বিজ্ঞান

ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান দেবে ডার্ক ডোয়ার্ফ

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম

মহাবিশ্বের বেশিরভাগ অংশই আমরা চোখে দেখি না। আমাদের চেনা-জানা জগৎ আলো, ধুলো, গ্যাস, গ্রহ আর নক্ষত্র দিয়ে তৈরি। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর বাইরেও আছে এক রহস্যময় বস্তু—ডার্ক ম্যাটার। এটা চোখে দেখা যায় না, আলো শোষণ বা প্রতিফলন করে না, কিন্তু তার মহাকর্ষীয় টানের কারণে আমরা জানি, এর অস্তিত্ব আছে। এই ডার্ক ম্যাটার খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞানীরা নতুন এক ধরনের নক্ষত্রের সম্ভাবনার কথা বলছেন। তারা একে বলছেন ‘ডার্ক ডোয়ার্ফ’ বা কৃষ্ণ বামন।

এই গবেষণার নেতৃত্ব দিচ্ছেন হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানী জেরেমি স্যাকস্টাইন। তিনি বলেন, মহাবিশ্বে এমন কিছু নক্ষত্র থাকতে পারে, যেগুলোর শক্তির উৎস হয়ত ডার্ক ম্যাটার নিজেই। সাধারণ নক্ষত্র আলো দেয় নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে, যেখানে হাইড্রোজেন একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে হেলিয়ামে রূপ নেয় এবং শক্তি তৈরি হয়। কিন্তু ডার্ক ডোয়ার্ফে যদি অনেক ডার্ক ম্যাটার জমে, তবে ওই ডার্ক ম্যাটারের কণা একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ধ্বংস হয়ে শক্তি তৈরি করতে পারে। সেই শক্তি দিয়েই ওই নক্ষত্র হয়তো আলোকিত থাকে অনেক দিন।

এই ভাবনাটি খুবই চমকপ্রদ। এতদিন আমরা ডার্ক ম্যাটারকে শুধু মহাকর্ষীয় প্রভাবেই চিনি। কিন্তু যদি দেখা যায়, ডার্ক ম্যাটার কোনো নক্ষত্রের ভিতরে গিয়ে তাকে শক্তি জোগাচ্ছে, তাহলে সেটা হবে ডার্ক ম্যাটার বোঝার এক নতুন দরজা। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই ধরনের নক্ষত্র খুঁজে পেলে আমরা ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে সরাসরি তথ্য পেতে পারি।

এই ধরনের নক্ষত্র প্রথমে দেখতে হবে সাধারণ ব্রাউন ডোয়ার্ফের মতো। ব্রাউন ডোয়ার্ফ এমন এক ধরনের বস্তু, যা নক্ষত্র ও গ্রহের মাঝামাঝি অবস্থানে। এর ভর খুব বেশি নয়, তাই এতে নিউক্লিয়ার ফিউশন হয় না। আবার গ্রহের মতোও নয়, কারণ আকারে অনেক বড়। কিন্তু যদি ব্রাউন ডোয়ার্ফের মধ্যে অনেক ডার্ক ম্যাটার ঢুকে পড়ে, তাহলে তা একধরনের "জীবন্ত" অবস্থা পেয়ে যায়। তখন সেটি উষ্ণ থাকবে, আলো দেবে, কিন্তু তার শক্তির উৎস হবে ডার্ক ম্যাটার। এই অস্বাভাবিক বস্তুকেই বিজ্ঞানীরা ডার্ক ডোয়ার্ফ বলছেন।

কিন্তু এমন নক্ষত্রকে কীভাবে চেনা যাবে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, লিথিয়াম-৭ নামে এক ধরনের মৌলিক কণার উপস্থিতি মাপলে এদের শনাক্ত করা যেতে পারে। সাধারণ নক্ষত্রে এই লিথিয়াম থাকে না, কারণ তা উচ্চ তাপে নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু ডার্ক ডোয়ার্ফে যদি নিউক্লিয়ার ফিউশন না হয়, তবে লিথিয়াম থেকে যেতে পারে। তাই কোনো নক্ষত্রে যদি লাল রঙের আলো থাকে, কিন্তু তার মধ্যে লিথিয়ামও থাকে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি সাধারণ নক্ষত্র নয়। হতে পারে সেটিই ডার্ক ম্যাটার চালিত একটি ডার্ক ডোয়ার্ফ।

জেরেমি স্যাকস্টাইন বলেন, "এই নক্ষত্রগুলো আমাদের ডার্ক ম্যাটার শনাক্তে সাহায্য করতে পারে। এগুলো যত বেশি ডার্ক ম্যাটার শোষণ করবে, তত বেশি আলো দেবে।" তার মতে, এই ধরনের নক্ষত্রগুলো সম্ভবত আমাদের গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে বেশি থাকবে। কারণ সেখানে ডার্ক ম্যাটারের ঘনত্ব বেশি।

