আইন

রাজসাক্ষী কাদের বলে, ইতিহাসের বিখ্যাত কয়েকজন রাজসাক্ষী

অরুণাভ বিশ্বাস

বিচারব্যবস্থার জগতে কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের সাক্ষ্য কোনো মামলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এমন একজন যখন অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলেও পরে রাষ্ট্রের হয়ে সাক্ষ্য দেন, তখন তাঁকে বলা হয় রাজসাক্ষী। আইন ও আদালতের পরিভাষায় এই 'রাজসাক্ষী' বা 'প্রসিকিউশন উইটনেস' নামটির পেছনে আছে অনেক ইতিহাস, অনেক বিতর্ক, এবং নাটকীয় সব ঘটনা।

রাজসাক্ষী মানে কী?

‘রাজসাক্ষী’ শব্দটি এসেছে ‘রাজ’ এবং ‘সাক্ষী’ এই দুইটি শব্দ মিলিয়ে। অর্থাৎ, এমন একজন সাক্ষী যিনি নিজে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, কিন্তু পরে আদালতে রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দেন। মূলত নিজের শাস্তি লাঘবের আশায় বা কোনো চুক্তির ভিত্তিতে তিনি অপরাধের মূল নেপথ্য কাহিনি ফাঁস করে দেন।

আন্তর্জাতিক আইনে এই ব্যক্তিদের ‘অ্যাকোম্প্লিস টার্নড প্রোসিকিউশন উইটনেস’ বলা হয়। ইংল্যান্ড, আমেরিকা বা ভারত—প্রায় সব আধুনিক বিচারব্যবস্থায়ই রাজসাক্ষীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩০৬ ও ৩০৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অপরাধে জড়িত থাকেন, তবে আদালত চাইলে তাঁকে সাধারণ ক্ষমা দিয়ে সাক্ষী বানাতে পারে, শর্ত থাকে তিনি সত্য ও সম্পূর্ণ বিবরণ দেবেন।

যেভাবে রাজসাক্ষী নির্ধারণ করা হয়

একজন রাজসাক্ষী হওয়ার প্রক্রিয়াটি বেশ কাঠিন্যপূর্ণ। এটি শুধু তদন্ত সংস্থার ইচ্ছায় হয় না, আদালতের অনুমতি এবং আইনগত ভিত্তিও প্রয়োজন। প্রথমে তদন্তকারী সংস্থা বুঝে নেয়, কোন অভিযুক্ত ব্যক্তির তথ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কে রাজি হতে পারেন সত্য প্রকাশ করতে। এরপর ওই ব্যক্তিকে ‘অপ্রতিবাদ ক্ষমা’ (টেন্ডার অব পারডন) দেওয়া হয়, এবং তাঁকে বোঝানো হয় যে সত্যি বললে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়া হতে পারে।

এই ‘ক্ষমা’র চুক্তিটি সাধারণত শর্তসাপেক্ষ। যদি রাজসাক্ষী পরে মিথ্যা বলেন বা গোপন তথ্য দেন, তবে তাঁদের বিরুদ্ধে আবার অপরাধের পুরোনো অভিযোগে বিচার শুরু হতে পারে।

ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একাধিকবার বলেছে, রাজসাক্ষীর বক্তব্য সন্দেহের চোখে দেখা উচিত হলেও একে পুরোপুরি বাতিল করা যায় না। তবে তা corroboration বা অন্যান্য সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখাই শ্রেয়।

ইতিহাসের বিখ্যাত রাজসাক্ষীরা

আধুনিক ইতিহাসে অনেক রাজসাক্ষীর নাম উঠে এসেছে, যাঁদের বক্তব্য বদলে দিয়েছে বিশাল সব মামলার রূপরেখা। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাফিয়া সাম্রাজ্যের এক বড় নাম ছিল গ্যাম্বিনো গ্যাং। এর প্রধান ছিলেন জন গট্টি ছিলেন ‘দ্য টেফলন ডন’। গট্টিকে কারাবন্দি করতে এফবিআই সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছিল হলেন স্যালভাটোর "স্যামি দ্য বুল" গ্রাভানোর ওপর। তিনি নিজেই স্বীকার করেন, তিনি ১৯টি খুনে জড়িত ছিলেন। তবু রাজসাক্ষী হয়ে তিনি জন গট্টির বিরুদ্ধে আদালতে সব খুলে বলেন।

এই মামলা নিয়ে মার্কিন অপরাধবিজ্ঞানী ড. পিটার ল্যান্স বলেন, “স্যামি দ্য বুল ছিলেন ‘মডেল ইনসাইড উইটনেস’। তাঁর সাক্ষ্য না থাকলে হয়তো জন গট্টি কখনোই ধরা পড়তেন না।”

ভারতের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর যাঁর সাক্ষ্য গোটা বিচারকে শক্ত ভিত দিয়েছিল, তিনি হলেন বাসারত আলি। তাঁকে বিশেষ ক্ষমার আওতায় এনে রাষ্ট্রের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে রাজি করানো হয়। তিনি ফাঁস করেন, কীভাবে পাকিস্তানের আইএসআই, দাউদ ইব্রাহিম এবং মুম্বাইয়ের অপরাধজগত একসাথে কাজ করেছিল।

বাসারত আলি, যিনি কুখ্যাত আবু সালেমের বিরুদ্ধে অস্ত্র পাচার, চাঁদাবাজি ও খুনের অভিযোগে দানিশ ছিলেন সহঅভিযুক্ত। পরে তিনি রাজসাক্ষী হয়ে ওঠেন এবং সালেমের অস্ত্রপাচার রুট ফাঁস করেন।

