বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য: মানবতার নীরব বিশ্বাসঘাতকতা

সভ্যতা শুরু হয় যখন খাদ্য নিরাপদ থাকে, আর ভেঙে পড়ে যখন খাদ্য বিশ্বাসঘাতকতায় পরিণত হয়।

খাদ্য মানবজীবনের সবচেয়ে মৌলিক অঙ্গীকার। আহার কেবল টিকে থাকার উপায় নয়, এটি সৃষ্টির মর্যাদা ভাগাভাগি করার পবিত্র চুক্তি। অথচ বাংলাদেশে— যে দেশে ধানের মাঠ আজানের সুরে দোলে, যে দেশে নদীর মাছ আর বাগানের আম ছিল একসময় কবিতা ও গানের রসদ— আজ সেখানে খাদ্যের সঙ্গে চলছে ভয়ংকর বিশ্বাসঘাতকতা। খাদ্যে ভেজাল শুধু শরীরকে নয়, আঘাত করছে জাতির আত্মাকে।

ভেজাল খাদ্য বনাম বৈশ্বিক বিশ্বাসঘাতকতা

ক্ষুধা ধীরে হত্যা করে, ভেজাল নীরবে হত্যা করে। খাদ্যে ভেজাল কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটি বৈশ্বিক সংকট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, প্রতি বছর ৬০ কোটি মানুষ খাদ্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে চার লাখ ২০ হাজার মানুষ মারাও যায়।

কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই বিশ্বাসঘাতকতা আরও গভীর। এখানে, যেখানে কোটি মানুষ ন্যূনতম ক্যালোরির জন্য সংগ্রাম করে, সেখানে ভেজালে বিষ মেশানো খাদ্য পাওয়া এক নির্মম নিষ্ঠুরতা। মাছ সংরক্ষণে ফরমালিন, ফল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, মিষ্টিতে টেক্সটাইল রং, মশলায় ইটের গুঁড়া— এসব আর দুর্ঘটনা নয়, বরং ইচ্ছাকৃতভাবে মুনাফাকে জীবনের ওপরে বসানোর প্রবণতা। খাদ্যে ভেজাল মানে শুধু বাণিজ্যের দূষণ নয়, এটি মানবপুষ্টির পবিত্রতাকে অপবিত্র করা।

বাংলাদেশ উর্বরতা থেকে বিষাক্ততায়

যে মাটি একদিন সাম্রাজ্যকে খাইয়েছে, আজ সে তার সন্তানের জন্য নিরাপদ খাদ্য জোগাতে পারছে না।

ইতিহাসে বাংলা ছিল ‘পূর্বের ভাণ্ডার’। ধান, পাট, মাছ, মসলা এসব শুধু খাদ্য নয়, সমৃদ্ধির প্রতীক, যা মুঘলদের ধনসম্পদ ও ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের মূলে ছিল। আজ সেই বাংলার খাদ্যে ভেজাল শুধু স্বাস্থ্যকে নয়, সাংস্কৃতিক স্মৃতিকেও কলঙ্কিত করছে।

কিছু ভয়াবহ পরিসংখ্যান

বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির তথ্যে দেখা যায়, ঢাকায় পরীক্ষিত খাদ্যের ৪০ শতাংশের বেশি নমুনায় ছিল ক্ষতিকর ভেজাল। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউট জানায়, দুধ, হলুদ, মরিচগুঁড়া, মাছ, ফল থেকে শুরু করে চাল পর্যন্ত ভেজালের শিকার।

কৃষি গবেষণা কাউন্সিল বলছে, শাকসবজিতে কীটনাশকের মাত্রা আন্তর্জাতিক মানের বহু গুণ বেশি। এই প্রক্রিয়া কেবল বাজারের বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে না, বরং ক্যান্সার, কিডনি বিকল, লিভার রোগ ও স্নায়বিক অসুস্থতার বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

কৃষক ঘামে ফসল ফলায়, ভোক্তা আশা নিয়ে কিনে। কিন্তু মাঝখানের লোভের শৃঙ্খল দুজনকেই প্রতারিত করছে।

