ঐতিহ্য

বাঙালির হালখাতা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১৩: ৩৬
এক সময় হালতাখা ছিল নববর্ষের অন্যতম ঐতিহ্য

পহেলা বৈশাখ মানেই নতুন ক্যালেন্ডারের পাতা, নতুন আশা আর নতুন করে পথচলার দিন। এই দিনে ছোট থেকে বড় সবাই রঙিন পোশাকে সেজে ওঠে, নানা রকমের খাবার রান্না হয়, বাড়িতে অতিথি আসে, মেলা বসে, আর গান-বাজনার আয়োজন হয়। কিন্তু এই উৎসবের আরেকটি দিক রয়েছে, যেটি অনেকেই হয়তো ভুলে যেতে বসেছেন। সেটি হলো— হালখাতা।

‘হালখাতা’ শব্দটি শুনলেই মনে আসে দোকানের নতুন খাতা, দোকান সাজানো, মিষ্টি খাওয়া আর একটা উৎসবমুখর পরিবেশ। ব্যবসায়ীরা এই দিনটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। কারণ এই দিনে তারা পুরনো বছরের হিসেব চুকিয়ে নতুন খাতা খুলে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করেন।

‘হাল’ শব্দটি সংস্কৃত ভাষায় ‘লাঙল’ অর্থে ব্যবহৃত হয়, আবার ফারসি ভাষায় এর মানে ‘নতুন’। আর ‘খাতা’ মানে খাতা বা রেজিস্টার। তাই ‘হালখাতা’ মানে দাঁড়ায়— নতুন হিসাবের খাতা। এটি শুধু একটি খাতা নয়, বরং এটি বাঙালির জীবনে বছরের হিসাব মেলানোর এবং নতুন করে শুরু করার প্রতীক।

বাংলা সনের ইতিহাস নিয়ে নানা মত রয়েছে। তবে বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, মোগল সম্রাট আকবর এই সন চালু করেন। তার আমলে খাজনা আদায় হতো হিজরি (চন্দ্র) ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। এতে সমস্যা হতো, কারণ হিজরি বছর কৃষির মৌসুমের সঙ্গে মিলত না। ফলে কৃষকরা অসুবিধায় পড়ত। এই সমস্যা সমাধানে সম্রাট আকবর জ্যোতিষী আমির ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে দিয়ে নতুন একটি ক্যালেন্ডার তৈরি করান, যাতে হিজরি এবং হিন্দু পঞ্জিকার সমন্বয় করা হয়। এটি ছিল মূলত ফসলি সন, যা পরে হয়ে যায় বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ।

নতুন এই বর্ষপঞ্জি চালু হওয়ার পর, জমিদাররা চৈত্র মাসের শেষ দিনে প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতেন, আর পহেলা বৈশাখে তাদের মিষ্টি খাওয়াতেন, আপ্যায়ন করতেন। সেই সময় থেকেই ‘হালখাতা’ চালু হয়। জমিদারদের পর ব্যবসায়ীরাও এই রীতিকে গ্রহণ করেন।

একসময় পাটসহ নানা ফসল বিক্রি করে কৃষকের হাতে টাকা আসত বছরে নির্দিষ্ট সময়। সেই সময় অনেক কৃষক দোকান থেকে বাকিতে জিনিস কিনতেন। এরপর ফসল বিক্রি করে পহেলা বৈশাখে দোকানে এসে দেনা পরিশোধ করতেন। ব্যবসায়ীরাও খরিদ্দারদের দাওয়াত দিয়ে দোকানে আমন্ত্রণ জানাতেন। দোকান সাজানো হতো রঙিন কাগজে, ঝালর দিয়ে। ফেস্টুনে লেখা থাকত— “শুভ নববর্ষ”, “শুভ হালখাতা”।

এই দিনে দোকানে আসা খরিদ্দারদের মিষ্টিমুখ করানো হতো, গল্প-আড্ডায় জমে উঠত পরিবেশ। নতুন খাতা খুলে হিসেব শুরু হতো। অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী এই খাতা নিয়ে মন্দিরে যেতেন পূজা দিতে।