এই ধারণা একেবারে নতুন নয়। ২০০৭ সালে বিজ্ঞানী ক্যাথরিন ফ্রিস, ডগলাস স্পোলিয়ার এবং পাওলো গন্দোলো প্রথম এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, মহাবিশ্বের শুরুতে এমন কিছু "ডার্ক স্টার" তৈরি হতে পারে, যেগুলোর শক্তির উৎস হবে ডার্ক ম্যাটার। তখন সেটাকে শুধু তত্ত্ব হিসেবে ধরা হয়েছিল। এখন সেই তত্ত্বেই আবার নতুন করে প্রাণ এসেছে।

সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) কয়েকটি অদ্ভুত জ্যোতির্বস্তু খুঁজে পেয়েছে, যেগুলো দেখতে প্রাচীন নক্ষত্রের মতো, কিন্তু তাদের আকার অনেক বড়। কিছু বিজ্ঞানী বলছেন, এগুলো হয়তো সত্যিই সেই ডার্ক স্টার, যাদের কথা আগে বলা হয়েছিল।

কলগেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কসমিন ইলি বলেন, "আমরা বহু বছর আগে ধারণা করেছিলাম, জেডব্লিউএসটি দিয়ে এই ধরনের সুপারম্যাসিভ ডার্ক স্টার দেখা যাবে। এখন হয়তো সেই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হচ্ছে।"

এই সব কিছুই এখনো গবেষণার পর্যায়ে আছে। কিন্তু যদি সত্যিই এমন ডার্ক ডোয়ার্ফ বা ডার্ক স্টার খুঁজে পাওয়া যায়, তাহলে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আমূল বদলে যাবে। আমরা শুধু আন্দাজ করে নয়, চোখে দেখে, মাপজোখ করে বলতে পারব—হ্যাঁ, ডার্ক ম্যাটার আছে, এবং তা সত্যিকারের শক্তি তৈরি করতে পারে।

এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, মহাবিশ্ব এখনো কতটা রহস্যে ভরা। আমাদের চারপাশে এমন অনেক কিছু আছে, যা আমরা দেখিই না। তবু তারা আছে, কাজ করছে, আর কখনো কখনো হয়তো আমাদের চোখে ধরা দেওয়ার অপেক্ষায় আছে। ডার্ক ম্যাটার চালিত নক্ষত্র সেই অপেক্ষারই এক নতুন ইঙ্গিত। সামনে হয়তো এইসব অদ্ভুত জ্যোতিষ বস্তু আমাদের জানাবে মহাবিশ্বের আরও গভীর রহস্যের কথা।

সূত্র: সায়েন্স অ্যালার্ট

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

সোমপুর বিহারের ইতিহাস

সোমপুর বিহারের মূল স্থাপনাটি আয়তাকার, যার মাঝখানে আছে একটি বিশাল স্তূপ। চারপাশে ঘিরে রয়েছে ১৭৭টি কক্ষ, যেগুলোতে ভিক্ষুরা থাকতেন। অনেকেই এটিকে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এখানে শুধু ধর্মগ্রন্থ পাঠ নয়, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিদ্যা, দর্শন, গণিত ও শিল্পকলার শিক্ষা হতো। অর্থাৎ এটি ছিল এক ধরনের

২ দিন আগে

উটপাখি কি সত্যিই বালুতে মুখ লুকায়?

উটপাখি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাখি। এরা আফ্রিকার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে ছুটে বেড়ায়, শক্তিশালী পা দিয়ে ঘণ্টায় প্রায় ৭০ কিলোমিটার বেগে দৌড়াতে পারে। বিশাল ডানার ঝাপটায় হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে হিংস্র প্রাণীকেও ভয় দেখাতে পারে। কিন্তু মানুষ দীর্ঘদিন ধরে একটা অদ্ভুত ধারণা পোষণ করে এসেছে—উটপাখি নাকি বিপদে পড়লেই মাথা বা

২ দিন আগে

শিমের বিঁচির পুষ্টিগুণ

শিমের বিঁচিতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের মধ্যে শিমের বীজ অন্যতম সেরা উৎস। যারা মাংস বা মাছ কম খান কিংবা নিরামিষভোজী, তাদের জন্য শিমের বিঁচি একটি অসাধারণ বিকল্প হতে পারে। প্রোটিন আমাদের শরীরের পেশী গঠন, রক্ত তৈরিসহ নানা কাজে লাগে।

২ দিন আগে

হার্নিয়া সার্জারি নিয়ে কিছু কথা

২ দিন আগে