আইন-আদালত

বাংলাদেশের আলোচিত রাজসাক্ষী

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ১৭: ৫০
প্রতিকী ছবি। ছবি : এআইয়ের তৈরি।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজসাক্ষীর ভূমিকা বরাবরই আলোচিত এবং বিতর্কিত। যদিও বাংলাদেশের আইনে 'রাজসাক্ষী' শব্দটি ভারত বা পশ্চিমা দেশগুলোর মতো সরাসরি ব্যবহৃত হয় না, তবে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারার আওতায় বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অনেক অভিযুক্তকে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এসব রাজসাক্ষীর অনেকেই ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের দেওয়া সাহসী অথবা কৌশলী সাক্ষ্যের জন্য।

১৫ আগস্টের হত্যা মামলায় মহিতুল ইসলাম

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর বহু বছর নীরবতায় ঢাকা ছিল সত্য। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এই মামলার তদন্ত শুরু হলে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে উঠে আসেন বঙ্গবন্ধুর প্রাইভেট সেক্রেটারি মহিতুল ইসলাম। তিনি নিজ চোখে দেখেছিলেন কীভাবে সেনাসদস্যরা ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে ঢুকে একে একে পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে।

মহিতুল ইসলামের সাক্ষ্য ছিল এই মামলার ভিত্তি। তাঁর বিবরণ আদালতে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরেন রাষ্ট্রপক্ষ। তিনি বলেন, “আমি দেখেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হলো, আমি লুকিয়ে পড়ি বাড়ির পেছনে, পরে ধরা পড়ি।” তাঁর এই সাক্ষ্য এমন এক সময় আসে, যখন বহু তথ্য বিকৃত বা আড়াল করে রাখা হয়েছিল।

জেলহত্যা মামলার রাজসাক্ষী দেলোয়ার হোসেন

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা—তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে হত্যার মামলায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি জেলার দেলোয়ার হোসেন।

তিনি আদালতে বলেন, “আমরা দেখেছি সেনাবাহিনীর পোশাকধারীরা কীভাবে জেলের ভেতরে ঢুকে পড়লেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুলির শব্দ পাই।”

আইন বিশ্লেষক ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম বলেন, জেলহত্যার মামলায় দেলোয়ার হোসেনের স্বাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষের জন্য ‘টার্নিং পয়েন্ট’ ছিল। রাষ্ট্রের ভেতরকার চক্রান্ত তাঁর বিবরণ থেকেই বোঝা যায়।

কিবরিয়া হত্যা মামলায় ঘনিষ্ঠ সহচরদের স্বাক্ষ্য

২০০৫ সালের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে যারা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপক্ষে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন, তাঁদের মধ্যেও কেউ কেউ কার্যত রাজসাক্ষীর ভূমিকা পালন করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মামলার এক আসামি যিনি কুলাউড়ার এক মাদ্রাসায় শিক্ষার্থী ছিলেন এবং হাওরে অস্ত্র সরবরাহে জড়িত ছিলেন বলে দাবি করেন। তাঁর জবানবন্দিতে উঠে আসে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র জোগাড় ও বিস্ফোরক সরবরাহের বিস্তারিত বর্ণনা।

যদিও তিনি আদালতে সরাসরি ‘রাজসাক্ষী’ হিসেবে ঘোষিত হননি, তবে তাঁর জবানবন্দি মামলার গতিপথ পাল্টে দেয়।

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় ‘রাজসাক্ষী’

এই মামলায় বহু আসামির মধ্য থেকে কয়েকজন আসামি পরে রাষ্ট্রপক্ষে মুখ খোলেন। তদন্ত ও বিচার চলাকালে হুজি নেতা মুফতি হান্নান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসে কাদের নির্দেশে কীভাবে হামলার পরিকল্পনা হয়।

একই মামলায় সেই সময়ের সরকারের আমলের গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইডি) কর্মকর্তা আবদুর রশিদ ও রুহুল আমিন কার্যত রাজসাক্ষীর মতো ভূমিকা পালন করেন, যাঁরা স্বীকার করেন কীভাবে প্রকৃত তথ্য আড়াল করে ভুয়া তদন্ত পরিচালনা করা হয়েছিল।