চট্টগ্রামের রহিমা, তার শিশুপুত্রের জন্য দুধ কিনেছিলেন। পরে জানা গেল, তাতে মেশানো হয়েছে ডিটারজেন্ট ও স্টার্চ। তার সন্তান আজীবন পেটের অসুখে ভুগছে।

ঢাকা শহরের রফিক বহু বছর ধরে ফরমালিন দেওয়া মাছ খেয়ে আজ কিডনির ব্যাধিতে মৃত্যুপথযাত্রী।

এগুলো শুধু উদাহরণ নয়, বরং প্রতিদিনকার নীরব আর্তনাদ। প্রমাণ করে, ভেজাল খাদ্য কেবল নীতি বা আইনি প্রশ্ন নয়, এটি সরাসরি গরিব-অসহায়-কণ্ঠহীন মানুষের বিরুদ্ধে অপরাধ। খাদ্যে ভেজাল কেবল অবৈধ নয়, এটি অমানবিক, অনৈতিক এবং ভীষণ অন্যায় ও অপরাধ।

ভেজালের দার্শনিক অপরাধ

খাদ্যে বিষ মেশানো মানে আস্থায় বিষ মেশানো, আস্থায় বিষ মানে সমাজে বিষ। ভেজাল কেবল স্বাস্থ্য সমস্যা নয়; এটি দার্শনিক অপরাধ। খাদ্য প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে সবচেয়ে পবিত্র সেতুবন্ধন। সেখানে বিষ মেশানো মানে সম্পর্কের ভিত্তিকেই নষ্ট করা।

অ্যারিস্টটল থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত দার্শনিকরা বলেছেন, একটি সমাজের নৈতিকতা প্রতিফলিত হয় তার সাধারণতম কর্মকাণ্ড অন্ন ভাগাভাগি, পানি পান বা ভাত খাওয়ায়। যখন এই কাজগুলো দূষিত হয়, তখন সমাজও দূষিত হয়।

বাংলাদেশে ভেজাল প্রমাণ করছে, অবাধ মুনাফালোভ কীভাবে নৈতিক দেউলিয়াত্বে রূপ নেয়। বাজার পরিণত হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে, যেখানে গরিব মানুষের কোনো প্রতিরক্ষা নেই। এটি শুধু অসতর্কতা নয়, এটি সভ্যতার বিরুদ্ধে অপরাধ।

বৈশ্বিক আয়না ও সাংস্কৃতিক মূল্য

বাংলাদেশকে এখনই বেছে নিতে হবে— সে কি স্মরণীয় হবে বিষাক্ত খাদ্যের দেশ হিসেবে, নাকি সোনালি শস্যের দেশ হিসেবে?

বিশ্বের অনেক দেশ এই লড়াই জিতেছে। জাপান কড়া আইন দিয়ে আস্থা ফিরিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কঠোর পরীক্ষার মাধ্যমে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে, ভারত গঠন করেছে ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি।

বাংলাদেশকেও এ পথে হাঁটতে হবে। কারণ খাদ্যে ভেজাল কেবল স্বাস্থ্য নয়—আন্তর্জাতিক সুনামকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রপ্তানি পণ্য যেমন মাছ, চিংড়ি ও কৃষিপণ্য ভেজালের কারণে সংকটে পড়ছে। আর সাংস্কৃতিক দিক থেকে, ভেজাল মানে জাতীয় গৌরব ক্ষুণ্ণ করা। সর্ষে-ইলিশ, পিঠা-পুলির মতো বাংলার খাবারগুলো বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত, সেখানে ভেজাল মানে অস্তিত্বে ভেজাল।

তাই নীতিনির্ধারক ও দায়িত্বশীলদের প্রতি জরুরি আহ্বান রাষ্ট্রের শক্তি সেনা বা ব্যাংকে নয়, নাগরিকের থালায় কতটা নিরাপদ খাদ্য আছে তাতেই মাপা হয়।

সংকটের সমাধান আসবে যেভাবে

এই সংকটের সমাধান বক্তৃতায় নয়, কর্মে। নীতিনির্ধারক, প্রশাসক, ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজকে একসঙ্গে গড়ে তুলতে হবে খাদ্যের সততার জাতীয় অঙ্গীকার। যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে—

