রক্তাক্ত বাংলাদেশ: ১৯৭১ থেকে ২০২৫

মো. আব্দুর রাজ্জাক

বাংলা মা আজ বড় ক্লান্ত। দেহ থেকে রক্ত ঝরতে ঝরতে সম্পূর্ণ দেহ রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। সেই ১৯৭১ সাল। লক্ষ লক্ষ মানুষের তাজা রক্তের বিনিময়ে বাংলা মা জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার জন্মটা সুখকর ছিল না, ছিল অত্যন্ত কষ্টের ও বেদনার। তার সন্তানেরা ছিল অকুতোভয়। রক্তে স্নাত সবুজ ঘাস মাড়িয়ে জন্ম নিয়েছিল লাল-সবুজ পতাকা। বাংলা মায়ের বুকে স্বামীহারা, সন্তানহারা, পিতৃহারা ও বীরাঙ্গনাদের কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে প্রকম্পিত হয়েছিল।

দিন, মাস ও বছর ঘুরে এলো ১৯৭৩ সাল। যুদ্ধে বিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে বাংলা মা ততক্ষণে শোক ও দুঃখকে শক্তিতে পরিণত করে বুকে কাঙ্ক্ষিত আশার সঞ্চার তৈরি করে, বেঁচে থাকার অদম্য আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বিধি বাম। ১৯৭৪ সাল। চারিদিকে দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার, ডাস্টবিনে কুকুর ও বুভুক্ষু মানুষের পঁচা খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি, লজ্জা-নিবারণের জন্য বস্ত্রের অভাব। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান অসহায় কঙ্কালসার মানুষের অন্নের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদেশ থেকে সাহায্য নিয়ে এসেছিলেন।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, ভুখা-নাঙ্গা মানুষের কাছে পৌঁছানোর আগেই তা লুটপাট হয়ে যায়। তাই তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘আমি বিদেশ থেকে সাহায্য যা নিয়ে এসেছি, চাটার দলেরা সব চেটে খেয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশ পেয়েছে সোনার খনি, আর আমি পেয়েছি চোরের খনি।’

এককথায়, দেশ চালাতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন শেখ মুজিব। তার আত্মীয়-স্বজন ও কাছের লোকেরা তার সুনাম ও মর্যাদা নষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল, যা তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। ভারতের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সখ্য আমেরিকা ভালোভাবে নেয়নি। সর্বোপরি, ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে মেজর ডালিমের স্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ চরম অসন্তোষ ও তিক্ততায় রূপ নিয়েছিল।

মেজর ডালিম অভিযোগ ও বিচার দাবি করলে শেখ মুজিবুর রহমান সুষ্ঠু সমাধান না করে পক্ষপাতমূলক ব্যবস্থা নেন। নানা ঘটনাপ্রবাহে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন।

৩ নভেম্বর ১৯৭৫। মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটল। চার নেতা যথাক্রমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও মো. কামরুজ্জামান মুক্তিযুদ্ধে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। জেলখানায় তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। বাংলা মা আবারও রক্তাক্ত হলো।

শোকে কাতর, দুঃখে ভারাক্রান্ত এই ভার আর বাংলা মা বহন করতে পারছিল না। জাতির এই ক্রান্তি লগ্নে আল্লাহর রহমতে বাংলামায়ের কোলজুড়ে আলোকিত হয়ে জন্ম নিলেন এক মহানায়ক— তার নাম জিয়াউর রহমান। লাখো-কোটি মানুষের কর্ণকুহুরে বাজতে লাগল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার ঘোষণা— ‘আমি মেজর জিয়া বলছি।’ মানুষেরা খুশি হলো, আনন্দিত হলো, আশায় সঞ্চার ফিরে পেল। বাংলামায়ের হাতে নিভু নিভু প্রদীপ আবার জ্বলে উঠল।

জিয়াউর রহমান দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম ভুলে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়া ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জনগণকে জাগিয়ে তুলতে লাগলেন। খাল খনন কর্মসূচি, খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, দেশে পড়ে থাকা জায়গাকে যোগ্য করা, মায়েদের জন্য বাড়ির সামান্য জায়গায় সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি খামার তৈরি করে কৃষি ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। বয়স্কদের জন্য নৈশশিক্ষা, ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সকলকে একত্রিত করে দেশের উন্নয়নে সরকারি সাহায্য করতে আহ্বান জানিয়ে সফল হয়েছিলেন।

তলাবিহীন ঝুড়ির ধারণা বদলে উন্নয়নের রূপকার হিসেবে দেশের মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। পাড়া-মহল্লায়, গ্রামে-নগরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, মসজিদ-মন্দিরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু একটি নাম— জিয়াউর রহমান।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্র চর্চার ব্যবস্থা করলেন। একজন সফল রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার পরিচিতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। স্বপ্নের রাজপুত্র হিসেবে মানুষের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন। এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিবেশী সরকার সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদকে আমন্ত্রণ জানিয়ে হত্যার সব নীল নকশা তৈরি করে তাকে দেশে পাঠালেন।

১৯৮১ সালের ৩০ মে। সারা পৃথিবীর মধ্যে আলোকিত মানুষটি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে শহিদ হলেন। যেন আকাশ থেকে একটি নক্ষত্র ঝরে পড়ল। জাতি শোকে দুঃখে মুহ্যমান হয়ে পড়ল। তিনি খাওয়া-দাওয়া কম করতেন, বিলাসিতা পছন্দ করতেন না। তার সততা, ন্যায়পরায়ণতা, দেশপ্রেম, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, জনগণের প্রতি গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা সবই ছিল তার অলংকার। বাংলা মা হারালো তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। রক্তাক্ত হলো, অঙ্গহানি হলো বাংলা মায়ের।

