মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া
জার্মানির মিউনিখে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স (এমএসসি) সারা বিশ্বের যেসব জায়গায় পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ, হুমকি, পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা মানুষ্যসৃষ্ট অনিয়মে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সেসব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির পথ নির্দেশ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু হিসেবে বিবেচিত।
এমএসসি একটি অলাভজনক বেসরকারি ফাউন্ডেশন, যা ১৯৬৩ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। বেসরকারি ফাউন্ডেশন হলেও এটি জার্মান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তাধন্য একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শতাধিক দেশের সরকারপ্রধান কিংবা মনোনীত মন্ত্রী, থিংক ট্যাংক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধান, জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা সম্মেলন অংশ নেন।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারীর আগে দুই-তিনবার এমএসসিতে অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী কোভিড সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২২ সালের ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের ৫৮তম আসরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যোগ দেন।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ সলজ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানালিনা বেয়ারবক, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক, আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারপারসন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার বিল গেটস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ন্যাটো মহাসচিব, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইসরাইলের উপপ্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
মিউনিখে মূল কনফারেন্স শুরুর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি বার্লিনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে একটি কূটনৈতিক বৈঠক হয়। এমএসসির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার হিউজেনের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ন্যাটোর উপমহাসচিব, জার্মানির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টবিয়াস লিন্ডনার এবং সম্ভবত ফ্রান্স ও ইতালির দুটি থিংক ট্যাংকের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি।
দীর্ঘ প্যানেল আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে উদ্ভূত যুদ্ধ। প্রায় বছরব্যাপী যুদ্ধে তখনই ইউক্রেনের হাজার হাজার নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলো। আবার আমেরিকা ও ইউরোপের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংগঠন ন্যাটো।
প্যানেল আলোচনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরার পাশাপাশি সবার সম্মিলিত সহায়তায় কীভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করা যায় সেসব বিষয় উঠে আসে। ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে সমরাস্ত্র ও তহবিল সংগ্রহ, এমনকি সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা চলছিল বলে রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করা হয়।
প্যানেল আলোচকদের বক্তব্যের পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি সংক্ষিপ্ত মতামত ও প্রশ্ন উপস্থাপনের জন্য দাঁড়াই। প্রথমেই আমি এ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর বিরূপ প্রভাব, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে দেশে মন্দা ও মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করি।
আমি অভিমত ব্যক্ত করি, ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য শক্তিশালী করার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বড় দেশগুলো আলাপ-আলোচনা করে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারে। এ যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্ব ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ গ্যাস ও জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
আমি বলেছিলাম, জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ সলজ্ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ইউরোপীয় নেতারা যেমন ইউক্রেন সফর করে জেলেনস্কিকে সহায়তা ও উৎসাহ দিয়ে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছেন, পাশাপাশি তাদের উচিত প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগ, কিংবা প্রয়োজনে মস্কো গিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করে যুদ্ধ বন্ধে রাজি করানো। কারণ রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করতে চাইলে দীর্ঘস্থায়ী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, প্রয়োজনে মধ্যস্থতার জন্য তৃতীয় কোনো শক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
ততদিনে বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ বিশ্বের বহু দেশ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের জন্য বড় বড় দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আগ্রাসী আক্রমণের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এমএসসি বৈঠকেও যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হয় বলে আমি অভিমত ব্যক্ত করি।
আমার বক্তব্যে উপস্থিত অধিকাংশ রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে স্বস্তি ও সমর্থনের ভাব লক্ষ্য করলেও মিটিং আয়োজক ও প্যানেল আলোচকরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি বলে মনে হয়েছিল।
আমার কথা শেষ হলে মিটিংয়ের সভাপতি প্যানেল আলোচকদের জবাব দেওয়ার জন্য ইঙ্গিত করেন। প্রথমে জার্মানির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টবিয়াস লিন্ডনার দাঁড়িয়ে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে এ পর্যায়ে আলোচনা করতে যাওয়ার অর্থ— প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসী আক্রমণের বৈধতা দেওয়া। জার্মান চ্যান্সেলর সলজ্ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ফোনে পুতিনের সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধ বন্ধের জন্য অনুরোধ করেছেন। জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব এ আক্রমণের নিন্দা করেছে। যেহেতু রাশিয়া প্রথমে আক্রমণ করেছে তাই তাকেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। নইলে শক্তিপ্রয়োগ ও অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে রাশিয়াকে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য করতে হবে।
ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের হাজার হাজার নারী, বৃদ্ধ ও শিশুকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। রাশিয়ার বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বেসামরিক এলাকায় বহু অট্টলিকা ধ্বংস ও মানুষ হত্যা করেছে। তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই আসে না।
একে একে ছয় জন প্যানেল আলোচক প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলার পর এমএসসির সভাপতি ক্রিস্টোফার হিউজেন কথা বলার শুরুতেই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যখন নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন বাংলাদেশ কেন ভোটদানে বিরত থাকে?’