  • কঠোর প্রয়োগ: বিএফএসএকে শক্তিশালী করা, স্বাধীন ল্যাবরেটরি গড়ে তোলা, রিয়েল-টাইম মনিটরিং;
  • শাস্তি: খাদ্যে ভেজালকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ঘোষণা করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি;
  • সচেতনতা: জনগণকে ভেজাল শনাক্ত ও প্রতিবাদে সচেতন করা;
  • চাষ থেকে টেবিল: জৈব চাষে সহায়তা, কৃষককে প্রণোদনা, কীটনাশক নির্ভরতা কমানো;
  • আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: উন্নত দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া।

ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কেবল প্রশাসনিক নয়, এটি নৈতিক নেতৃত্বের পরীক্ষা।

নির্মল অন্ন, নির্মল প্রাণ

খাদ্য নির্মল হলে দেহ শক্তিশালী হয়। খাদ্য নিরাপদ হলে জাতি শক্তিশালী হয়।

বাংলাদেশ আজ ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে। এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, লোভ কি নীরবে বিষ ঢালবে আমাদের খাদ্যে? নাকি আমরা সাহস নিয়ে নিশ্চিত করব প্রতিটি ভাতের দানা, প্রতিটি দুধের ফোঁটা, প্রতিটি আমের রস হোক বিশুদ্ধ ও নিরাপদ?

এ লড়াই শুধু স্বাস্থ্য রক্ষার নয়, এটি জাতির আত্মা রক্ষার লড়াই। যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করেছে মর্যাদার জন্য, সে জাতি কখনোই নিজের মানুষকে ভেজালে প্রতারিত হতে দিতে পারে না।

মনে রাখতে হবে, সভ্যতা টিকে থাকে নিরাপদ অন্নে, আর ভেঙে পড়ে বিষাক্ত অন্নে। খাদ্য রক্ষা মানে জীবন রক্ষা, জীবন রক্ষা মানে মানবতা রক্ষা।

লেখক: কলামিস্ট এবং একটি বেসরকারি ব্যাংকের কোম্পানি সচিব

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

অন্তর্বর্তীকালীন না, এই সরকার উপদেষ্টা সরকার

এখন আপনারা বারবার বলতেছেন গণভোট। গণভোট কে দেবে? এই সরকারের কি এখতিয়ার আছে গণভোট দেওয়ার? সে তো বলছে, আমি এই সংবিধান রক্ষা করব। কীসের গণভোট?

১১ দিন আগে

কোডিং ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের লিখিত পরীক্ষার মূল্যায়ন: একটি বিশ্লেষণ

কোডিং পদ্ধতিতে কেবল লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর বাইরে শ্রেণিকক্ষে ধারাবাহিক মূল্যায়ন বা শ্রেণি পরীক্ষা থেকে শুরু করে প্রেজেন্টেশন, মৌখিক পরীক্ষা, ব্যবহারিক পরীক্ষার কোনোটিতেই কোডিং বা ছদ্মবেশ নেওয়ার কোনো উপায় নেই!

১২ দিন আগে

নারী কমিশনকে সাক্ষাৎই দেয়নি সংবিধান সংস্কার কমিশন

একটি কমিশন আমাদের সময় দেয়নি— সংবিধান কমিশন। আমি জানি না কেন তারা সময় দেয়নি। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, সংবিধান সংস্কারে নারীদের আবার কী বলার থাকতে পারে! তারা আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না-ই করতে পারতেন, কিন্তু সময় দেওয়াটা ছিল শোভন আচরণের অংশ। সেই সৌজন্যটুকু আমরা পাইনি।

১৪ দিন আগে

প্রসঙ্গ— সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট

এবারের নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচার-প্রচারণা যে ভয়াবহ রূপ লাভ করবে, সেটা এরই মধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে। সরকার নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আচরণবিধি ঠিক রেখে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণার সার্বিক দায়-দায়িত্ব নিলে অনেক কিছু রোধ করা যেত।

১৪ দিন আগে