হিংসা এমন আগুন যা নিজেকেই দগ্ধ করে

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

বিশ্বব্যাপী মন ও মানসিক সুস্থতার সচেতনতা বাড়াতে নানা কর্মসূচির ফলাফল বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস, যা ১০ অক্টোবর পালিত হয়। এ বছর দিবসের মূল প্রতিপাদ্য— ‘পরিষেবা প্রাপ্তি— দুর্যোগ ও জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্য’। সত্যিই সময়ের সঙ্গে মানানসই প্রতিপাদ্য।

তবে বাঙালির চিরায়ত বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কেও যে বিরূপ প্রভাব পড়ে, তা উপেক্ষা করা যায় না। হালের আমলে সেই হিংসা-ক্ষোভ ও ব্যক্তি বিদ্বেষের নগ্নতা এতটা বেড়েছে যে মানুষের মননে প্রভাব ফেলছে। বরং নীরবে হিংসার চর্চায় সিনিয়ররা তাদের জুনিয়রের ওপর, জুনিয়ররা সিনিয়রের ওপর নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে।

হীনমন্যতায় আক্রান্তরা মনে করছে, অন্যের যোগ্যতা ও দক্ষতা তাদের পথে বাধা হবে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষের অসুস্থ চর্চায় নিজেদের কর্ম ও সামাজিক অনুষ্ঠানে বিরূপ আচরণ ছড়াচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রিয় বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও বন্ধুত্বের অবমাননা হচ্ছে এবং সুন্দর সম্পর্ক ধরে রাখার চেষ্টা হচ্ছে না।

মনোবিজ্ঞান হিংসার পেছনের কারণ ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছে। হিংসা হলো অন্যের গুণাবলি, দক্ষতা বা সাফল্যের প্রতি নেতিবাচক অনুভূতি। যখন আমরা নিজেদের মধ্যে এই গুণাবলির অভাব অনুভব করি বা অন্যের মধ্যে অভাব দেখি, তখন হিংসা জন্মায়। এটি স্বাভাবিক আবেগ হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তির মানসিক ও সামাজিক জীবনে ক্ষতিকর, যা বিদ্বেষ, লোভ এবং অন্যের ক্ষতি কামনার জন্ম দেয়।

মোটা দাগে হিংসাকে কয়েকটি ধাপে ব্যাখ্যা করা যায়—

আবেগপ্রবণতা: হিংসা একটি শক্তিশালী আবেগ, যা মানুষের মনে নেতিবাচক অনুভূতি সৃষ্টি করে, যেমন অসন্তোষ, হতাশা, এবং অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব।

সামাজিক তুলনা: হিংসা প্রায়ই সামাজিক তুলনার ফলাফল। যখন আমরা নিজেদের অন্যের সঙ্গে তুলনা করি এবং নিজেদের তাদের চেয়ে পিছিয়ে মনে করি, তখন এই অনুভূতি জন্মায়।

নেতিবাচক আচরণের জন্ম: হিংসা মানুষকে অন্যের ক্ষতি করার বা তাদের ধ্বংস কামনা করার দিকে ঠেলে দিতে পারে, যা সমাজে সংঘাত ও বিদ্বেষ তৈরি করে।

আধ্যাত্মিক ক্ষতি: অনেক ধর্মীয় ও দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে হিংসা একটি আত্মিক ব্যাধি, যা মানুষের ভালো কাজ ও আধ্যাত্মিক উন্নতিকে বাধা দেয়।

গুরুজনেরা বলতেন, হিংসা এমন একটি আগুন যে আক্রান্ত ব্যক্তি কারও দেওয়া আগুনে নয়, নিজের আগুনে নিজেই দগ্ধ হয়।

প্রায় প্রতিটি ধর্মেই হিংসা-বিদ্বেষ সম্পর্কে কঠোর অবস্থান নেওয়া হয়েছে। সনাতন, বৌদ্ধধর্ম কিংবা ইসলাম সবই হিংসাকারীদের সতর্ক করে। মানুষের চরিত্রে যে খারাপ দিকগুলো আছে, তার মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যতম। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষা, কলহ-বিবাদ মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে বিষময় করে তোলে। যে হিংসা করে, তার অন্তরের শান্তি নষ্ট হয়। আত্মা পূর্ণ হয় অশান্তিতে। কলুষিত আত্মা একসময় নিজের প্রতি ঘৃণার উদ্রেক করে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ সতর্ক করেছেন:

‘আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে যা দিয়েছেন, তার জন্য কি তারা ঈর্ষা করে?’ (সুরা আন-নিসা, আয়াত: ৫৪)

হিংসা-বিদ্বেষ এক ভয়ানক সংক্রামক ব্যধি। সম্পদের মোহ ও পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষ তৈরি হয়। এটি মুমিনের ভালো কাজকে নষ্ট করে ফেলে। নবি করিম (সা.) বলেছেন, ‘হিংসা-বিদ্বেষ থেকে নিবৃত্ত থাকো, কারণ হিংসা মানুষের নেক আমল এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেমন আগুন লাকড়িকে জ্বালিয়ে নিঃশেষ করে।’ (আবু দাউদ)

হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তিন ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয় না, তাদের মধ্যে একজন হলো অন্যের প্রতি বিদ্বেষপোষণকারী।’ মহানবী (সা.) বলেছেন, যারা পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনি রাখে, তাদের ক্ষমা করা হয় না। (মুসলিম শরিফ)

মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের মধ্যে শুধু বেঁচে থাকার প্রবৃত্তি নয়, ধ্বংসের প্রবৃত্তিও কাজ করে। এটি ‘থ্যানাটোস’ বা মৃত্যু প্রবৃত্তি হিসেবে পরিচিত, যা ব্যক্তির হিংসা, ঘৃণা, আগ্রাসন ও আত্মঘাতী আচরণের জন্ম দেয়।

মনোবিদরা মনে করেন, অতীতের সম্পর্ক থেকে মানসিক আঘাত বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন ব্যক্তিরা যদি সেই আঘাত নিয়ন্ত্রণ না করে, তবে ভবিষ্যতের সম্পর্কের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি নষ্ট হতে পারে। এভাবেই ঈর্ষা মাথা চাড়া দেয়। ফলে ব্যক্তি উদ্বিগ্ন বোধ করতে পারেন এবং নিজের প্রতি অবিশ্বাস ও আত্মবিশ্বাসহীনতা জন্মায়, যা প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ও তৈরি করে।

হিংসা থেকে মুক্তির জন্য মনোবিদরা পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দিক সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন—

  • ব্যক্তিগত দক্ষতা
  • আত্মবিশ্বাস
  • চরিত্র
  • সংযোগ
  • নিজের প্রতি যত্নশীলতা

নিজের প্রতি যত্নশীলতা বাড়ালে করলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। পজিটিভ মাইন্ডসেট তৈরি হয়। ব্যক্তি নিজের কাজে মনোনিবেশ করে এবং দক্ষতা বাড়ালে আত্মবিশ্বাসী হয়। এতে সময়ের আগে অসময়ে অতিরিক্ত আশা করা হয় না, বরং ধৈর্যশীল হয়ে নিজ যোগ্যতার ভিত্তিতে ফলাফল পায়।

নিজের প্রতি বিশ্বাসই ব্যক্তিকে আত্মনির্ভর ও বাস্তবসম্মত করে তোলে। অন্যের দিকে তাকিয়ে অসময়ে প্রতিযোগিতা করা এবং হিংসা-বিদ্বেষে ভোগার অভ্যাস এভাবে কমে যায়।

যদি কেউ নিজের আত্মাকে কলুষিত করে অন্যের সঙ্গে তুলনা করে হীনমন্যতায় ভোগে, তবে সে নিজেকে অজান্তে নানা চ্যালেঞ্জে ফেলে। এক সময় মনে হয়, কিছুই কাজ করছে না। এই হতাশা ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা বা উদ্বেগ তৈরি করে। তাই হিংসা নয়, আসুন অন্যের সুখ বা দুঃখে সমব্যাথী হই। না পারলে অন্যের হিংসা বা বিদ্বেষে নিজেকে কলুষিত না করি। বরং অন্যের ভালো গুণগুলো চিন্তা করি এবং নিজের মধ্যে সেই গুণাবলির উন্নয়ন করি।

নিজের মনের ওপর অযাচিত চাপ কমান। হিংসা না করে অন্যের ইতিবাচক গুণের প্রশংসা করুন। আত্মার শান্তিতে উদারতা ও সংবেদনশীলতা চর্চা করুন। মনে রাখুন, ‘মনের বাঘের’ কবলে পড়ে হিংসার আগুনে নিজেই দগ্ধ হবেন। সমব্যাথী হন, নিজের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখুন আত্ম-শুদ্ধির অপার আনন্দে।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য: মানবতার নীরব বিশ্বাসঘাতকতা

ক্ষুধা ধীরে হত্যা করে, ভেজাল নীরবে হত্যা করে। খাদ্যে ভেজাল কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার মানুষ মারাও যায়।

৭ দিন আগে

ইতিহাসের সাক্ষী আহমদ রফিক

এ জাতির মুক্তির মন্দিরের সোপানতলে কে হবেন কান্ডারী? আমরা কি সেই ইতিহাসের ভারবাহী নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছি? না পারার দায় কার? লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

৮ দিন আগে

তিন শূন্যের পৃথিবী গড়া জাতিপুঞ্জের সকলের স্বপ্ন হোক

গত আট দশক ধরে জাতিসংঘ ধারাবাহিকভাবে তার কর্মপরিধি সম্প্রসারিত করেছে এবং নানা ক্ষেত্রে আরো গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে । বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা, মানবাধিকার, বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন, ন্যায়বিচার, ন্যায্যতা ও সমতা প্রসারে জাতিসংঘ অনস্বীকার্য ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘের কারণেই আজ বিশ্বের ১২০ টি দে

১৫ দিন আগে

‘রূপালী ক্যাশ’, ডিজিটাল জালিয়াতি ও গ্রাহকের অসহায়ত্ব

এসব গ্রাহকের কাজ ছিল টাকা ওঠানো থেকে শুরু করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রভৃতি সংগ্রহ। কিন্তু সেজন্য কেন তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমান ছিলেন? কারণ ব্যাংকের ‘সার্ভার ডাউন’, তাই কোনো কাজই করা যাচ্ছিল না!

১৫ দিন আগে