যশোর গণহত্যা দিবস আজ

বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৭: ১৬
একাত্তরের গণহত্যার সাক্ষী যশোর রেলওয়ে মাদরাসা। ফাইল ছবি

আজ ৪ এপ্রিল, যশোর গণহত্যা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোরের ইতিহাসের নৃশংসতম দিনগুলোর অন্যতম। ১৯৭১ সালের এই দিনে যশোরে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা শহর জুড়ে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। তাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন যশোরের রাজনৈতিক, শিক্ষক, ছাত্র ও পেশাজীবী ও ধর্মীয় নেতারা।

সেদিনের গণহত্যায় ৫১ জনের নিহতের কথা বলা হলেও প্রকৃত সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বেশি ছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর গত বছর ২০২৪ সালের ২৪ মার্চ শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় স্থান দেওয়া হয়। বাকিরা পাননি কোনো স্বীকৃতি। নেই কোনো স্মৃতিস্মারকও। ওই দিনের শহিদদের স্বীকৃতির দাবিতে বছরের পর বছর ঘুরছেন স্বজনরা।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, সারা দেশের মতো যশোরেও ১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। আর এপ্রিলের শুরু থেকেই গোটা বাঙালি জাতি পুরোদমে যুদ্ধজয়ের প্রস্তুতিতে মাঠে নেমে পড়ে। এই যুদ্ধপ্রস্তুতিকে থামিয়ে দিতে নৃশংস হয়ে ওঠে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা।

যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি আর্মি শহরের বিভিন্ন স্থানে চালাতে থাকে বর্বরোচিত হামলা। যশোরে তাদের সবচেয়ে নৃশংসতম হামলার অনেকগুলোই ঘটে ৪ এপ্রিল। এ দিন যশোর ক্যান্টনমেন্টের পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মধ্যযুগীয় তাণ্ডব চালায়। প্রকাশ্যে গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তারা হত্যা করে অর্ধশতাধিক বাঙালিকে। সবচেয়ে বড় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটে যশোর রেলস্টেশন মাদরাসা প্রাঙ্গণে।

সে দিনের সেই নারকীয় তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী রেল স্টেশন এলাকার শেখ আব্দুর রহিম জানান, ৪ এপ্রিল ভোরে শহরের রেল স্টেশন মাদরাসার শিক্ষার্থীরা ফজরের নামাজ শেষ করে কোরআন পাঠ করছিল। এমন সময় স্থানীয় বিহারীদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা মাদরাসা প্রাঙ্গণে তাণ্ডব চালায়।

তিনি বলেন, মাদরাসা বড় হুজুর আবুল হাসান যশোরী পাক আর্মিদের নিরস্ত করতে গেলে অবাঙালিরা পাক আর্মিদের জানায়, ‘এরা সবাই ইপিআর, পাকিস্তানের শত্রু।’ এরপরই পাক আর্মি নির্বিচারে গুলি চালায়। মাদরাসা প্রাচীরের ওপর থেকে এ দৃশ্য দেখে পালিয়ে যান আব্দুর রহিম। দুপুরের দিকে তিনি ও তার ভাই জাহাঙ্গীর মাদরাসা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখেন, রক্তে ভেসে যাওয়া গোটা অঞ্চলে শুধু লাশ আর লাশ। সেখানেই পাওয়া যায় ২৩ জনের মরদেহ। এর মধ্যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও বাকি সাতজনের পরিচয় আজও জানা যায়নি।

মাদরাসা প্রাঙ্গণে আত্মরক্ষার জন্য খোঁড়া গর্তে রহিম ও জাহাঙ্গীর লাশগুলো একের পর এক সাজিয়ে মাটিচাপা দেন। সে দিনের নৃশংস ঘটনাটি বর্তমানে ‘মাদরাসা ট্র্যাজেডি’ নামে পরিচিত। এখানে নিহতদের যে ১৬ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে একই পরিবারের সদস্য তাহের উদ্দিন, এ বি এম আব্দুল হামিদ ও এ বি এম কামরুজ্জামান। এ ছাড়া একই এলাকার কাজী আব্দুল গণি ও কাজী কামরুজ্জামানও সম্পর্কে বাবা-ছেলে।

নিহতদের মধ্যে আরও ছিলেন— তৎকালীন খুলনা কমিশনার অফিসের কর্মচারী দীন মোহাম্মদ, সম্মিলনী স্কুলের শিক্ষক আইয়ুব হোসেন ও কাজী আব্দুল কালাম আজাদ, রেল স্টেশন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান ওরফে কাঠি হুজুর, শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের পিতা যশোর জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ, শহর আলীর ছেলে আবু কালাম এবং মাদরাসার ছাত্র আতিয়ার রহমান, নোয়াব আলী, লিয়াকত আলী, মাস্টার আব্দুর রফিক ও আক্তার হোসেন।