আমাকে সরাসরি আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা বিব্রত হলেও কালবিলম্ব না করে দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম, ‘বাংলাদেশ একা নয়, চীন-ভারতসহ প্রায় ৩৫টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। তার অর্থ এই নয় যে এসব রাষ্ট্র রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণ সমর্থন করে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন ও সহায়তা করে। তাছাড়া বর্তমানে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তায় রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।’
‘পরে আরও কয়েকটি জাতিসংঘ প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অন্যান্য অধিকাংশ দেশের সঙ্গে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাভুক্ত একটি জাহাজে রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সরঞ্জাম পাঠালে বাংলাদেশ সরকার তা আমাদের জলসীমানা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গেই আছে।’
আমার বক্তব্য শেষ না হতেই রাষ্ট্রদূতরা হাততালি দিয়ে আমাকে সমর্থন করেন। একটি থিংক ট্যাংক আলোচক বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সত্যভাষণ ও সাহসী স্বীকারোক্তির আমি প্রশংসা করি।’
সভা শেষ হলে রাষ্ট্রদূতরা আমাকে ঘিরে সমবেত হন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হরিষ বলেন, ‘ক্রিস্টোফার জার্মানির একজন পেশাদার কূটনীতিক হয়ে কীভাবে এমন অকূটনৈতিক প্রশ্ন করলেন? আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কত যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেসব বিষয়ে তো তারা কিছু বলছে না।’
কয়েকজন আরব রাষ্ট্রদূত বললেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্বিচার গণহত্যায় তো বিশ্ববিবেক এতটা সোচ্চার হচ্ছে না, যেমনটা তারা ইউক্রেনের জন্য করছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ হয়ে ইউক্রেন সরাসরি পশ্চিমা ন্যাটো জোটে যোগদানের ঘোষণা দেবে, এটা তো রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সে কারণে রাশিয়া বসে থাকতে পারে না।
পরে ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তবে দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও প্রতিকার এবং এজেন্ডাভুক্ত অন্যান্য বিষয় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে এ যুদ্ধ কেন শুরু হলো, তা পর্যালোচনা করা দরকার। অনেকের মতে, পৃথিবীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ন্যাটোকে শক্তিশালী করে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। রাশিয়ার সীমানার অন্য পারের দেশ ইউক্রেন ন্যাটো জোটভুক্ত হয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে— এ ধারণা থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শত্রুতা করে বরং ইউরোপের অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলোকে মিত্র হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। এ যুদ্ধ শুরু হতো না, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্ররোচিত না করত।
যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনীতি পঙ্গু করার উদ্যোগ নেয়। রাশিয়া যেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যবহার এবং ব্যাংকের সহায়তা না পায়, সেজন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক রাশিয়া থেকে তাদের শাখা সরিয়ে নেয়
অবশ্য রাশিয়া তার বিশ্বস্ত মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে টিকিয়ে রাখে। অন্যদিকে চীন, তুরস্ক, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগী হওয়ার কিংবা মধ্যস্থতা করার ইঙ্গিত দেয়।
১০ লক্ষাধিক সৈন্য ও মানুষ হতাহত ও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া যুদ্ধ টিকিয়ে রেখেছে প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে— এক. ইউক্রেনকে মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রভাববলয় থেকে মুক্ত করা, দুই. ইউক্রেনের কিছু অংশে বসবাসকারী রুশভাষী নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা ও প্রকারান্তরে সেসব অঞ্চল দখল করা, তিন. ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণে বাধ্য করা।
রাশিয়া এ তিনটি উদ্দেশ্য সফল করতে না পারলেও আংশিক সফল হয়েছে বলা যায়। