশের আর্থিক সূচকসংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ এক প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য বলছে, আবারও ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে ব্যাংকের বাইরে থাকা টাকা। তাতে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণও বেড়েছে। গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর— এই ছয় মাসে ব্যাংকে সাড়ে ৩৪ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। তাতে ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট আমানতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৭৭ হাজার ৩১৫ কোটি টাকায়।

অন্যদিকে শিল্প খাতে শ্রম অসন্তোষসহ মূলধন সংকটে তৈরি পোশাকসহ বস্ত্র খাত সংকটে পড়েছে। রড, সিমেন্টের শিল্পগুলোর সংকট কাটেনি। আছে ব্যাপকভাবে ভোক্তা চাহিদা কমে যাওয়ার প্রবণতা। সংকট মোকাবিলায় উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা সরকারের উপদেষ্টা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংস্থা প্রধানের সঙ্গে আলোচনা করলেও সমাধান মিলছে না।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর আগস্টে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরও বড় থেকে ছোট ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব বিদ্যমান। গত সেপ্টেম্বরের তুলনায় অক্টোবরে উৎপাদন কমেছে— এমন শিল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে বস্ত্র খাতের গার্মেন্ট, নিটওয়্যার, নিট ফেব্রিক্স, বিল্ডিং, শিপস অ্যান্ড ফ্লোটিং স্ট্রাকচার, কাগজ, সার, পেট্রোলিয়াম পণ্য ও ফলজ প্রক্রিয়াজাত পণ্য।

বস্ত্র খাতের সংকট নিয়ে বিকেএমইএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ হাতেম বলেন, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ জ্বালানি খাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি, ব্যাংকিং খাত, কাস্টমস সংক্রান্ত শর্ত। এসব সমস্যা সমাধান না হলে নিশ্চিতভাবে শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পাবে, যা রপ্তানি আয়েও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

সার্বিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এই মুহূর্তে সম্ভব না হলেও সামনের দিনে এর নেতিবাচক ধারা থামাতে হলে দেশে প্রয়োজন একটি নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকার। সঙ্গে প্রয়োজন গোছানো পরিকল্পনা আর জবাদদিহিতা নিশ্চিত করা। প্রয়োজন পাচার ও দুর্নীতিহীন অর্থব্যবস্থা, যেন সামনে স্বপ্নের ফানুশ ওড়ানো ভঙ্গুর অর্থনীতির ধারা ভেঙে বাংলাদেশ টেকশই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যায়।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্বপ্নের ডানায় ভর করে শিশুশ্রমের শৃঙ্খল ভাঙা কি আদৌ সম্ভব?

দেশে প্রায় ৩৫ লাখ শিশু শ্রমিক রয়েছে এবং ১০ লাখ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত— এ তথ্য জানিয়ে শ্রম উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, শিশুশ্রম প্রতিরোধে শিশুদের কাজে নিয়োগ করা ব্যক্তিদের শাস্তি কয়েকগুণ বাড়ানো হবে। সেই সঙ্গে পরিবর্তন করা হবে শিশুশ্রমের সংজ্ঞা।

৩ দিন আগে

এক্সিম ব্যাংক— ঘুরে দাঁড়ানোর অনন্য নজির

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, যেসব কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা নিয়েছিল, এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা, পরিচালন কাঠামো এবং গ্রাহক আস্থা সেই প্রেক্ষাপটে ব্যতিক্রম। ফলস্বরূপ, এক্সিম ব্যাংককে এ প্রক্রিয়া থেকে বাদ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

৫ দিন আগে

ট্রাম্পকে টেক্কা দিতে পারবেন মাস্ক?

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান— এই দুই দলের বৃত্তে আবর্তিত হচ্ছে। তবে মাস্ক বলছেন, বাস্তবে এই দুই দল একে অন্যের পরিপূরক হয়ে উঠেছে। ‘তারা ভিন্ন পোশাক পরে একসঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে— এটাই ইউনিপার্টি,’— বলেন মাস্ক।

৭ দিন আগে

গণমাধ্যমে নারী-শিশুদের নিয়ে ‘দায়িত্বহীনতা’

বাংলাদেশের গণমাধ্যম অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পাঠক-দর্শক আকৃষ্ট করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাংবাদিকতার নীতি পরিপন্থি কাজ করছে।

৮ দিন আগে