বিশেষ করে পুরান ঢাকায় হালখাতার আলাদা একটি আবহ ছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই এই দিনটিকে এক উৎসব হিসেবে নিতেন। ব্যবসায়ীরা দোকান সেজে তুলতেন, অনেক জায়গায় ধূপধুনাও দেওয়া হতো। অতিথিদের জন্য থাকত পান-সুপারি, মিষ্টি আর ছোটখাটো উপহার। এভাবেই পুরান ঢাকায় ‘হালখাতা’ ছিল শুধু ব্যবসার হিসাব নয়, বরং এক মিলনমেলা।

একসময় বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ একটি উৎসব চালু করেন, যার নাম ছিল ‘পুণ্যাহ’। সেটিও ছিল খাজনা আদায়ের সময়কার এক ধরনের উৎসব। যদিও সেই উৎসব সময়ের সঙ্গে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হালখাতা টিকে আছে আজও।

বর্তমানে আগের মতো জাঁকজমক নেই। এখন মোবাইল ব্যাংকিং বা ডিজিটাল পেমেন্টের যুগে অনেকেই দোকানে গিয়ে দেনা পরিশোধ করেন না। তবে এখনো পুরান ঢাকার কিছু দোকানে, গ্রামীণ এলাকাগুলোতে হালখাতা পালন করা হয়। অনেকে এখনো নতুন বছরের শুরুতে দোকান সাজান, পুরোনো খাতা বন্ধ করে নতুন খাতা খোলেন।

হালখাতা শুধু একটি হিসেবের খাতা নয়, এটি ব্যবসায়ী ও খরিদ্দারদের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার মাধ্যম। এই দিনে একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়, হাসিমুখে পুরোনো দেনা মেটানো হয়, আর নতুন করে ব্যবসার পথচলা শুরু হয়।

হালখাতা বাঙালির সংস্কৃতির একটি মূল্যবান অংশ। সময়ের সঙ্গে এর চেহারা বদলালেও আবেগ এখনো টিকে আছে। পহেলা বৈশাখ মানেই নতুন সূচনা, আর হালখাতা সেই শুরুর অন্যতম অনুষঙ্গ। ব্যবসায়িক সম্পর্ককে সৌহার্দ্যপূর্ণ করে তুলতে, মানুষের মাঝে ভালোবাসা বাড়াতে হালখাতা উৎসবের গুরুত্ব কখনোই কমে না। তাই বলা যায়— বাংলা নববর্ষ আর হালখাতা, দুটিই মিলেই বাঙালির প্রাণের উৎসব।

ad
ad

ফিচার থেকে আরও পড়ুন

রবীন্দ্রনাথের গানে বরষা

তাঁর বর্ষার গানগুলোতে প্রকৃতি নিজেই যেন একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের আকাশ, মাঠে জমে থাকা জল, ছায়া মাখানো পথঘাট, ঝরঝর বৃষ্টি, পলিফাটা মেঘ—সবই যেন তাঁর গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব কেবল চিত্রায়ন নয়, বরং এগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান মানুষের গভীর অনুভব, ভালোবাসা, নির্জনতা ও চিরপ্রত্

১৪ ঘণ্টা আগে

কাঁচা কলার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা কী কী?

কাঁচা কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ। এই আঁশ হজমে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষ দিনের পর দিন ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ নিয়মিত কাঁচা কলা খেলে তারা অনেকটা স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, কাঁচা কলা প্রাকৃতিকভাবে হজম শক্তি বাড়ায়।

২ দিন আগে

বাংলা ও দিল্লি সালতানাতের যুদ্ধ: ইতিহাসের এক অস্থির অধ্যায়

দিল্লি সালতানাতের শাসকরা—বিশেষত গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খিলজি, এবং পরবর্তী কালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ও স্বাধিকার দাবি দিল্লির কর্তৃত্বকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনার পেছনে শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না, বরং বাংলা

২ দিন আগে

হার্ট সুস্থ রাখতে কী করবেন?

হার্ট ভালো রাখার মূল মন্ত্র হলো—নিয়মিত রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার এবং বেশি এলডিএল কোলেস্টেরল ধমনীর ভেতরে প্লাক জমিয়ে রাখে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া ব্লাড সুগার লেভেল বেশি থাকলে বা ডায়াবেটিস হলে হার্টের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২ দিন আগে