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান এ পর্যন্ত থামিয়ে রাখতে পেরেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের রুশভাষী অঞ্চল, যেমন— দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরাসন দখল করে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল আর কখনো ইউক্রেন তার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বে ফিরে পাবে না। ২০১৪ সালে রুশদের দখল করা ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার দেশকে সমর্থন ও সহায়তা করার জন্য বিশ্বনেতাদের আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে ২০২৪ সালের ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে আমার অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। ৬০তম ওই এমএসসিতে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বেশকিছু দেশের সরকারপ্রধান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ইউক্রেনের অনুরোধে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রথমেই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণে ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতি, হতাহতের বিবরণ ও ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, সরবরাহে ঘাটতি, মন্দা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করে এ যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে মতামত জানান।
আমি অনুচ্চস্বরে রাশিয়ার সঙ্গে ‘সমঝোতা’ ও পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা (নেগোশিয়েশন) করার কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলি। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আমার কথা শুনে ফেলেন এবং চটে যান। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘কীসের সমঝোতা, কীসের নেগোসিয়েশন? ইউক্রেন আক্রমণ করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে রাশিয়া যুদ্ধাপরাধ করেছে। যুদ্ধ পুতিনকেই বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আমরা এর প্রতিশোধ নেব।’
সারা বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য এ যুদ্ধ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হলেও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার বক্তব্যে অটল থাকেন এবং রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করার জন্য আসন্ন জেনেভা সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে এ বছরের জানুয়ারিতে আসীন হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমন্ত্রণে জেলেনস্কি ওয়াশিংটন ডিসি সফরকালে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বাদানুবাদ বা তর্কে লিপ্ত হন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং একপর্যায়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দেন বলে শোনা যায়। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমার কথায় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।
পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। গত ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর গোলার্ধের অঙ্গরাজ্য আলাস্কায় আমন্ত্রণ করে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেন। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পুতিনের এ সফর এক যুগান্তকারী সাফল্য।
আলাস্কা বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যু ছাড়াও দুটি বড় দ্বিপাক্ষিক ইস্যু আলোচনা হয়েছে— এক. বাইডেন প্রশাসনের সময় বাজেয়াপ্ত হওয়া ছয়টি রুশ কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া, এবং দুই. যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালু করা।
খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দোনেৎস্ক ও লোহানস্ক রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ— এ বিষয়টি ট্রাম্পকে বোঝাতে সক্ষম হন পুতিন। সে কারণে ১৭ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে জেলেনস্কির সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় ট্রাম্প এ দুটি অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে বলেন। পুতিনের প্রশংসাও করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘রাশিয়া একটি বিরাট শক্তি।’
অন্যদিকে জেলেনস্কিকে ন্যাটোতে যোগদানের আশা ত্যাগ করতে বলেন ট্রাম্প। পুতিন-জেলেনস্কি দ্বিপাক্ষিক বা ট্রাম্পসহ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ব্যাপারেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সমর্থনে ১৭-১৮ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব, ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডারলেন বৈঠক করেন।
তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ইউক্রেনের ভূমি প্রত্যর্পণসহ ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা ত্যাগ করে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সমঝোতা করা হবে আত্মঘাতী। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
অবশ্য এর আগে ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করে সমঝোতার জন্য পুতিনকে ৫০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ না হলে রাশিয়ার ওপর আরও কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে।