ইতালিতে রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত ‘পেন্টিটি’ শব্দটি এসেছে ‘penitent’ থেকে, যার মানে অনুতপ্ত ব্যক্তি। ১৯৮০-এর দশকে সিসিলির কুখ্যাত কসা নস্ত্রা মাফিয়া চক্রের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র জোরালো পদক্ষেপ নেয়। তখন টমাসো বুসকেত্তা নামের এক গ্যাং সদস্য প্রথম রাজসাক্ষী হন। তাঁর সাক্ষ্যে শত শত মাফিয়া সদস্য ধরা পড়ে। এই সাক্ষ্যগুলিকে “ম্যাক্সি ট্রায়াল” বলা হয় এবং এটি ইতালির বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মামলা।

রাজসাক্ষীর কার্যকারিতা ও নৈতিকতা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। কেউ বলেন, এটি অপরাধীকে পার পাওয়ার সুযোগ দেয়, আবার কেউ বলেন, এটি অপরাধ নির্মূলে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।

যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স-এর অপরাধবিজ্ঞানী ড. মার্টিন গিল বলেন— “রাজসাক্ষী ব্যবস্থায় ন্যায়ের একটা দ্বন্দ্ব আছে। কারণ একজন অপরাধীও পার পেতে পারেন। কিন্তু অনেক সময় এটিই একমাত্র উপায় সত্য উদঘাটনের।”
অন্যদিকে, আমেরিকার নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. লরা কলিন্স বলেন, “রাজসাক্ষীদের বক্তব্য গ্রহণের সময় রাষ্ট্রকে খুব সাবধানে চলতে হয়। তাঁদের প্রণোদনা, ভয়, বা প্রতিশোধস্পৃহা থাকতে পারে।”
বাংলাদেশের আইনে ‘রাজসাক্ষী’ শব্দটি তেমন প্রচলিত না হলেও, ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৩৭ ও ৩৩৮ ধারায় এ ধরনের ব্যবস্থার অনুমতি আছে। কয়েকটি আলোচিত হত্যা ও দুর্নীতির মামলায় এমন নজিরও দেখা গেছে, যেখানে এক অভিযুক্ত অন্যের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন এবং শাস্তি লাঘব পেয়েছেন।

রাজসাক্ষী ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, অপরাধের অভ্যন্তরীণ দিকগুলো জানা যায়। অনেক সময় পুলিশের হাতে যেসব তথ্য থাকে না, তা উঠে আসে রাজসাক্ষীর মুখে। বিশেষ করে মাফিয়া, জঙ্গি গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক অপরাধে রাজসাক্ষীরা অপরিহার্য।

তবে এই ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হলো, একজন অপরাধীর ওপর নির্ভর করা হয়, যিনি হয়তো নিজ স্বার্থে তথ্য বিকৃত করতে পারেন। আবার কখনো রাজসাক্ষীর নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে, তিনি হয়তো সাক্ষ্যই দেবেন না।

রাজসাক্ষী একজন বিচিত্র চরিত্র। তিনি একদিকে অপরাধী, অন্যদিকে ন্যায়বিচারের সহায়ক। তাঁকে ঘিরে আছে নৈতিকতা, কৌশল, এবং বিচারব্যবস্থার বাস্তবতা। একেক দেশে একেক নিয়ম, একেক কৌশল—তবে লক্ষ্য একটাই: সত্য উদঘাটন ও ন্যায়বিচার।

সেই সত্যের সন্ধানে অনেক সময় অপরাধীকেই আশ্রয় নিতে হয়। রাজসাক্ষীরা সেই অন্ধকার থেকে আলোয় বেরিয়ে আসা কিছু মানুষ, যাঁদের মুখেই লুকিয়ে থাকে বহু অপরাধের জবাব।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

সরকারের মধ্যের একটা শক্তিই গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করছে: মির্জা ফখরুল

মির্জা ফখরুল আরও বলেন, কিছু রাজনৈতিক মহল পরিকল্পিতভাবে নির্বাচনকে বানচাল করতে নিত্য নতুন দাবি তুলছে। যার সঙ্গে দেশের মানুষই পরিচিত নয়। এগুলো নিয়ে তাঁরা হুমকি দিচ্ছেন, বেশ জোরেশোরেই হুমকি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘বসে নেই কেউ...। যারা ফায়দা নিতে চায়, তারা বিভিন্নভাবে কাজ করছে।’

১৬ ঘণ্টা আগে

ঢাবির হল সংসদ নির্বাচনে ১৩ পদে ১০৩৫ প্রার্থী, সরে দাঁড়ালেন ৭৩ জন

এ নির্বাচনে অংশ নিতে এক হাজার ১০৯টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছিল। এর মধ্যে একজন প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন ৭৩ জন।

১৬ ঘণ্টা আগে

হাসনাত আবদুল্লাহকে নিয়ে মন্তব্যে ব্যাখ্যা দিলেন রুমিন ফারহানা

আমি যখন বলি ‘ফকিন্নির বাচ্চা’, তখন তার নিচে শেয়ার করা ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যাবে, কে কাকে ইঙ্গিত করছে। আমার আওয়ামী লীগের সম্পাদক হওয়া নিয়ে ওরা যে ভাষায় কথা বলেছে, তার প্রেক্ষিতে আমি প্রতিক্রিয়া দিয়েছি।

১৬ ঘণ্টা আগে

রুমমেটকে ছুরিকাঘাত: ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালালকে হল থেকে বহিষ্কার

প্রাধ্যক্ষ মো. সিরাজুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে জালালকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেন। পরে তাকে পুলিশে সোপর্দ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

২০ ঘণ্টা আগে