দেশপ্রেমের জন্য খালেদা জিয়ার নাম ইতিহাসে লেখা থাকবে

অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আকস্মিক প্রয়াণের পর বিএনপি যখন চরম অস্তিত্ব সংকটে, তখন এক সাধারণ গৃহবধূর কাঁধে এসে পড়েছিল বিশাল এক রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ভার। অনেকে হয়তো তখন ভেবেছিলেন, তিনি পারবেন না। কিন্তু আমি দেখেছি, কীভাবে তিনি সেই সংকটকাল থেকে দলটিকে নিজের হাতে আগলে রেখেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন।

খালেদা জিয়া রাজনীতিতে এসেছিলেন কেবল বিএনপিকে ধরে রাখার জন্য নয়, বরং এই দলটিকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত করতে এবং তিনি তাতে দারুণভাবে সফল হয়েছিলেন।

খালেদা জিয়ার এই দীর্ঘ পথচলাকে আমি মূল্যায়ন করি তার গভীর দেশপ্রেম দিয়ে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রতিটি সংগ্রামে তার নাম ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তিনি বলতেন, ‘এ দেশই আমার ঠিকানা, আর এ দেশের জনগণই আমার আত্মীয়।’

এই একটি বাক্যের মধ্যেই মিশে ছিল খালেদা জিয়ার আজীবনের ত্যাগ ও অসীম কষ্ট স্বীকারের গল্প। তার ওপর কম অত্যাচার-নির্যাতন হয়নি, কিন্তু তিনি পাহাড়ের মতো দৃঢ়তা নিয়ে সবকিছু মোকাবিলা করেছেন।

ব্যক্তি হিসেবে আমাকে যখন খালেদা জিয়ার কথা কেউ জিজ্ঞাসা করেন, আমার চোখে সবার আগে ভেসে ওঠে তার অসীম ধৈর্য ও সংযমের ছবি। রাজনীতির মাঠে শেখ হাসিনা তাকে কতভাবে অপমান করেছেন, কতভাবে আঘাত করেছেন, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার, খালেদা জিয়ার মুখ থেকে কোনোদিন একটিও কটূ কথা বা রুচি বহির্ভূত মন্তব্য বের হয়নি।

মানুষের স্বভাব হলো কেউ আক্রমণ করলে পালটা আক্রমণ করা, প্রতিক্রিয়া দেখানো। কিন্তু খালেদা জিয়ার মধ্যে সেই নেতিবাচকতা আমি কোনোদিন দেখিনি। আমাদের দেশের বর্তমানের যে নোংরা রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে একে অন্যের বিরুদ্ধে কুৎসা রটায়, সেখানে তার এই ‘সিবিলিটি’ বা উচ্চমার্গের ভদ্রতা ছিল এক বিরল গুণ।

এর পাশাপাশি খালেদা জিয়ার ছিল এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও ‘গাট ফিলিং’। আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি, কঠিন সময়েও তিনি ঠিকই বুঝতে পারতেন কখন কী করতে হবে।

আমাদের সমাজ যখন প্রবল এক ধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখন একজন নারী হিসেবে তার তিনবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া কেবল সৌভাগ্য নয়, বরং এক বিরাট অর্জন। তবে তিনি তথাকথিত কোনো ‘র‍্যাডিক্যাল’ নারী আন্দোলনের পথে হাঁটেননি; বরং বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপট ও মূল্যবোধকে সম্মান জানিয়েই নিজেকে রাজনীতির শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

আজ আমরা নারী উন্নয়নের যে বড় বড় বুলি শুনি, তার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তিনিই। নারী শিক্ষার প্রসারে তার প্রবর্তিত উপবৃত্তি প্রকল্প ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে নারীদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির পদক্ষেপগুলো ছিল বৈপ্লবিক। বর্তমান সময়ে নারীরা যে জনসমক্ষে বা রাজনীতিতে আসার সাহস পাচ্ছে, তার পেছনে খালেদা জিয়া একজন অনন্য অনুকরণীয় ব্যক্তি হয়ে থাকবেন।