একদিকে যেমন প্রেসিডেন্ট পুতিন দখল করা অঞ্চলগুলো ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে তার রাষ্ট্রের অধিকার ছাড়বেন না বলে ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের আলোচনায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, জেলেনস্কি একা নন, তার সঙ্গে ইউরোপীয় নেতারাও রয়েছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র— এই ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের বিষয়ে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভারভের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু শিগগিরই বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুতিন যুদ্ধ বিরতি চান না। কারণ তিনি জয়ের পথে রয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের জনগণ এক ও অভিন্ন, আর যেখানে রুশ সেনারা পা ফেলবে সেটাই রাশিয়া।
যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান যে উদ্যোগ, তা যুদ্ধ শুরুর পর অর্থাৎ চার বছর আগে দেখা যায়নি। অন্যদিকে জেলেনস্কি এখন যেমন বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বসতে চান, যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, এমনটি চার বছর আগে বলেননি।
পুতিনের প্রধান আপত্তি— ন্যাটোর বিস্তারকে রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। শক্তিশালী প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিত্রতা করা যে ইউক্রেনের অপরিণামদর্শী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মারাত্মক ভুল, তা আরও আগেই অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এসব উদ্যোগ সফল হওয়ার জন্য সব পক্ষের যে সদিচ্ছা ও আগ্রহ থাকা প্রয়োজন, তা এখন দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বিমাণ আক্রমণ জোরদার করেছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পণ ছাড়া পুতিন এ যুদ্ধ থামাবেন না বলেই মনে হচ্ছে।
একটি নিষ্ফল যুদ্ধ সাড়ে চার বছর ধরে চলছে। এ যেন বিশ্ব বিবেকেরই ব্যর্থতা, যার ফলাফল বিবদমান দেশগুলোতে চরম মানবিক বিপর্যয় এবং সারা বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রদূত
জার্মানির মিউনিখে প্রতিবছর অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্স (এমএসসি) সারা বিশ্বের যেসব জায়গায় পারস্পরিক যুদ্ধবিগ্রহ, হুমকি, পরিবেশ বিপর্যয় কিংবা মানুষ্যসৃষ্ট অনিয়মে শান্তি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সেসব আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তির পথ নির্দেশ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেন্যু হিসেবে বিবেচিত।
এমএসসি একটি অলাভজনক বেসরকারি ফাউন্ডেশন, যা ১৯৬৩ সাল থেকে কার্যক্রম শুরু করে। বেসরকারি ফাউন্ডেশন হলেও এটি জার্মান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তাধন্য একটি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শতাধিক দেশের সরকারপ্রধান কিংবা মনোনীত মন্ত্রী, থিংক ট্যাংক, আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার প্রধান, জাতিসংঘের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা সম্মেলন অংশ নেন।
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোভিড-১৯ মহামারীর আগে দুই-তিনবার এমএসসিতে অংশ নিয়েছিলেন। বিশ্বব্যাপী কোভিড সংক্রমণের কারণে ২০২১ সালে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। ২০২২ সালের ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের ৫৮তম আসরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এম এ মোমেন ও প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যোগ দেন।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ সলজ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানালিনা বেয়ারবক, যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি, ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক, আফ্রিকান ইউনিয়ন কমিশনের চেয়ারপারসন, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ার বিল গেটস, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট, পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ন্যাটো মহাসচিব, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ইসরাইলের উপপ্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।
মিউনিখে মূল কনফারেন্স শুরুর আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি বার্লিনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে একটি কূটনৈতিক বৈঠক হয়। এমএসসির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফার হিউজেনের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় প্যানেল আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী, ন্যাটোর উপমহাসচিব, জার্মানির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টবিয়াস লিন্ডনার এবং সম্ভবত ফ্রান্স ও ইতালির দুটি থিংক ট্যাংকের উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি।
দীর্ঘ প্যানেল আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে উদ্ভূত যুদ্ধ। প্রায় বছরব্যাপী যুদ্ধে তখনই ইউক্রেনের হাজার হাজার নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু নিহত হয়েছে। এ যুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ইত্যাদি দিয়ে সহায়তা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলো। আবার আমেরিকা ও ইউরোপের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সংগঠন ন্যাটো।
