ইতিহাস

বাংলা ও দিল্লি সালতানাতের যুদ্ধ: ইতিহাসের এক অস্থির অধ্যায়

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৫, ১৫: ২২
চ্যাটজিপিটির চোখে বাংলা ও দিল্লির সংঘাত

বাংলা ও দিল্লি সালতানাতের দীর্ঘদিনের সংঘাতের ইতিহাস রয়েছে। এ সংঘাত শুধু দুটি শক্তির মধ্যকার ক্ষমতার লড়াই ছিল না—এটি ছিল রাজনৈতিক আধিপত্য, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য এবং আঞ্চলিক স্বাধীনতার প্রশ্নে এক দীর্ঘ সময়ব্যাপী দ্বন্দ্ব। বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরু পর্যন্ত বাংলা ছিল দিল্লির নজরে থাকা এক সমৃদ্ধ অঞ্চল, যা কেবল কর আদায়ের উৎস নয়, বরং একটি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড হিসেবেও দেখা হতো। দিল্লি সালতানাত যখন উত্তর ভারতের বিশাল অংশ দখলে নিচ্ছিল, তখন বাংলাকে তারা তাদের প্রদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলা ছিল স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়, যা এই অঞ্চলকে দিল্লির সঙ্গে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়ায়।

দিল্লি সালতানাতের শাসকরা—বিশেষত গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খিলজি, এবং পরবর্তী কালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ও স্বাধিকার দাবি দিল্লির কর্তৃত্বকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনার পেছনে শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না, বরং বাংলার স্থানীয় রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা, ভৌগোলিক দুর্ভেদ্যতা এবং জনগণের স্বাধীনচেতা মনোভাবও দিল্লিকে বারবার প্রতিহত করেছে।

১৩০১ সালে দিল্লির পাঠানো সেনাপতি উলুঘ খান বাংলায় অভিযান চালিয়ে সফল হলেও, সেই বিজয় দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলায় ক্ষমতায় আসে বিভিন্ন স্থানীয় রাজন্যবর্গ, যারা নিজেরাই কখনও দিল্লির অনুমোদন ছাড়াই সুলতান বা গভর্নর হিসেবে শাসন করতে থাকে। এই অবস্থাকে ঐতিহাসিকরা বলেন "আধা-স্বাধীনতা"। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ পিটার হার্ডি বলেন, “বাংলা সবসময়ই দিল্লির নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি বিপজ্জনক জায়গা ছিল। দিল্লি সেখানে শাসক পাঠালেও স্থানীয় শক্তিগুলো সহজে তাদের মেনে নেয়নি।”

বলা হয়, ১৩২৪ সালে দিল্লির সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক নিজে বাংলার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। তখন বাংলায় ক্ষমতায় ছিলেন শামসউদ্দিন ফিরোজ শাহের উত্তরসূরি, যিনি নিজেকে স্বাধীন শাসক বলে দাবি করতেন। গিয়াসউদ্দিনের বাহিনী প্রবল শক্তি নিয়ে ঢুকে পড়ে বাংলায়। কিন্তু ইতিহাসের বাঁকে দেখা যায়, দিল্লির এই বিজয়ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সুলতানের মৃত্যুর পর বাংলা আবারও নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফলে এই এলাকা কখনো দিল্লির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসেনি।

এ বিষয়ে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাসবিদ বার্নার্ড লুইস বলেন, “দিল্লি সালতানাতের শাসকগণ সবসময় বাংলাকে একটি ‘বিদ্রোহপ্রবণ অঞ্চল’ হিসেবে দেখতেন। কিন্তু এই বিদ্রোহ ছিল রাজনৈতিক চেতনার একটি স্বাভাবিক ফল, কারণ বাংলা ছিল অত্যন্ত দূরবর্তী এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। দিল্লি সেখানে শুধু সেনা পাঠাতে পারত, কিন্তু শিকড় গেড়ে শাসন করা তাদের পক্ষে কঠিন ছিল।”

বাংলার একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল এর স্থানীয় অভিজাত শ্রেণি, যাঁরা নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। এই অভিজাতদের মধ্যে কেউ কেউ দিল্লির সঙ্গে সমঝোতা করে শাসন করেছেন, কেউ আবার প্রকাশ্যে বিদ্রোহ করেছেন। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, দিল্লি থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরের বাংলায় সরাসরি প্রশাসন চালানো ছিল সময়ের প্রযুক্তি ও যোগাযোগব্যবস্থার পক্ষে প্রায় অসম্ভব। সেই সুযোগে বাংলার গভর্নররা মাঝেমধ্যে নিজেকে সুলতান ঘোষণা করেছেন। যেমন—শামসউদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৪২ সালে বাংলায় স্বাধীন সুলতান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ‘শাহবাগ’ রাজবংশের সূচনা করেন।