একই দিনে শহরের গুরুদাসবাবু লেনেও চলে পাকিস্তানি হানাদারদের নারকীয় তাণ্ডব। এই লেনের বাড়ি থেকে অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলী ও তার তিন ছেলে এম এম কলেজের বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম বকুল, বিকম শেষ বর্ষের ছাত্র সৈয়দ শফিকুর রহমান জাহাঙ্গীর ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী আজিজুল হককে পাকিস্তানি সেনারা ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। সেখানে নির্মম নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করে। এ দিনই পাকিস্তানি সেনারা শহরের ক্যাথলিক গির্জাতেও আক্রমণ করে। সেখানে গির্জার ইতালিয়ান ফাদার মারলো ভারনেসিসহ ছয়জনকে হত্যা করা হয়।

এসব নিহতদের মধ্যে রেল স্টেশন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুর রহমান, জিলা স্কুলের শিক্ষক আব্দুর রউফ ও অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলী ২০২৪ সালে শহিদ বুদ্ধিজীবীর তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন।

এ ছাড়া একই দিনে শহরের বিভিন্ন স্থানে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে শহিদ হন তৎকালীন যশোর শহর ছাত্রলীগের সভাপতি এম এম কলেজের ছাত্র মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, এম এম কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মোছাদ্দেদ আলী, ছাত্রলীগ নেতা ওমর ফারুক, নিখিল রায়, নাসিরুল আজিজ, অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলী, তৎকালীন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট রহমতউল্লাহ, ইপিআর সদস্য আব্দুল মান্নান, ক্রিকেটার স্বপন বিশ্বাস, ডা. নাসির উদ্দিন ও মিসেস নাসির, আব্দুর রহমান, লুৎফর রহমান, মিসেস জাবেদা লুৎফর, চিত্রশিল্পী আমিনুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ, মাহবুব এবং ভোলা ট্যাংক রোডের অবসরপ্রাপ্ত সেরেস্তাদার আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী।

শহিদ অ্যাডভোকেট সৈয়দ আমীর আলীর ছেলে সাংবাদিক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন আলম বলেন, আমার বাবা ও তিন ভাইকে সেদিন নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির নাম ফলকে শহিদ আইনজীবীর তালিকায় আমার বাবার নাম রয়েছে। তিনি শহিদ বুদ্ধিজীবী।

হাতেগোনা কয়েকজন স্বীকৃতি পেলেও যশোরের গণহত্যা দিবসের অন্য শহিদদের স্বীকৃতি বা কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এ প্রসঙ্গে যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার আফজাল হোসেন দোদুল বলেন, গণহত্যার শিকার শহিদদের স্বীকৃতির দাবি দীর্ঘদিনের। এ ছাড়া যশোরের গণহত্যা দিবসের কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মারক নেই। শহিদদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভও অবশ্যই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে হওয়া প্রয়োজন।

এদিকে যশোর গণহত্যা দিবস উপলক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের সব শহিদদের স্মরণে বাম গণতান্ত্রিক জোট যশোর শুক্রবার সকাল ১১টায় জোটের অস্থায়ী কার্যালয়ে (বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ কার্যালয়) পতাকা উত্তোলন করেছে। কালো ব্যাজ ধারণের পাশাপাশি স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনও করেছে এই জোট। এ ছাড়া ৬ এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৪টায় প্রেস ক্লাব যশোরে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।

ad
ad

মাঠের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

বেসরকারি শিক্ষায় ফি নেওয়ার নীতিমালা থাকা উচিত

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেছেন, বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কীভাবে ফি নেওয়া হবে—সে বিষয়ে সরকারের একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, যা থাকাটা প্রয়োজন।

১৩ ঘণ্টা আগে

রামেক হাসপাতালের বাথরুমে পড়ে করোনা রোগীর মৃত্যু

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক করোনা রোগী বাথরুমে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডের বাথরুমে পড়ে তিনি মারা যান। দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হার্ট এটাকে তিনি মারা যেতে পারেন বলে ধারণা করছেন চিকিৎসকরা।

১৫ ঘণ্টা আগে

আকিকার দাওয়াতে গিয়ে গ্রেপ্তার ছাত্রলীগ-যুবলীগের ৭ নেতা

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের স্থানীয় এক নেতার ছেলের আকিকায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের। ওই সাতজন আমন্ত্রণ গ্রহণ করে মঙ্গলবার রাতে সেখানে হাজির হন। গোপন সূত্রে পুলিশ খবর পেলে সেখানে গিয়ে সাতজনকে গ্রেপ্তার করে।

১ দিন আগে

বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরের মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

পুলিশ ও জেলা বিএনপি সূত্র জানিয়েছে, দুই বছর আগে বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুরের ওই ঘটনায় নেত্রকোনা সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের আমলী কেশবপুর গ্রামের আব্দুল হাইয়ের ছেলে সুমন মিয়া গত ১১ মে নেত্রকোনা মডেল থানায় মামলা করেন।

১ দিন আগে