‘রূপালী ক্যাশ’, ডিজিটাল জালিয়াতি ও গ্রাহকের অসহায়ত্ব

অরুণ কর্মকার

আজ শুক্রবারের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত দুটি সংবাদ কিছু কথা বলতে এতটাই প্ররোচিত করেছে যে কিছু বলতেই হচ্ছে। এর একটি সংবাদ রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি ‘রূপালী ক্যাশ’ সেবার উদ্বোধন। গতকাল বৃহস্পতিবার ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে এই সেবার উদ্বোধন করা হয়।

সেই অনুষ্ঠানে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহোদয় বলেছেন, এই পদে দায়িত্বে আসার পর তার লক্ষ্য ছিল প্রযুক্তিতে শীর্ষে যাওয়া। ব্যাংকটির অত্যন্ত দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তি টিমের চেষ্টায় সেই লক্ষ্য পূরণে তারা এক ধাপ এগিয়েছেন। সংবাদে আরও বলা হয়েছে, এই সেবা গ্রাহকদের জন্য দ্রুত, নিরাপদ ও সাশ্রয়ী মূল্যে লেনদেনের সুবিধা দেবে কিংবা দিচ্ছে।

খুব ভালো কথা। রাষ্ট্রীয় একটি প্রতিষ্ঠানের এমন সাফল্য ও অগ্রযাত্রা আমাদেরকে উজ্জীবিত করে বৈকি। কিন্তু কথা হলো, বৃহস্পতিবার যখন ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে এই সেবার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হচ্ছিল, ঠিক তখনই ব্যাংকটির মিরপুর-১ নম্বর শাখায় প্রায় অর্ধশত গ্রাহক সেবা পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে বাধ্য হন। এ ছাড়াও অনেকে আশেপাশে কিছু কাজ সেরে কিংবা অহেতুক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে বারবার ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছিলেন, সেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে কিনা।

এসব গ্রাহকের কাজ ছিল টাকা ওঠানো থেকে শুরু করে আয়কর রিটার্ন দাখিল করার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট প্রভৃতি সংগ্রহ। কিন্তু সেজন্য কেন তারা দীর্ঘক্ষণ ধরে অপেক্ষমান ছিলেন? কারণ ব্যাংকের ‘সার্ভার ডাউন’, তাই কোনো কাজই করা যাচ্ছিল না!

রূপালী ব্যাংকের মিরপুর-১ নম্বর সেকশন শাখায় সার্ভার ডাউনের সমস্যা যে গতকালই প্রথম কিংবা নতুন হয়েছে তা নয়। আমরা ওই শাখার গ্রাহক ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হওয়ার আগে থেকে। সুতরাং যখন থেকে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু হয়েছে তখন থেকেই দেখছি একই ব্যাপার। পরিস্থিতি এমন সঙ্গীন যে অনেকবার সেখান থেকে সব হিসাব-নিকাশ ক্লোজ করে দেওয়ার কথা পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু আমার স্ত্রীর (যিনি আসলে ওই শাখার গ্রাহক) রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিশেষ পক্ষপাত থাকায় তা আর করা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া তার এক বোন রূপালী ব্যাংকের কর্মী ছিলেন, যিনি ওই শাখায়ও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন— এটিও আলাদা দুর্বলতা।

এসব কারণে রূপালী ব্যাংকের হিসাব চালু রাখতে হয়েছে। আর সেবা নিতে গিয়েই পড়তে হয়েছে ভোগান্তিতে। প্রতিবারই আমার স্ত্রী ব্যাংকে কোনো কাজে গেলে দু-তিনবার ফোনে সমস্যার কথা আমাকে শুনতে হয়। ওই শাখার কোনো কোনো কর্মীর আচরণও গ্রাহকবান্ধব নয়। আমি নিজেও দুয়েকবার তার সঙ্গে ওই শাখায় গিয়ে তা দেখেছি। এমনও হয়েছে, সামান্য কাজের জন্য আত্মপরিচয় ব্যবহার করে শাখা ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে।