তাঁদের জবানবন্দি প্রসঙ্গে সাংবাদিক আবেদ খান এক প্রতিবেদনে লিখেছিলেন—“এটা শুধু বিচার নয়, এক ভয়ংকর রাজনীতির মুখোশ খোলার পথ তৈরি করল।”

সাহেদ করিম মামলায় অন্যতম অভিযুক্তর স্বীকারোক্তি

২০২০ সালে করোনা পরীক্ষায় ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম গ্রেপ্তার হন। এই মামলায় তাঁরই ঘনিষ্ঠ এক সহকর্মী আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়ে বলেন, “সাহেদ ভাইয়ের নির্দেশেই আমরা রিপোর্ট বানাতাম। তিনি নিজেই টেস্ট ছাড়াই রিপোর্ট সই করতেন।”

এই স্বীকারোক্তি তদন্ত ও বিচারকে শক্ত ভিত দেয়। যদিও এখানে সরাসরি ‘রাজসাক্ষী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি, তবে কার্যত তিনি এমনই একজন যিনি রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়ে অপরাধ ফাঁস করেন।

রাজসাক্ষীর নিরাপত্তা ও নৈতিকতা

বাংলাদেশে রাজসাক্ষীদের জন্য আলাদা কোনো সুরক্ষা কর্মসূচি এখনো চালু হয়নি, যদিও তাঁদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিশোধ বা হুমকির নজির আছে। এজন্য অনেকেই সাক্ষ্য দিতে ভয় পান।

আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন—“আমাদের দেশে এখনো সেই পরিকাঠামো নেই যা একজন রাজসাক্ষীকে সাহস দেয়। আইন থাকলেও বাস্তবায়নের ঘাটতি প্রকট।”

এই কারণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার রাজসাক্ষীরা মুখ খোলেন না, বা আদালতের সামনে তাঁদের বক্তব্য পাল্টে ফেলেন।

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় রাজসাক্ষীদের ভূমিকা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ইতিহাসের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক চক্রান্ত বা দুর্নীতির মামলায় তাঁদের তথ্য না থাকলে হয়তো বহু অপরাধই থেকে যেত অন্ধকারে। তবে এখনো তাঁদের নিরাপত্তা, নৈতিকতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে।

যতদিন না একটি নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল বিচারিক পরিবেশ গড়ে ওঠে—রাজসাক্ষীরা হয়তো সাহস করে সত্য বললেও, তাঁদের সত্য কতটা কাজে লাগবে, তা নিয়েই থেকে যাবে প্রশ্ন।

ad
ad

মাঠের রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি নিশ্চিত করবে সরকার : উপ-প্রেস সচিব

নির্বাচনের আগে দেশে স্থিতিশীল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হবে। সে লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। আর কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।অন্

১১ ঘণ্টা আগে

রাজসাক্ষী কাদের বলে, ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন রাজসাক্ষী

আন্তর্জাতিক আইনে এই ব্যক্তিদের ‘অ্যাকোম্প্লিস টার্নড প্রোসিকিউশন উইটনেস’ বলা হয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ভারত—প্রায় সব আধুনিক বিচারব্যবস্থায়ই রাজসাক্ষীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

১ দিন আগে

সন্তান কোলে নিয়ে পরীক্ষা, দেশসেরা বাগমারার শামীমা

পরীক্ষার সময় যখন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী বই আর কলম নিয়ে ব্যস্ত, তখন এক তরুণী কোলে এক মাসের নবজাতক সন্তান নিয়ে হাজির হলেন কেন্দ্রে। সেই সন্তান নিয়েই তিন ঘণ্টার পরীক্ষা দিয়ে সারা দেশের মধ্যে হয়েছেন প্রথম।

১ দিন আগে

বাসার সামনে যুবদলের বহিষ্কৃত নেতাকে গুলি করে হত্যা

দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, দুপুরে বাসার সামনে নিজের প্রাইভেটকার পরিষ্কার করছিলেন মাহবুবুর রহমান মোল্লা। এ সময়ে হেলমেট পরা অবস্থায় তিনজন একটি মোটরসাইকেলে এসে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করতে থাকে। পরে মৃত্যু নিশ্চিত করতে দুর্বৃত্তরা তার দু’পায়ের রগ কেটে দেয়।

১ দিন আগে