প্যানেল আলোচনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরার পাশাপাশি সবার সম্মিলিত সহায়তায় কীভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করা যায় সেসব বিষয় উঠে আসে। ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে সমরাস্ত্র ও তহবিল সংগ্রহ, এমনকি সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা চলছিল বলে রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করা হয়।
প্যানেল আলোচকদের বক্তব্যের পর শুরু হয় প্রশ্নোত্তর পর্ব। অস্ট্রেলিয়া ও আফ্রিকার একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে আমি সংক্ষিপ্ত মতামত ও প্রশ্ন উপস্থাপনের জন্য দাঁড়াই। প্রথমেই আমি এ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, সারা বিশ্বের অর্থনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যে এর বিরূপ প্রভাব, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে দেশে মন্দা ও মূল্যস্ফীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করি।
আমি অভিমত ব্যক্ত করি, ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য শক্তিশালী করার পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে ইউরোপের বড় দেশগুলো আলাপ-আলোচনা করে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারে। এ যুদ্ধের ফলে সারা বিশ্ব ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জার্মানিসহ ইউরোপের অনেক দেশ গ্যাস ও জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
আমি বলেছিলাম, জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ সলজ্ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির পুতিনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ইউরোপীয় নেতারা যেমন ইউক্রেন সফর করে জেলেনস্কিকে সহায়তা ও উৎসাহ দিয়ে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছেন, পাশাপাশি তাদের উচিত প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে যোগাযোগ, কিংবা প্রয়োজনে মস্কো গিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করে যুদ্ধ বন্ধে রাজি করানো। কারণ রাশিয়াকে যুদ্ধে পরাজিত করতে চাইলে দীর্ঘস্থায়ী তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তাই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে, প্রয়োজনে মধ্যস্থতার জন্য তৃতীয় কোনো শক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।
ততদিনে বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ বিশ্বের বহু দেশ যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি স্থাপনের জন্য বড় বড় দেশগুলোর প্রতি আহবান জানিয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ আগ্রাসী আক্রমণের জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাবের পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এমএসসি বৈঠকেও যুদ্ধ বন্ধে মধ্যস্থতার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হয় বলে আমি অভিমত ব্যক্ত করি।
আমার বক্তব্যে উপস্থিত অধিকাংশ রাষ্ট্রদূতদের মধ্যে স্বস্তি ও সমর্থনের ভাব লক্ষ্য করলেও মিটিং আয়োজক ও প্যানেল আলোচকরা সন্তুষ্ট হতে পারেননি বলে মনে হয়েছিল।
আমার কথা শেষ হলে মিটিংয়ের সভাপতি প্যানেল আলোচকদের জবাব দেওয়ার জন্য ইঙ্গিত করেন। প্রথমে জার্মানির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী টবিয়াস লিন্ডনার দাঁড়িয়ে বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে এ পর্যায়ে আলোচনা করতে যাওয়ার অর্থ— প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইউক্রেনে আগ্রাসী আক্রমণের বৈধতা দেওয়া। জার্মান চ্যান্সেলর সলজ্ ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ ফোনে পুতিনের সঙ্গে কথা বলে যুদ্ধ বন্ধের জন্য অনুরোধ করেছেন। জাতিসংঘসহ সারা বিশ্ব এ আক্রমণের নিন্দা করেছে। যেহেতু রাশিয়া প্রথমে আক্রমণ করেছে তাই তাকেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। নইলে শক্তিপ্রয়োগ ও অর্থনৈতিক অবরোধের মাধ্যমে রাশিয়াকে পরাজয় স্বীকারে বাধ্য করতে হবে।
ইউক্রেনের উপপ্রধানমন্ত্রী আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের হাজার হাজার নারী, বৃদ্ধ ও শিশুকে হত্যা করে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। রাশিয়ার বিমান বাহিনী বোমাবর্ষণ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বেসামরিক এলাকায় বহু অট্টলিকা ধ্বংস ও মানুষ হত্যা করেছে। তাদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নই আসে না।
একে একে ছয় জন প্যানেল আলোচক প্রায় অভিন্ন সুরে কথা বলার পর এমএসসির সভাপতি ক্রিস্টোফার হিউজেন কথা বলার শুরুতেই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘আচ্ছা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যখন নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তখন বাংলাদেশ কেন ভোটদানে বিরত থাকে?’
