স্বাস্থ্য

সিগারেটের যত অপকারিতা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ০৮ জুলাই ২০২৫, ১৫: ৪৯

সিগারেট—একটি ছোট্ট বস্তু। দেখতে পাতলা, হাতে নিলে সামান্য ওজন, আর প্যাকেটের গায়ে বড় বড় করে লেখা "ধূমপান মৃত্যু ডেকে আনে"। তবু প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ এই ছোট বস্তুটিকেই ঠোঁটের কাছে নিয়ে যান, আগুন ধরান, ধোঁয়া টানেন বুক ভরে। সেকেন্ডে সেকেন্ডে শরীরের ভেতর ঢোকে বিষ, ধীরে ধীরে নিঃশেষ করে দেয় শ্বাসপ্রশ্বাসের শক্তি, হৃদয়ের ধাক্কা, মস্তিষ্কের স্বাভাবিকতা। সিগারেট যেন এক নীরব ঘাতক, যে ধীরে ধীরে হত্যা করে, বিনা শব্দে, ধোঁয়ার চাদরে ঢেকে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যাকে বলা হয় বিশ্বাস্বাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচও, তাদের সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, প্রতি বছর পৃথিবীতে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ সিগারেটজনিত কারণে মারা যান। এর মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ সিগারেট খান না, তবুও ধূমপায়ীর ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। একে বলে সেকেন্ডহ্যান্ড মানে কারও ধোঁয়ার শিকার হয়ে অন্য কেউ মৃত্যুবরণ করছেন। শুধু একটা ছোট সিগারেটের জন্য এত বড় বিপর্যয়! এটা কি কল্পনা করা যায়?

যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষক ডা. মাইকেল স্ল্যাটার বলেন, “ধূমপান এমন একটি আসক্তি, যা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তিকেই নয়, পুরো পরিবার ও সমাজকে বিষিয়ে তোলে।” তাঁর মতে, “ধূমপানের ফলে শরীরে ৭০টিরও বেশি ক্যানসারের উপাদান ঢুকে পড়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুসে।”

সিগারেট শুধু ফুসফুসেই ক্ষতি করে না, একে একে আক্রমণ করে শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গকে। ধূমপানে নিকোটিন, টার, কার্বন মনোক্সাইডসহ নানা বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে, যা সরাসরি রক্তে মিশে যায়। এর ফলে ধমনির পথ সরু হয়ে যায়, রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। গবেষণা বলছে, নিয়মিত ধূমপায়ীদের স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা সাধারণ মানুষের তুলনায় দ্বিগুণ বেশি।

লন্ডনের কিংস কলেজের শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞ ডা. এলেনা ব্রুকস বলেন, “সিগারেট ফুসফুসকে এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে যে ধীরে ধীরে শ্বাস নেওয়ার ক্ষমতাই কমে যায়। অনেকেই বলেন, প্রথম দিকে কিছুই হয়নি। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ১০-১৫ বছর পরে, যখন শরীর আর লড়াই করতে পারে না।”

তবে কেবল হৃদপিণ্ড আর ফুসফুস নয়—সিগারেটের প্রভাবে ক্যানসার হতে পারে মুখে, গলায়, খাদ্যনালিতে, পিত্তথলিতে, কিডনিতে, এমনকি মূত্রাশয়েও। নারীদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। যারা গর্ভাবস্থায় ধূমপান করেন বা ধূমপায়ী কারও আশেপাশে থাকেন, তাঁদের গর্ভজাত শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। এমনকি সময়ের আগে শিশুর জন্ম, ওজন কমে যাওয়া কিংবা মৃত সন্তান প্রসবের আশঙ্কাও থেকে যায়।

সিগারেটের আরেকটি বড় বিপদ হলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব। অনেকেই মনে করেন, সিগারেট টানলে মানসিক চাপ কমে যায়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারে উল্টো। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন বা সিডিসি বলছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ ও ঘুমের সমস্যা তুলনামূলক বেশি দেখা যায়। সিগারেট আসলে মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা কমিয়ে দেয়, যার ফলে ভালো লাগার অনুভূতি হ্রাস পায় এবং মানসিক অস্থিরতা বাড়ে।

এই বিষয়ে দীর্গঘদিন গবেষণা করছেন ডিউক ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী ড. স্যামুয়েল ম্যাথুস। তিনি বলেন, “সিগারেট ধীরে ধীরে স্নায়ুতন্ত্রের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। এটি একটা চক্র তৈরি করে, যেখানে উদ্বেগ কমাতে ধূমপান করা হয়, কিন্তু ধূমপানের কারণেই উদ্বেগ বাড়তে থাকে।”

অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সিগারেট মারাত্মক ক্ষতিকর। বাংলাদেশে একটি নিম্নবিত্ত পরিবার প্রতিদিন গড়ে ২০-৩০ টাকা সিগারেটে ব্যয় করে, যা মাস শেষে হয় ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা। এই অর্থ দিয়ে একজন শিশুর পুষ্টিকর খাবার বা ওষুধ কেনা যেত। অথচ এক ধূমপায়ী হয়তো ভাবতেই পারেন না, তিনি তার পরিবারের ভবিষ্যৎ কেড়ে নিচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় এক লক্ষ মানুষ সিগারেটজনিত কারণে প্রাণ হারান। এছাড়াও, অসংখ্য মানুষ ক্যানসার, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ ও স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। অথচ ধূমপান বন্ধ করলেই এ বিপদ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