সামগ্রিকভাবে বললে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক অনন্য ও মহৎ ব্যক্তিত্ব খালেদা জিয়া। তার দেশপ্রেম এবং মাটির প্রতি টান প্রশ্নাতীত।

আরও একটি বিষয় না বললেই নয়, তিনি ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সম্পূর্ণ দুর্নীতিমুক্ত। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের শাসনামল বা দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তার ব্যক্তিগত কোনো দুর্নীতির খবর কেউ কোনোদিন শোনেনি। একটি দলের সর্বোচ্চ নেত্রী হয়েও এমন স্বচ্ছ জীবনযাপন সত্যিই বিরল ও অনুকরণীয়।

আজ যখন সামনে জাতীয় নির্বাচন ও রাজনীতির এক উত্তাল সময়, তখন খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতি বিএনপির জন্য এক বিশাল ক্ষতি। তিনি ছিলেন একটি ছাতার মতো, যার ছায়াতলে পুরো দল ঐক্যবদ্ধ থাকত। এখন তার অবর্তমানে সব দায়ভার এসে পড়েছে তারেক রহমানের ওপর।

বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বকেন্দ্রিক, তাই এখন তারেক রহমান কীভাবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জোরালো প্রত্যাশাকে ধারণ করে বিএনপিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, সেটিই হবে আগামী দিনের বড় চ্যালেঞ্জ। তবে যে আদর্শ আর সংগ্রাম খালেদা জিয়া রেখে গেলেন, তা চিরকাল এ দেশের মানুষের মনে বেঁচে থাকবে।

লেখক: রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং সাবেক অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন: নতুন রাজনীতির সূচনা

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি বিরল ঘটনা— দীর্ঘ সময় দেশের বাইরে থেকেও একজন নেতা কেবল ভিডিও কনফারেন্স ও সাংগঠনিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি বিশাল রাজনৈতিক জোটকে অভিন্ন লক্ষ্যে স্থির রাখতে পেরেছেন। তিনি হয়ে উঠেছিলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের এক অদৃশ্য কিন্তু শক্তিশালী সুতো, যা সকল মতের মানুষকে একই প

৬ দিন আগে

প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচলে অর্থনীতি

ব্যাংক খাতের কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্দশা কাটেনি। বিগত দিনগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারের ইচ্ছানুযায়ী পরিচালিত হয়েছে, যা ব্যাংক ব্যবস্থাকে দুর্বল করে তুলেছে। এ খাতে সুশাসন ফেরাতে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবায়ন করা গেলে ব্যাংক খাত আরও ভালো করবে।

৭ দিন আগে

অপারেশন মাউন্টেন ঈগল: মুক্তিযুদ্ধে তিব্বতী গেরিলা

কর্ণফুলীর স্রোতধারার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গোপসাগরের আছড়ে পড়া উত্তাল ঢেউ। সেই আনন্দের মাঝেই হঠাৎ যোগ দেয় একদল সশস্ত্র তিব্বতীয় গেরিলা। বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আর কর্ণফুলীর স্রোত যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। আনন্দে উদ্বেলিত জনতা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তিব্বতীয়দের দিকে।

১৪ দিন আগে

সব সংকট-শঙ্কার মধ‍্যেও বিজয়ের আশা ছাড়িনি

তখন আমাদের চিহ্নিত শত্রু ছিল হানাদার বাহিনী। তাদের সঙ্গে আরও চিহ্নিত হয়েছিল তাদের এ দেশীয় ‘কোলাবোরেটর’ বা সহযোগীরা, যারা ছিল মূলত রাজাকার, আলবদর বা আল শামস বাহিনীর। এরাও চিহ্নিত ছিল। এদের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ একাট্টা হয়ে সংগ্রাম করেছে। সেই সংগ্রাম রক্তক্ষয়ী ছিল, বহু মানুষ অকাতরে শহিদ হয়েছে।

১৫ দিন আগে