রূপালী ব্যাংক প্রযুক্তির শীর্ষে যাবে— সে তো ভালো কথা। কিন্তু তার আগে কি সার্ভারের শক্তি-সামর্থ্য বাড়ানো এবং কর্মীদের আচরণবিধির প্রতি একটু নজর দেওয়া জরুরি নয়! এই সার্ভার ডাউনের সমস্যা বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে বেশি শোনা যায়।

দ্বিতীয় যে খবরটির প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে সেটি ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) একটি ফোকাস গ্রুপের আলোচনা থেকে উদ্ভূত। ‘সবার জন্য ডিজিটাল ব্যাংকিং : আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবধান দূরীকরণ’ শীর্ষক ওই আলোচনায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমে দেশে প্রতিদিন ১০ থেকে ২০ কোটি টাকার প্রতারণামূলক লেনদেন হচ্ছে। নিঃসন্দেহে ভয়াবহ তথ্য। বর্তমানে দেশে আর্থিক খাতের মোট লেনদেনের মাত্র ২০-২৮ শতাংশ হচ্ছে ডিজিটাল মাধ্যমে। তাতেই ১০-২০ কোটির প্রতারণা! অথচ আমরা এখন যাত্রা শুরু করেছি ক্যাশলেস লেনদেনের দিকে, যেখানে পুরোটাই ডিজিটাল লেনদেনভিত্তিক। সুতরাং আরেকটু বেশি সাবধানতা বোধহয় কাম্য।

দেশে ডিজিটাল লেনদেনের বাজার দ্রুত বাড়ছে। সেই বাজার ধরার জন্য ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো। এর পাশাপাশি চিত্র হচ্ছে দেশের বেশ কয়েকটি ব্যাংক গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। মোবাইল কোম্পানিগুলো যতই ফাইভজি’র আওয়াজ দিক না কেন, সবসময় সব এলাকা থেকে নির্বিঘ্নে সামান্য একটি ফোনকলেরও নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এগুলোকে কী গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা বলা যায় না?

গত বুধবারই বোধহয় আরেকটা খবর দেখলাম। বিস্ময়কর! শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক ব্যাংক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের বেশ কয়েকজন গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে ২৭ লাখ টাকা গায়েব হয়ে গেছে। এটাও ছিল ডিজিটাল প্রতারণা। ঘটনা প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ কিছু ডিজিটাল সেবা বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কী হবে! সারা দেশে নানা ধরনের ডিজিটাল প্রতারণার তো অন্ত নেই। এ থেকে পরিত্রাণের পথ ব্যাংক এবং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেই খুঁজতে হবে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

বইমেলা দেড় মাস এগিয়ে আনা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত

কোনো বই পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হলে প্রয়োজন বাজারজাতকরণ, আলোচনার সৃষ্টি ও প্রচার। সময় সংকোচনের কারণে সেই কাজ হবে অপ্রতুল, ফলে বিক্রিও প্রভাবিত হবে। ক্ষতিগ্রস্ত হবেন লেখক ও প্রকাশক উভয়েই।

৭ দিন আগে

মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

প্যানেল আলোচনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরার পাশাপাশি সবার সম্মিলিত সহায়তায় কীভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করা যায় সেসব বিষয় উঠে আসে। ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে সমরাস্ত্র ও তহবিল সংগ্রহ, এমনকি সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা চলছিল বলে রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করা হয়।

১০ দিন আগে

রক্তাক্ত বাংলাদেশ: ১৯৭১ থেকে ২০২৫

২০০৮ থেকে ২০২৪। বাংলাদেশে শুরু হলো এক রক্তঝরানোর অধ্যায়। হত্যা, খুন, গুম, আয়নাঘর— বিরোধী দলের নেতাদের ওপর অমানুষিক, নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার। মানবতা বিসর্জন দিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে নিজের দেশের

১১ দিন আগে

সবার মুখে ফেব্রুয়ারিতে ভোট, বিরোধ জুলাই সনদ ঘিরে

তবে হঠাৎ করেই ঘুরে গেছে হাওয়া। বদলে গেছে সবার সুর। সবার মুখে মুখে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। কেউ বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতেই হবে। তবে সংস্কার নিয়ে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন দলের অবস্থান ভিন্

১১ দিন আগে