ইলিয়াস শাহের শাসনামল থেকেই মূলত বাংলার স্বাধীনতা এক নতুন রূপ পায়। তিনি উত্তর ও দক্ষিণ বাংলা একত্রিত করে একটি শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলেন। তিনি রাজধানী করেন গৌড়। পরবর্তী দুই দশকে তাঁর বংশধরেরা মুদ্রা জারি করেন, নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং দিল্লির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে শাসন করেন। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ রিচার্ড এম ইটন বলেন, “ইলিয়াস শাহ একটি জাতীয়তাবাদী রাজ্যের ভিত্তি গড়ে দেন, যা শুধু দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে নয়, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।”

দিল্লি যদিও একাধিকবার বাংলায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু বাস্তবতা ছিল, বাংলার নদী, বন এবং জনপদভিত্তিক জটিল ভূপ্রকৃতি তাদের সেনাবাহিনীর জন্য অনুকূল ছিল না। নদীর উপর নির্ভরশীল যোগাযোগব্যবস্থা এবং বর্ষাকালে যাতায়াতের সমস্যা দিল্লির পক্ষে বাংলায় দীর্ঘমেয়াদী সামরিক উপস্থিতি কঠিন করে তোলে। তা ছাড়া বাংলার সমাজে মুসলিম শাসকদের প্রতি ব্যাপক জনসমর্থন ছিল না। তাই সেনাশক্তি দিয়ে শাসন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

বাংলা ও দিল্লির সংঘর্ষের আরেকটি দিক ছিল সাংস্কৃতিক পার্থক্য। দিল্লি সালতানাত মূলত পারস্যভিত্তিক প্রশাসনিক ধারা অনুসরণ করত। তাদের ভাষা ছিল ফার্সি, এবং অনেকক্ষেত্রে শাসন ও বিচারব্যবস্থায় স্থানীয় ভাষা বা সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। কিন্তু বাংলায় শাসকেরা ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। বিশেষ করে ইলিয়াস শাহ বংশ এবং পরে হোসেন শাহ বংশ এই দিক থেকে উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলেন, “বাংলার শাসকগণ স্থানীয় সংস্কৃতিকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, যা দিল্লির কড়াকড়ি প্রশাসনের তুলনায় অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল।”

সব মিলিয়ে দেখা যায়, বাংলা ও দিল্লির মধ্যকার যুদ্ধ কেবল অস্ত্রধারী সংঘর্ষ ছিল না। এটি ছিল প্রশাসনিক দক্ষতা বনাম কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের লড়াই। বাংলা যে শেষ পর্যন্ত একটি শক্তিশালী ও আত্মনির্ভরশীল সুলতানাত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, সেটি এ কথা প্রমাণ করে যে, দিল্লির একচ্ছত্র আধিপত্য সেসময়ে পুরো উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং বাংলা ছিল এক অনন্য ব্যতিক্রম, যে নিজস্ব ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গড়ে তুলেছিল এক স্বাধীন পথ।

এই যুদ্ধ ও সংঘর্ষের ইতিহাস থেকে আজও আমরা শিক্ষা নিতে পারি—স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর এই আত্মপরিচয়ের সংগ্রামই বাংলা ও দিল্লির সংঘর্ষকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে, যা ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে রয়ে গেছে।

ad
ad

রাজনীতি থেকে আরও পড়ুন

কিছু দল শপথ করেছে পিআর ছাড়া নির্বাচনে যাবে না: ফখরুল

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সমস্যা হলো আমাদের (রাজনৈতিক দলগুলোর) নতুন নতুন চিন্তা আসছে, যেগুলো আমাদের দেশে পরিচিত নয়। সংসদে আনুপাতিক হারে নির্বাচন, এটা দেশের মানুষ বোঝেই না। পিআর কী জিনিস? জনগণ এখনো ইভিএমে ভোট দিতে পারে না, বোঝে না। সুতরাং পিআর চিন্তাভাবনা থেকে দূরে সরে যেতে হবে।’

১০ ঘণ্টা আগে

ভাসানী না থাকলে শেখ মুজিব তৈরি হত না: নাহিদ

এনসিপির আহ্বায়ক বলেন, ‘মওলানা ভাসানী শুধু বাংলাদেশের নন, উপমহাদেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তাঁর রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল আসামে। সেখানে তিনি বাঙালি মুসলিম কৃষকদের ভূমি ও নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই করেছিলেন, যে লড়াই আজও আসামের বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুদের করতে হচ্ছে।’

১০ ঘণ্টা আগে

জুলাই সনদের খসড়া অসম্পূর্ণ ও বিপজ্জনক: জামায়াত

জুলাই সনদের খসড়াকে অসম্পূর্ণ এবং এর কিছু অংশ বিপজ্জনক বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। ত‌বে ক‌মিশন বলছে, খসড়া একটি নমুনা মাত্র। তবে যদি সেটাই গ্রহণ করা হয়, তাহলে প্রস্তা‌বিত সনদ গ্রহণ করা যাবে না।

১১ ঘণ্টা আগে

জুলাই সনদের খসড়া গ্রহণ করতে পারি না: এনসিপি

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেছেন, কমিশন সভায় যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে, নির্বাচনের আগে একটি আইনি কাঠামোর মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দিতে হবে।

১১ ঘণ্টা আগে