আমাকে সরাসরি আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা বিব্রত হলেও কালবিলম্ব না করে দাঁড়িয়ে জবাব দিলাম, ‘বাংলাদেশ একা নয়, চীন-ভারতসহ প্রায় ৩৫টি রাষ্ট্র ভোটদানে বিরত থাকে। তার অর্থ এই নয় যে এসব রাষ্ট্র রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণ সমর্থন করে। বাংলাদেশের কথা যদি বলি, তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সমর্থন ও সহায়তা করে। তাছাড়া বর্তমানে ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তায় রাশিয়া বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।’
‘পরে আরও কয়েকটি জাতিসংঘ প্রস্তাব ও সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ অন্যান্য অধিকাংশ দেশের সঙ্গে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাভুক্ত একটি জাহাজে রাশিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সরঞ্জাম পাঠালে বাংলাদেশ সরকার তা আমাদের জলসীমানা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কাজেই বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যবস্থার সঙ্গেই আছে।’
আমার বক্তব্য শেষ না হতেই রাষ্ট্রদূতরা হাততালি দিয়ে আমাকে সমর্থন করেন। একটি থিংক ট্যাংক আলোচক বলেন, ‘বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সত্যভাষণ ও সাহসী স্বীকারোক্তির আমি প্রশংসা করি।’
সভা শেষ হলে রাষ্ট্রদূতরা আমাকে ঘিরে সমবেত হন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হরিষ বলেন, ‘ক্রিস্টোফার জার্মানির একজন পেশাদার কূটনীতিক হয়ে কীভাবে এমন অকূটনৈতিক প্রশ্ন করলেন? আমেরিকাসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কত যে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে সেসব বিষয়ে তো তারা কিছু বলছে না।’
কয়েকজন আরব রাষ্ট্রদূত বললেন, ফিলিস্তিনে ইসরাইলের নির্বিচার গণহত্যায় তো বিশ্ববিবেক এতটা সোচ্চার হচ্ছে না, যেমনটা তারা ইউক্রেনের জন্য করছে। রাশিয়ার প্রতিবেশী দেশ হয়ে ইউক্রেন সরাসরি পশ্চিমা ন্যাটো জোটে যোগদানের ঘোষণা দেবে, এটা তো রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সে কারণে রাশিয়া বসে থাকতে পারে না।
পরে ১৮ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি মিউনিখে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। তবে দেশে দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ও প্রতিকার এবং এজেন্ডাভুক্ত অন্যান্য বিষয় নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করার আগে এ যুদ্ধ কেন শুরু হলো, তা পর্যালোচনা করা দরকার। অনেকের মতে, পৃথিবীতে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একক পরাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং ন্যাটোকে শক্তিশালী করে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই আমেরিকা ও ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। রাশিয়ার সীমানার অন্য পারের দেশ ইউক্রেন ন্যাটো জোটভুক্ত হয়ে রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠবে— এ ধারণা থেকে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সঙ্গে শত্রুতা করে বরং ইউরোপের অন্যান্য শক্তিশালী দেশগুলোকে মিত্র হিসেবে ভেবে নিয়েছিলেন। এ যুদ্ধ শুরু হতো না, যদি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্ররোচিত না করত।
যুদ্ধ শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনীতি পঙ্গু করার উদ্যোগ নেয়। রাশিয়া যেন বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে না পারে এবং বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের ব্যবহার এবং ব্যাংকের সহায়তা না পায়, সেজন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। বড় বড় আন্তর্জাতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক রাশিয়া থেকে তাদের শাখা সরিয়ে নেয়
অবশ্য রাশিয়া তার বিশ্বস্ত মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে বিকল্প ব্যবস্থায় ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যায়। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানিসহ ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহ করে ইউক্রেনকে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে টিকিয়ে রাখে। অন্যদিকে চীন, তুরস্ক, ভারত প্রভৃতি রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগী হওয়ার কিংবা মধ্যস্থতা করার ইঙ্গিত দেয়।
১০ লক্ষাধিক সৈন্য ও মানুষ হতাহত ও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়া যুদ্ধ টিকিয়ে রেখেছে প্রধানত তিনটি উদ্দেশ্য সামনে রেখে— এক. ইউক্রেনকে মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রভাববলয় থেকে মুক্ত করা, দুই. ইউক্রেনের কিছু অংশে বসবাসকারী রুশভাষী নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষা করা ও প্রকারান্তরে সেসব অঞ্চল দখল করা, তিন. ইউক্রেনকে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণে বাধ্য করা।
