সাহিত্য

রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা

অরুণাভ বিশ্বাস
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৮: ০০
চ্যাটজিপিটির চোখে রবীন্দ্রনাথ ও বর্ষা

বর্ষা মানেই শুধু অঝোরে বৃষ্টি, কাদা, ছাতা, টিনের চালে ঝম শব্দ আর রবিঠাকুরের গান । বাংলার কবিদের কাছে বর্ষা হলো এক অনন্য রোমান্টিক ঋতু, অন্তর্লোকের অন্তঃস্বর, অপেক্ষা, আকুতি আর মিলনের প্রতিচ্ছবি। আর এই বর্ষা যখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে ধরা দেয়, তখন তা হয়ে ওঠে শব্দে-সুরে এক মায়াবী আবেশ। রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা কেবল প্রকৃতির পরিবর্তন নয়, বরং তা মননের রূপ, প্রেমের পরিণতি, আর চিরন্তন পথচলার প্রতীক। এই ঋতুকে নিয়ে তাঁর গান যেন হয়ে উঠেছে বাংলা গানের এক অমলিন অধ্যায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা গানের জগতে এক অনন্য প্রতিভা, যিনি প্রকৃতির প্রতিটি ঋতুকে আলাদা করে অনুভব করেছেন, লিখেছেন, সুর বেঁধেছেন, এবং সেই সঙ্গে মানুষের মনের অন্তর্গত অনুভবগুলোর প্রতিও রেখেছেন সূক্ষ্ম দৃষ্টি। তাঁর ‘বর্ষার গান’ বা 'বর্ষামেঘের সুর' যেন আমাদের ভেজা স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে, আর মনকে করে তোলে উদাসীন ও কোমল।

রবীন্দ্রসংগীতে বর্ষা আসে ধীরে ধীরে, যেমন নেমে আসে শ্রাবণের মেঘ। তিনি বর্ষার বৃষ্টি ও মেঘকে শুধুই আবহাওয়া হিসেবে দেখেননি, বরং এটিকে ব্যবহার করেছেন আত্মা, হৃদয় এবং প্রেমের প্রতীক হিসেবে। তাঁর গানে বর্ষা কখনও প্রেমের প্রতীক্ষা, কখনও বিচ্ছেদের সুর, আবার কখনও মিলনের ঘনঘটা। "আজি ঝর ঝর মুখর বাদরদিনে" কিংবা "এবার ফিরাও মোরে, মেঘ"—এই গানগুলোর মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে সেই অনন্ত আকাঙ্ক্ষা, যা বৃষ্টির ধারা আর বাদলের ছন্দে বেজে ওঠে।

তাঁর বর্ষার গানগুলোতে প্রকৃতি নিজেই যেন একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের আকাশ, মাঠে জমে থাকা জল, ছায়া মাখানো পথঘাট, ঝরঝর বৃষ্টি, পলিফাটা মেঘ—সবই যেন তাঁর গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব কেবল চিত্রায়ন নয়, বরং এগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান মানুষের গভীর অনুভব, ভালোবাসা, নির্জনতা ও চিরপ্রত্যাশার ছায়া। তাঁর গানে বৃষ্টি যেমন একাকিত্বের সঙ্গী, তেমনি কখনও তা হয়ে ওঠে আবেগের বিস্তার। যেমন “মেঘ বলেছে যাব যাব”—এই গানটিতে মেঘ যেন হয়ে ওঠে প্রিয়ের প্রতীক, যে চলে যেতে চাইছে, আর প্রেমিকের মন ছেঁড়ে যাচ্ছে ব্যাকুলতায়।

বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রবীন্দ্রগবেষক ও সাহিত্যবিদ অধ্যাপক শমিত বসু তাঁর গবেষণাপত্রে বলেন, “রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা শুধুমাত্র প্রকৃতির একটি ঋতু নয়, বরং এটি এক ধরণের সময়-সচেতনতা। এই ঋতু যেন তাঁর কাছে স্মৃতির পটভূমি, অপেক্ষার রস, আর মানব-প্রকৃতি মেলবন্ধনের এক চূড়ান্ত রূপ। বর্ষার গানে তিনি প্রকৃতির গায়ে মানবিকতার পরশ দিয়েছেন।” (সূত্র: 'রবীন্দ্রনাথের গানে ঋতুবোধ', পত্রিকা: সাহিত্যচর্চা, ২০১৮)

রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান কেবল প্রকৃতির রূপকে নয়, বরং অন্তর্জগতের এক বিশাল মানচিত্রকে প্রকাশ করে। ‘এ দিন দুঃখে রঙ ধরে’ বা ‘বিধির বেণু বাজে বনে বনে’—এইসব গানে বোঝা যায়, বর্ষা কেবল বাহ্যিক ভেজা নয়, এটি এক ভেতরের আবেগিক ভেজাভাব, যা ভরিয়ে দেয় হৃদয়, জাগিয়ে তোলে স্মৃতি। তাঁর ‘গীতবিতান’-এর বর্ষা পর্যায়ের গানগুলো পড়লে দেখা যায়, কী নিখুঁতভাবে তিনি বর্ষার মধ্য দিয়ে জীবনবোধ, প্রেম ও ব্যথাকে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর গানে বারবার ফিরে আসে দূরত্বের ব্যথা, অপেক্ষার বিষাদ, আবার কখনও চমৎকার মিলনের রসায়ন।

