মতামত

কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের এখনই সময়

ড. মিহির কুমার রায়
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৪: ৩৮

কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে এবং দেশের কৃষিখাতকে টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে একটি স্বাধীন ও কার্যকর কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক- খানি বাংলাদেশ। গত ১৭ জুলাই রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার সেন্টারে আয়োজিত এক মিডিয়া ক্যাফে অনুষ্ঠানে এই দাবি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানের আয়োজন করে খানি ও পার্টিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাকশন নেটওয়ার্ক (প্রাণ)। কৃষকদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরে খানি মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ তুলে ধরেন, যেখানে নীতিনির্ধারণ ও বাস্তব বাস্তবতার মাঝে বিস্তর ফারাক চিহ্নিত করা হয়।

কৃষি দেশের সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান খাত হলেও এখানকার উৎপাদকদের জন্য কোনো নির্ধারিত মূল্য নীতি নেই, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। পণ্যের অস্থির বাজারমূল্য, উৎপাদন ব্যয় না ওঠা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনাকে বক্তারা এই সংকটের চরম বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত করেন। এখানে উল্লেখ্য সম্প্রতি মেহেরপুরের পেঁয়াজ চাষি সাইফুল শেখ মহাজনী ও এনজিও ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এই কৃষক প্রতি মন পেয়াজ ৬০০ টাকা দরে বিক্রি করার পর যখন দেখেন, সেই পেয়াজ ব্যাপারি সপ্তাহ পর ২০০০ টাকা প্রতিমন দরে বিক্রি করছে, তখন যন্ত্রণাদগ্ধ হওয়ারই কথা। তারপর সাইফুল শেখের কন্যা রোফেজা বলেন, আমার বাবার মত কৃষক যদি আত্মহত্যা করে তা হলে মানুষের অন্ন জোগান দেবে কে? মাত্র ছয় হাজার টাকা কৃষি ঋণ নিয়ে কৃষক জেলে গেছে, এরকম নজিরও আছে।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তা হলে দেখা যায়, প্রাচীন বাংলার সময়কাল থেকে রাজাবাদশাদের আমল, বৃটিশ, পাকিস্তান আমল এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশেও কৃষকের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্ন ঘটেনি। ব্যবধান শুধু সেকালের শাসকগোষ্ঠী আর একালের ক্ষমতাধরদের নিপীড়ণ।পুঁথিগত ইতিহাস বলছে চর্যাপদে আছে সমাজব্যবস্থার বৈষম্যের কথা যেমন উচ্চশ্রেণি ও নিম্নশ্রেণি ( কৃষক, তাঁতী, জেলে, মাঝি, শিকারী)। তারপর সুলতানী আমলটা ছিল কৃষি সমৃদ্ধ। তবু কৃষকের কোনো সমৃদ্ধি হয়নি, কারণ জমির অভাব, বগর্চাষীদেরও রাজস্ব দিতে হতো, ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে কর আদায়ে জুলুম চলত ইত্যাদি।

১৮৭৬ সালের মন্বন্তর কোণো প্রাকৃতিক কারণে হয়নি, বরং অব্যবস্থা ও রাজস্ব নীতির নিপীড়নের কারণে হয়েছিল। সে দুর্ভিক্ষে দেশের এক তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এর পর বেশ কিছু সময়ে অধিকাংশ কৃষি জমি পতিত ছিল, সেটা ছিল খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বৃটিশ শাসকরা, পাঁচশালা, দশ শালা, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তসহ যত নীতিমালা গ্রহণ করেছিল সবই ছিল কৃষকের স্বার্থ পরিপন্থী। ১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর বিপুল পরিমাণ জমি সরকারের অধীনে চলে আসে। আর যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সেগুলো বগর্চাষীদের আওতায় চলে আসে। তারপর আসে ১৯৭২ সালের মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধে অংশগ্রহনকারীদের ৭১ শতাংশেই ছিল কৃষক।