সেদিন শেরে বাংলানগরে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। সমগ্র ঢাকা শহরে যে যেখানে ছিল, রাস্তায় দাঁড়িয়ে নামাজে শরিক হয়েছেন। তার প্রতি মানুষের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি, ক্রন্দন— সবই কোটি কোটি মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। এ দৃশ্য অবলোকন করে অনেকে মনের অজান্তেই অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেদিন আকাশও কেঁদেছিল, বৃষ্টি ঝরেছিল।

নব্বইয়ে স্বৈরাচার পতনের পর ক্ষমতায় এলেন খালেদা জিয়া। দেশনেত্রী, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, আপসহীন নেত্রী দীর্ঘদিন সততার সঙ্গে দেশ চালালেও ১/১১ নেমে আসে ২০০৭ সালে। ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন শাসনামলে তারেক জিয়ার ওপর মধ্যযুগীয় বর্বরতা চালানো হয়। পেছন থেকে নির্দয়ভাবে ছুরিকাঘাত করলেন জেনারেল মাসুদ উদ্দিন।

২০০৮ থেকে ২০২৪। বাংলাদেশে শুরু হলো এক রক্তঝরানোর অধ্যায়। হত্যা, খুন, গুম, আয়নাঘর— বিরোধী দলের নেতাদের ওপর অমানুষিক, নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার। মানবতা বিসর্জন দিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে নিজের দেশের পুলিশ ভাইয়ের হাতে হাজারও ভাই শহিদ হলেন।

নিরীহ পথচারী, কিশোর, যুবক, ছাত্র— ঝুলন্ত অবস্থায় গুলি, গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া, হেলিকপ্টার থেকে গুলি— এসব নিষ্ঠুরতা সারা বিশ্ব দেখেছে। বাংলা মায়ের সন্তানদের ওপর জেনোসাইড। জাতিসংঘ প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে মৃত্যুর লোমহর্ষক ইতিহাস।

হাজারও মায়ের বুক খালি হয়ে গেল, যারা এখনো সন্তানের জন্য স্বপ্ন দেখে, দুঃস্বপ্নে ভোগ রাত কেটে যায় চোখের পানিতে। দুঃখ লাগে, এত মানুষ শহিদ করেও তারা বিন্দুমাত্র অনুশোচনা বোধ করেন না। বাংলা মায়ের বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। পিচ ঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।

সবশেষ জনপ্রিয় ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় নেতা নুরুল হক নুরকে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সিভিল ড্রেসের ব্যক্তিরা তাকে যেভাবে মেরেছে তা মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।

বর্তমান সরকার যখন দেশের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা, জনগণের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার পূরণ এবং মানুষের জীবনমানের নিশ্চয়তা প্রদানে ব্যর্থ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন যখন চরম হুমকির মুখে, তখন বাংলা মা প্রত্যাশা করে এক সাহসী, দূরদর্শী ও যোগ্য নেতৃত্বের। যিনি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবেন, রাষ্ট্রকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে সক্ষম হবেন। এমনই একজন ব্যক্তি, যিনি জুলাই বিপ্লবে সুচিন্তিত মতামত ও যুগান্তকারী দিকনির্দেশনা দিয়ে জুলাই আন্দোলনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

তিনি হলেন শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং মাদার অব ডেমোক্রেসি খালেদা জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরী, বাংলাদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক তারুণ্যের অহংকার তারেক রহমান। তিনি হতে পারেন বাঙালি জাতির মুক্তির কাণ্ডারি, পথের দিশারী, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিভাবক, বাঙালি মাতার যোগ্য সন্তান, নতুন প্রজন্মের আশা ও ভরসার প্রতীক।

তারেক রহমানের সততা, কর্মদক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলী, প্রখর মেধা, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা— সবই তাকে সেই মহানায়ক করে তোলে, যিনি বাংলাদেশের সুখ-শান্তি, স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়নে দেশকে পরিচালিত করতে সক্ষম হবেন।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজকর্ম বিভাগ, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

হরিপদ কাপালীর আবিষ্কৃত হরি ধানকে বাঁচাতে হবে

ঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক আগে যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে। এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্

১৬ দিন আগে

আর্থিক সংকটে ক্ষুদ্র-শিল্প উদ্যোক্তারা: সমাধান জরুরি

গত বছরের জুনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৪–১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও এক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমন দফায় দফায় সুদহার বৃদ্ধির ফলে বড় প্রতিষ্ঠানও চাপে পড়তে পারে এবং বহু প্রতিষ্ঠান রুগ্ন তালিকাভুক্ত হবে। উল্লেখযোগ্য, ২০২০ সালের এপ্রিলে স

১৬ দিন আগে

স্কুল শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ হোক

কোচিং সংস্কৃতি শুধু শিক্ষাকে পুনর্নির্ধারণ করেনি, পরিবারের ওপর এক অসহনীয় আর্থিক বোঝাও চাপিয়েছে। প্রতিষ্টানের শিক্ষকদের যথাযথ আন্তরিকতার অভাবের কারণেই অভিবাবকের তাদের সন্তারদের নিয়ে হতাশায় থাকেন।

১৮ দিন আগে

রোহিঙ্গা সংকট: আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে তিন দিনের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ২৪-২৬ আগস্ট,২০২৫ পর্যন্ত উখিয়ার ইনানীতে সেনাবাহিনীর হোটেল বে-ওয়াচ মিলনায়তনে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এই ডায়লগের আয়োজন করছে রোহিঙ্গা ইস্যু বিষয়ক হাই রিপ্রেজ

১৯ দিন আগে