রাশিয়া এ তিনটি উদ্দেশ্য সফল করতে না পারলেও আংশিক সফল হয়েছে বলা যায়। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান এ পর্যন্ত থামিয়ে রাখতে পেরেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের রুশভাষী অঞ্চল, যেমন— দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরাসন দখল করে নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল আর কখনো ইউক্রেন তার রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বে ফিরে পাবে না। ২০১৪ সালে রুশদের দখল করা ক্রিমিয়ার ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা-সমাবেশে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার দেশকে সমর্থন ও সহায়তা করার জন্য বিশ্বনেতাদের আহবান জানান। এ প্রসঙ্গে ২০২৪ সালের ১৬ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে আমার অভিজ্ঞতা প্রণিধানযোগ্য। ৬০তম ওই এমএসসিতে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মূল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারপ্রধান বেশকিছু দেশের সরকারপ্রধান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। ইউক্রেনের অনুরোধে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গেও একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে প্রথমেই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি রাশিয়ার আগ্রাসী আক্রমণে ইউক্রেনের ক্ষয়ক্ষতি, হতাহতের বিবরণ ও ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সরকারপ্রধান যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি, সরবরাহে ঘাটতি, মন্দা ইত্যাদি বিষয়ে আলোকপাত করে এ যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষে মতামত জানান।
আমি অনুচ্চস্বরে রাশিয়ার সঙ্গে ‘সমঝোতা’ ও পারস্পরিক আলাপ-আলোচনা (নেগোশিয়েশন) করার কথা বলার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে বলি। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আমার কথা শুনে ফেলেন এবং চটে যান। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, ‘কীসের সমঝোতা, কীসের নেগোসিয়েশন? ইউক্রেন আক্রমণ করে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে রাশিয়া যুদ্ধাপরাধ করেছে। যুদ্ধ পুতিনকেই বন্ধ করতে হবে। অন্যথায় আমরা এর প্রতিশোধ নেব।’
সারা বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য এ যুদ্ধ বন্ধ হওয়া প্রয়োজন বলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোর দেওয়া হলেও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার বক্তব্যে অটল থাকেন এবং রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধে বাধ্য করার জন্য আসন্ন জেনেভা সম্মেলনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে এ বছরের জানুয়ারিতে আসীন হওয়ার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ করবেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমন্ত্রণে জেলেনস্কি ওয়াশিংটন ডিসি সফরকালে হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বাদানুবাদ বা তর্কে লিপ্ত হন। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন এবং একপর্যায়ে হোয়াইট হাউজ থেকে বের করে দেন বলে শোনা যায়। এ প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আমার কথায় প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার কথা মনে পড়ে।
পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। গত ১৫ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর গোলার্ধের অঙ্গরাজ্য আলাস্কায় আমন্ত্রণ করে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেন। যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পুতিনের এ সফর এক যুগান্তকারী সাফল্য।
আলাস্কা বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যু ছাড়াও দুটি বড় দ্বিপাক্ষিক ইস্যু আলোচনা হয়েছে— এক. বাইডেন প্রশাসনের সময় বাজেয়াপ্ত হওয়া ছয়টি রুশ কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া, এবং দুই. যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া সরাসরি বিমান যোগাযোগ পুনরায় চালু করা।
খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ দোনেৎস্ক ও লোহানস্ক রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ— এ বিষয়টি ট্রাম্পকে বোঝাতে সক্ষম হন পুতিন। সে কারণে ১৭ আগস্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে জেলেনস্কির সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় ট্রাম্প এ দুটি অঞ্চল রাশিয়াকে ছেড়ে দিতে বলেন। পুতিনের প্রশংসাও করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘রাশিয়া একটি বিরাট শক্তি।’
অন্যদিকে জেলেনস্কিকে ন্যাটোতে যোগদানের আশা ত্যাগ করতে বলেন ট্রাম্প। পুতিন-জেলেনস্কি দ্বিপাক্ষিক বা ট্রাম্পসহ ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ব্যাপারেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সমর্থনে ১৭-১৮ আগস্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপের প্রভাবশালী দেশ জার্মানির চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মেৎস, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার স্টাব, ন্যাটো মহাসচিব মার্ক রুট ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভনডারলেন বৈঠক করেন।