সময়ের আবর্তে এক সময় যেখানে কৃষিকাজে নিয়োজিত হাউজহোল্ডের সংখ্যা ছিল ৯০ শতাংশ, বতর্মানে এসে দাড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে, যা খাদ্যনিরাপত্তার জন্য হুমকি। চলতি বছরের বাজেটে কৃষি শস্য খাতের অংশ মাত্র ৩.৪%, যা টাকার অংকে দাড়ায় ২৭ হাজার ২২৪ কোটি। আবার কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে কম। কৃষি খাতের নিম্নগামী প্রবৃদ্ধির অন্যতম কারণ কৃষক তার পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। এর একটি কারণ হলো মূল্য নিয়ন্ত্রয়ণের কোনো বিধিবদ্ধ সংন্থা নেই। যার কারণেই কার্যকর কৃষি মূল্য কমিশন গঠনের প্রসঙ্গ এসেছে, যা সময়ের দাবি।

সরকার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে একটি কমিশন গঠনের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করছে। ভারতের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য ব্যবস্থার আলোকে বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থাকলেও কৌশলগত পরিকল্পনা ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। কৃষকদের জন্য এ বছর ৩৭ হাজার কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণ করা হয়েছে এবং ধান-চালের দাম নির্ধারণে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা কৃষকদের জন্য শস্য বীমা চালু, আধুনিক সংরক্ষণব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বাজার ব্যবস্থাপনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানোর আহ্বান জানান। তারা বলেন, কৃষি মূল্য কমিশন গঠন শুধু কৃষকদের আত্মহত্যা রোধ করবে না, বরং তা গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙা করে সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে। তার মানে প্রাইস কমিশনের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তবে কমিশনে কৃষকদের সক্রিয় প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করাই বড় চ্যালেঞ্জ।

এখন প্রশ্ন হলো এই কমিশনের কাঠামো কি হবে? তা হলে বতর্মান অবস্থাটা পযর্লোচনার দাবি রাখে। দুটি বিষয় যেমন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ও কৃষি পণ্য বাজার নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৬৪ বর্তমানে প্রচলিত থাকলেও এদের কাযর্কারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তবে কোনো ভাবেই বলা যাবে না যে এগুলো সঠিক সময়ে সঠিকক কাজটি করছে বা করতে পেরেছে। এখন সময়ের পরিক্রমায় একটি কমিশনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেটা হতে হবে একটি সংবিধিবদ্ধ স্বাধীন সংস্থা। সংস্থাটি পণ্যের মুল্য উঠানামা, কূষি বাজার নিয়ন্ত্রণে পরামর্শ, বাজার ম্যানিপুলেশন ও কৃষকের পণ্যের সঠিক মূল্য নির্ধরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। এর অংশ হিসাবে কমিশন বাজারের গতিবিধি বিশ্লেষন,উৎপাদন খরচ বিবেচনা এবং বিভিন্ন কৃষি পণ্যের উৎপাদন খরচ (এমএসপি) নিণর্য় করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাছাড়াও কৃষি সাবসিডি, মূল্য সংযোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিও কমিশন দেখবে। এতে কৃষকরা একটি স্থিতিশীল বাজার মূল্য পাবে যা তার জীবনের নিরাপত্তার জন্য সহায়ক। এখন এই কমিশনের কাঠামো কিরুপ হবে তা নিয়ে আলোচনা করা যায়।এ বিষয়ে ভারতের উদাহরণ থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এই কমিশন ১৯৬৫ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ শুরু করে যা বাংলাদশ জন্মেরও ৬ বছর আগে। এই কমিশন ছয় জন সদস্য দ্বরা পরিচালিত যেমন- চেয়ারম্যান, সদস্য সচিব, দাপ্তরিক সদস্য, দুজন কৃষক সমস্য। এই কমিশন ভারতের ২২টি কৃষি পণ্যের ওপর ন্যূনতম মূল্য ঠিক করে দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ৭টি সিরিয়েল, ৫টি ডাল জাতীয়, ৭টি তৈল জাতীয় ও ৩টি বাণিজ্যিক ফসল। তা হলে বাংলাদেশ কেন মাত্র ৩টি ফসল যেমন চাল, পাট ও গমের উপর ন্যূনতম মূল্য নিরুর্পন করে দেয়?