প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত গবেষক ও কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য বলেন, “রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানগুলো শুধু আবহমান বাংলার প্রকৃতিকে নয়, বরং মানুষের অন্তর্জীবনকেও নির্মাণ করে। তাঁর সৃষ্টিতে বর্ষা একাধারে আত্মোপলব্ধির সময় এবং জীবনের অন্তহীন প্রবাহের প্রতীক। বর্ষার বৃষ্টিতে তাঁর সুর যেমন ভিজে ওঠে, তেমনি চিন্তাও হয়ে ওঠে আর্দ্র ও জীবন্ত।” (সূত্র: ‘রবীন্দ্রনাথ: ঋতুর কাব্যে’, প্রকাশনা: কালান্তর, ২০২০)

রবীন্দ্রনাথ বর্ষার গানে কখনও গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন, আবার কখনও দিয়েছেন মিলনের সুর। ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’ গানটিতে যেমন প্রথম প্রেমের আবেশ ও বৃষ্টিভেজা অনুভূতি ফুটে ওঠে, তেমনি ‘আমি চুপে চুপে চলি আঁধারে’ গানে তিনি দেখিয়েছেন বর্ষার একাকিত্ব, হারানোর ভয় ও নিঃসঙ্গতার অনুভব। তাঁর গানে বর্ষা যেন সময়কে স্থির করে দেয়, মনকে গভীরে নিয়ে যায়, এবং সৃষ্টিকে করে তোলে মূর্ত।

রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা কেবল বাংলা প্রকৃতির গুণগান নয়, বরং এই গানে তিনি একজন ভাবুক, দার্শনিক ও প্রেমিক হিসেবে বর্ষাকে অনুভব করেছেন। তাঁর জন্য বর্ষা এক ধরণের অন্তর্গত উপলব্ধি, যা জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। তাঁর বর্ষার গানে কখনও নদীর কলতান, কখনও কদমফুলের গন্ধ, আবার কখনও মেঘের গর্জন ও বজ্রের শব্দ—সবই এক অনুপম সুরের রূপে উঠে এসেছে।

এইসব গান শুধুমাত্র শুনে মন ভালো হয়ে যায় না, বরং এগুলো আমাদের মনে এক দীর্ঘস্থায়ী আবেশ রেখে যায়। বর্ষা নিয়ে অনেকেই গান লিখেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানে বর্ষা যেন হয়ে উঠেছে এক জীবন্ত অনুভূতি। তাঁর গান শুনলে মনে হয়, যেন বৃষ্টি নামছে কেবল প্রকৃতিতে নয়, হৃদয়ের গহীনে।

শেষ কথা হলো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর গানে বর্ষাকে এমন এক উচ্চতর মাত্রায় নিয়ে গেছেন, যা বাংলা সাহিত্যে চিরকালীন হয়ে থাকবে। তিনি বর্ষাকে কেবল দেখে যাননি, বরং অনুভব করেছেন—মন দিয়ে, হৃদয় দিয়ে। আর সেই অনুভবই তিনি দিয়েছেন আমাদের হাতে, তাঁর গানের মাধ্যমে। তাই বর্ষা এলেই বাংলার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর বাজে—“এবার তোরা মানুষ হ, মেঘ।”

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

নাশপাতি কেন খাবেন?

নাশপাতির মধ্যে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এই ফলটিতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, ভিটামিন সি , পটাশিয়াম , এবং নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। নাশপাতিতে ফ্যাট বা চর্বি একেবারেই নেই বললেই চলে, আর ক্যালোরিও কম, তাই যাঁরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখত

১৯ ঘণ্টা আগে

কাঁচা কলার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা কী কী?

কাঁচা কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ। এই আঁশ হজমে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষ দিনের পর দিন ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ নিয়মিত কাঁচা কলা খেলে তারা অনেকটা স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, কাঁচা কলা প্রাকৃতিকভাবে হজম শক্তি বাড়ায়।

২ দিন আগে

বাংলা ও দিল্লি সালতানাতের যুদ্ধ: ইতিহাসের এক অস্থির অধ্যায়

দিল্লি সালতানাতের শাসকরা—বিশেষত গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খিলজি, এবং পরবর্তী কালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ও স্বাধিকার দাবি দিল্লির কর্তৃত্বকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনার পেছনে শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না, বরং বাংলা

২ দিন আগে

হার্ট সুস্থ রাখতে কী করবেন?

হার্ট ভালো রাখার মূল মন্ত্র হলো—নিয়মিত রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার এবং বেশি এলডিএল কোলেস্টেরল ধমনীর ভেতরে প্লাক জমিয়ে রাখে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া ব্লাড সুগার লেভেল বেশি থাকলে বা ডায়াবেটিস হলে হার্টের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২ দিন আগে