তারা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, ইউক্রেনের ভূমি প্রত্যর্পণসহ ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির পরিকল্পনা ত্যাগ করে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের সমঝোতা করা হবে আত্মঘাতী। এতে ইউরোপের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
অবশ্য এর আগে ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করে সমঝোতার জন্য পুতিনকে ৫০ দিন সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প হুমকি দিয়েছেন, যুদ্ধ বন্ধ না হলে রাশিয়ার ওপর আরও কঠিন অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হবে।
একদিকে যেমন প্রেসিডেন্ট পুতিন দখল করা অঞ্চলগুলো ছাড়বেন না বলে জানিয়েছেন, অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে তার রাষ্ট্রের অধিকার ছাড়বেন না বলে ঘোষণা করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ইউরোপীয় নেতাদের আলোচনায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বলেছেন, জেলেনস্কি একা নন, তার সঙ্গে ইউরোপীয় নেতারাও রয়েছেন।
রাশিয়া-ইউক্রেন-যুক্তরাষ্ট্র— এই ত্রিপাক্ষিক শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের বিষয়ে মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভারভের সঙ্গে কথা বলেছেন। কিন্তু শিগগিরই বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট পুতিনের পক্ষ থেকে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুতিন যুদ্ধ বিরতি চান না। কারণ তিনি জয়ের পথে রয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের জনগণ এক ও অভিন্ন, আর যেখানে রুশ সেনারা পা ফেলবে সেটাই রাশিয়া।
যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান যে উদ্যোগ, তা যুদ্ধ শুরুর পর অর্থাৎ চার বছর আগে দেখা যায়নি। অন্যদিকে জেলেনস্কি এখন যেমন বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বসতে চান, যুদ্ধ বন্ধ করতে চান, এমনটি চার বছর আগে বলেননি।
পুতিনের প্রধান আপত্তি— ন্যাটোর বিস্তারকে রাশিয়ার সীমানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া। শক্তিশালী প্রতিবেশীকে অবজ্ঞা করে ন্যাটোতে যোগদানের ইচ্ছা এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিত্রতা করা যে ইউক্রেনের অপরিণামদর্শী প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মারাত্মক ভুল, তা আরও আগেই অনুধাবন করা প্রয়োজন ছিল।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তবে এসব উদ্যোগ সফল হওয়ার জন্য সব পক্ষের যে সদিচ্ছা ও আগ্রহ থাকা প্রয়োজন, তা এখন দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি রাশিয়া ইউক্রেনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার বিমাণ আক্রমণ জোরদার করেছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির পরাজয় স্বীকার ও আত্মসমর্পণ ছাড়া পুতিন এ যুদ্ধ থামাবেন না বলেই মনে হচ্ছে।
একটি নিষ্ফল যুদ্ধ সাড়ে চার বছর ধরে চলছে। এ যেন বিশ্ব বিবেকেরই ব্যর্থতা, যার ফলাফল বিবদমান দেশগুলোতে চরম মানবিক বিপর্যয় এবং সারা বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
লেখক: সাবেক সিনিয়র সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রদূত
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন জামায়াতে ইসলামি। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা গেলে জামায়াত তখন বিএনপির শক্ত বা সবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি অন্যান্য ইসলামি দলগুলো সঙ্গে নিয়ে জামায়াত দরকষাকষির সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারে।
১৭ দিন আগেঝিনাইদহের কৃষক শ্রী হরিপদ কাপালীর হাতে হরি ধানের আবিষ্কার দুই দশক আগে যার কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ হয়নি কেবল দারিদ্রতার কারনে। এখানে উল্লেখ্য যে হরিপদ কাপালী ১৯২২ সালে ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার এনায়েতপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ৬ই জুলাই নিজ শ্বশুরালয় আহসান নগর গ্রামে মৃত্
১৭ দিন আগেগত বছরের জুনে ব্যাংক ঋণের সুদহার ছিল ৯ শতাংশ, যা বর্তমানে ১৪–১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শোনা যাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরও এক দফা নীতি সুদহার বৃদ্ধির পরিকল্পনা করছে। এমন দফায় দফায় সুদহার বৃদ্ধির ফলে বড় প্রতিষ্ঠানও চাপে পড়তে পারে এবং বহু প্রতিষ্ঠান রুগ্ন তালিকাভুক্ত হবে। উল্লেখযোগ্য, ২০২০ সালের এপ্রিলে স
১৭ দিন আগেকোচিং সংস্কৃতি শুধু শিক্ষাকে পুনর্নির্ধারণ করেনি, পরিবারের ওপর এক অসহনীয় আর্থিক বোঝাও চাপিয়েছে। প্রতিষ্টানের শিক্ষকদের যথাযথ আন্তরিকতার অভাবের কারণেই অভিবাবকের তাদের সন্তারদের নিয়ে হতাশায় থাকেন।
১৯ দিন আগে