কৃষক যদি তার ফসলটা সংরক্ষণ করতে পারেন, তাহলে তারা পরবর্তী সময়ে ন্যায্য দাম পাবেন। এর ফলে পরবর্তী সময়ে কৃষককে অন্যের হাতে চলে যেতে হবে না। এ জায়গায় আমার মনে হয় সরকারের একটা বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যাপার থাকবে। এ দিকে আরেকটু নজর দিতে হবে, যাতে প্রান্তিক চাষীরা পণ্যগুলো স্টোর করতে পারেন এবং পণ্যের ন্যায্য দামটা ঠিকমতো রাখতে পারেন। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের উন্নয়নের গল্পে কেবল ম্যানুফ্যাকচারিং খাত কিংবা আরএমজির কথা উঠে এসেছে। কারণ এর মাধ্যমে ৪০-৪৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসে প্রতি বছর। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের সামাজিক কাঠামোর কথা বললে দেশের প্রকৃত নায়ক হচ্ছেন কৃষক। ঠিকমতো দাম পাক আর না পাক তারাই দেশের প্রকৃত নায়ক। সমন্বিত একটি কৃষিনীতি প্রণয়নে কাজ করা উচিত সরকারের। আমরা সব জায়গায় শুনি, পরিবহণ ও সংরক্ষণের অভাবে ২৫ শতাংশেরও বেশি শাকসবজি ও ফল নষ্ট হয়ে যায়। এটা বড় অংকের অর্থনৈতিক ক্ষতি। কৃষিপণ্য ঠিকমতো সংরক্ষণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া চাই।

বাংলাদেশের ফলের যে সম্ভাবনা সেটা আসলে আমরা কিছুই কাজে লাগাতে পারিনি। আমরা ঠিকমতো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাত করে বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারি। এখন অনেক উদ্যোগ চালু হয়েছে। হিমাগার থেকে শুরু করে পরিবহণ সব জায়গাতেই হাত দেয়া হচ্ছে—এটাকে সাধুবাদ জানাই।সবশেষে, কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে সরবরাহ চেইনে যদি কৃষকের নিয়ন্ত্রণ আরেকটু বাড়ানো যায় তাহলে তারা ন্যায্য দাম পেতে পারেন। এজন্য সংরক্ষণ, বিপণনে তাদের সামনে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমবে। আমরা চাই, আমদের কৃষকরা যেন ন্যায্য দাম পান। একই সঙ্গে এটাও চাই, আমাদের ভোক্তারা ভালো পণ্য পাক।

লেখক: কৃষিগবেষক ও অধ্যাপক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

যখন স্বপ্ন পুড়ে ছাই, তখনই আত্মজাগরণের সময়

আচমকা সেই স্বাভাবিক দুপুর পরিণত হলো ভয়াল এক মুহূর্তে। একটি প্রশিক্ষণ বিমান আকাশ থেকে আছড়ে পড়ল স্কুলের ওপর। আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শিশুদের কান্না, চিৎকার আর আগুনে পুড়ে যাওয়া শরীর— সব মিলিয়ে এক বিভীষিকাময় দৃশ্য। এটি শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি একটি জাতীয় ট্রাজেডি— যা আমাদের হৃদয় ছিন্নভিন্

৭ দিন আগে

জুলাই অভ্যুত্থান: শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি

দেশে একটি যথার্থ যুগোপযুগী শিক্ষানীতি এবং উচ্চশিক্ষা কমিশন না থাকার মূল্য এখন চুকাতে হচ্ছে দেশের শিক্ষাখাতকে। এর অন্যতম কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় শিক্ষাখাতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন ব্যয়কারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দুর্বলতাকে। অর্থাৎ শিক্ষায় রাষ্ট্রের বিনিয়োগ অপ্রতুল এবং তা আত্মঘাতী।

১০ দিন আগে

গোপালগঞ্জের সংঘর্ষ: দায় কার?

ঘটনার শুরু হয় এক র‍্যালিকে ঘিরে। এনসিপি এই র‍্যালির আয়োজন করে। এটি ছিল ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে। ওই আন্দোলনে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। র‍্যালিটি গোপালগঞ্জে হয়। এই র‍্যালিতে বাধা দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা। অভিযোগ আছে, তারা এনসিপির নেতাদের মারধর করে। ভেন্যু ভাঙচুর করে।

১১ দিন আগে

এনবিআরে সংস্কার না শাস্তি চলছে?

সরকারের সহনশীলতা আর এনবিআরের কর্মীদের আত্মসমালোচনা জরুরি, নয়তো দিনশেষে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ

১৩ দিন আগে