এই বিষয়ে বাংলাদেশে গবেষণা করেছেন ডা. ফারজানা মাহবুব, যিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের জনস্বাস্থ্য বিভাগের গবেষক। তাঁর মতে, “ধূমপান বন্ধ করার সবচেয়ে বড় উপায় হলো সচেতনতা। যদি একজন ব্যক্তি বুঝে ফেলেন, তিনি কীভাবে নিজের ও অন্যের ক্ষতি করছেন, তাহলে সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।”

তবে সহজে সিগারেট ছাড়াও যায় না। নিকোটিন একটি প্রবল আসক্তিদায়ক পদার্থ। যাঁরা দীর্ঘদিন সিগারেট খান, তাঁদের জন্য হঠাৎ ছেড়ে দেওয়া মানেই শরীর ও মন—দুয়েই অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একে বলে নিকোটিন উইথড্রল সিনড্রম। এতে মাথা ঘোরা, হাত কাঁপা, মন খারাপ লাগা, ঘুমের ব্যাঘাত এমনকি মেজাজ খিটখিটে হয়ে যেতে পারে। এজন্য অনেক সময় পেশাদার চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন হয়।

এই ক্ষেত্রে নিকোটিন রিপ্লেসমেন্ট থ্যারাপি বা এনআরটি একটি কার্যকর পদ্ধতি, যেখানে চুইংগাম, লজেন্স বা প্যাচের মাধ্যমে ধীরে ধীরে নিকোটিন কমানো হয়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস বলছে, এনআরটি ব্যবহারে ধূমপান ছাড়ার সফলতা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়।

তবে শুধু চিকিৎসা নয়, সিগারেট ছাড়তে মানসিক শক্তিও দরকার। যারা সফলভাবে ধূমপান ছেড়েছেন, তাঁদের অনেকেই বলেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল ইচ্ছাশক্তি ও পরিবার থেকে পাওয়া সমর্থন।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির চিকিৎসাবিদ ড. লিন্ডা গ্রে বলেন, “ধূমপান ছাড়তে হলে প্রথমেই দরকার নিজের কাছে স্বীকার করা—হ্যাঁ, এটা ক্ষতিকর। এরপর ছোট ছোট পদক্ষেপে এগোতে হবে। হয়তো প্রথমে দিনে একবার কমানো, তারপর দিনে একটাও না খাওয়া—এইভাবে এগিয়ে গেলে ধূমপান ছাড়া সম্ভব।”

অথচ তামাক কোম্পানিগুলো ঠিক এর উল্টো কাজ করে। তারা নানা বিজ্ঞাপন, আকর্ষণীয় প্যাকেট, সেলিব্রিটি ব্যবহার করে সিগারেটকে 'কুল' বা আধুনিক জীবনের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। এসব কৌশলে তরুণরা খুব সহজেই ফাঁদে পড়ে। অথচ তারা জানেই না, তাদের ভবিষ্যৎ কীভাবে ধ্বংসের দিকে এগোচ্ছে।

বাংলাদেশ সরকার ধূমপান নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু আইন করেছে, যেমন পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, প্যাকেটে সচেতনতামূলক ছবি ও বার্তা ব্যবহার। তবে এখনো এ আইনের যথাযথ প্রয়োগ দেখা যায় না। অনেক পাবলিক বাস, রেস্টুরেন্ট বা ফুটপাতে মানুষ অবলীলায় ধূমপান করছে। ফলে সেকেন্ডহ্যান্ড ধোঁয়ার শিকার হচ্ছেন নারী ও শিশুরাও।

তাই এখনই সময় সিগারেটের বিরুদ্ধে জোরদার প্রচার চালানোর। স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক কর্মসূচি, চিকিৎসা সহায়তার সুযোগ, পরিবার ও সমাজের সক্রিয় ভূমিকা—এই তিনটি বিষয় একসঙ্গে কাজ করলেই ধূমপান কমানো সম্ভব।

মনে রাখবেন, সিগারেট কেবল নিজের ক্ষতি করে না, তা একজন মা'র কোল খালি করে, একটি শিশুকে অনাথ করে, একটি পরিবারের ভবিষ্যৎ কেড়ে নেয়। তাই যারা এখনো সিগারেট খান, তাঁদের কাছে অনুরোধ—একবার ভাবুন আপনার সন্তান, আপনার মা, আপনার প্রিয়জনদের কথা। আপনি বাঁচবেন, তাঁরা বাঁচবেন—এইটুকুই যথেষ্ট সিগারেট ছাড়ার জন্য।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

টাইগারদের বিপক্ষে টস জিতে ব্যাটিংয়ে শ্রীলঙ্কা

ক্যান্ডির পাল্লেকেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের শেষ ম্যাচে মাঠে নামছে বাংলাদেশ। এই ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন শ্রীলঙ্কা। আজ মঙ্গলবার (৮ জুলাই) বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায় শুরু হয়েছে এই ম্যাচ।

১৩ ঘণ্টা আগে

এবার ঢাকা বিভাগেও প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস

চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল— মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার কারণে এই তিন বিভাগে প্রবল বর্ষণের পূর্বাভাস ছিল আগে থেকেই। এবার ২৪ ঘণ্টার জন্য প্রবল বর্ষণের সতর্কবার্তায় যুক্ত হয়েছে ঢাকা বিভাগও। আবহাওয়া অধিদপ্তর বলছে, এই চার বিভাগেই আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে।

১৬ ঘণ্টা আগে

ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান দেবে ডার্ক ডোয়ার্ফ

১ দিন আগে

বিশ্বমঞ্চে ব্রিকসের আবির্ভাব হয় যেভাবে

তবে এই ধারণা গবেষণাগারে থেমে থাকেনি। ২০০৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইডলাইনে ব্রিক দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি সহযোগিতামূলক সম্পর্কের সূচনা করেন।

১ দিন আগে