স্বাস্থ্য

ত্রিফলার উপকারিতা

ডেস্ক, রাজনীতি ডটকম
প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১৯: ৩৫
চ্যাটজিপিটির চোখে ত্রিফলা

ত্রিফলা—একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক মিশ্রণ, যার নাম শুনলেই ভারতের আয়ুর্বেদ চিকিৎসার দীর্ঘ ইতিহাসের কথা মনে পড়ে। এই তিনটি ফলের সংমিশ্রণ আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী বলে ধরা হয়। ত্রিফলার তিনটি উপাদান হলো—আমলকি, হরীতকি ও বহেড়া। এই তিনটি ফলই আলাদাভাবে নানা রোগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু যখন এদের একত্র করা হয়, তখন তা আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বহু শতাব্দী ধরে ভারত, নেপাল, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন প্রাকৃতিক চিকিৎসাপদ্ধতিতে ত্রিফলা ব্যবহার হয়ে আসছে। আজও আধুনিক গবেষণায় প্রমাণ মিলছে যে, ত্রিফলা শুধুমাত্র একটি গুঁড়ো মিশ্রণ নয়—এটি একটি প্রাকৃতিক ওষুধ, যেটি শরীরের নানা দিক থেকে উপকার করে।

ত্রিফলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ হলো এটি প্রাকৃতিকভাবে ডিটক্সিফায়ার হিসেবে কাজ করে। এটি শরীর থেকে টক্সিন বের করে দেয় এবং পাচনতন্ত্রকে পরিষ্কার রাখে। যাঁরা নিয়মিত ত্রিফলা খান, তাঁদের হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য ও অ্যাসিডিটির মতো সমস্যাগুলো অনেকাংশে দূর হয়। ত্রিফলা আমাদের অন্ত্রের গতিশীলতা বাড়িয়ে দেয় এবং মলত্যাগকে সহজ করে। বিশেষ করে হারীতকি উপাদানটি প্রাকৃতিক ল্যাক্সেটিভ হিসেবে কাজ করে, ফলে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। আমলকি বা আমলকী ভিটামিন সি-তে ভরপুর, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং ত্বক ও চুল ভালো রাখে। অন্যদিকে বিভীতকি লিভারকে সুস্থ রাখে এবং রক্ত বিশুদ্ধ করতে সাহায্য করে।

২০০৬ সালে জার্নাল অব অল্টারনেটিভ অ্যা কমপ্লিমেন্টরি মেডিসিন -এ প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ত্রিফলা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে অত্যন্ত কার্যকর। ক্যালিফোর্নিয়ার ইউনিভার্সিটি অব লস অ্যাঞ্জেলেস-এর গবেষক ড. মারিয়া রোমারো বলছেন—“আমরা যখন ল্যাবরেটরিতে ত্রিফলার এক্সট্রাক্ট নিয়ে পরীক্ষা করি, দেখি এটি কোষের মধ্যে ফ্রি র‌্যাডিক্যাল ধ্বংস করতে পারে, যা বার্ধক্যজনিত রোগ ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগের জন্য দায়ী।” ড. রোমারোর মতে, “ত্রিফলার এই অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ক্ষমতা শুধু ত্বক নয়, হৃদযন্ত্রকেও সুরক্ষা দিতে পারে।” তাঁর গবেষণায় উল্লেখ করা হয় যে, ত্রিফলা নিয়মিত সেবনে রক্তচাপ ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

আরেকজন মার্কিন গবেষক ড. জেফ্রি ব্ল্যান্ড, যিনি ইনস্টিটিউট ফর ফাংশনাল মেডিসিনের প্রতিষ্ঠাতা, বলেন—“ত্রিফলা আসলে গাট হেলথ-এর জন্য এক দুর্দান্ত টনিক। আমরা এখন জানি, আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্যই নির্ধারণ করে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য ও রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন হবে। ত্রিফলা সেই অন্ত্রকে পরিষ্কার ও স্বাস্থ্যবান রাখতে কাজ করে।” তিনি আরও বলেন, “যাঁদের দীর্ঘদিনের ইরিটেবল বাওয়েল সিনড্রোম বা আইবিএস রয়েছে, তাঁদের জন্য ত্রিফলা প্রাকৃতিক ও নিরাপদ বিকল্প হতে পারে।”

ত্রিফলার উপকারিতা শুধু হজমে নয়, এটি চোখের জন্যও ভালো। ভারতের আয়ুর্বেদ গ্রন্থ চরক সংহিতা-তেও চোখের রোগ নিরাময়ে ত্রিফলার ব্যবহার উল্লেখ আছে। আজকের দিনে এসে বিজ্ঞান এই দাবিকে সমর্থন করছে। ২০১৮ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালোরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব আয়ুর্বেদ-এর একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, চোখ ধোয়ার জন্য ত্রিফলার জল ব্যবহার করলে কনজাংকটিভাইটিসের উপসর্গ কমে যায়। একই সঙ্গে এটি চোখের ক্লান্তি ও খিচখিচে ভাব দূর করে।

ত্রিফলা রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়—এটা প্রাচীনকাল থেকেই জানা। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, এটি দেহে টি-সেলস এবং ন্যাচরাল কিলার সেল-এর সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়, যেগুলো ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে। নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ইমিউনোলজিস্ট ড. লরা ক্যাম্পবেল বলেন—“আমরা ত্রিফলার উপাদান বিশ্লেষণ করে দেখেছি যে, এতে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলো ইমিউন সিস্টেমকে প্রাকৃতিকভাবেই সক্রিয় করে তোলে। বিশেষত, বিভীতকিতে থাকা গ্যালিক অ্যাসিড এবং এলাজিক অ্যাসিড শরীরে ভাইরাসের বিস্তার রোধে ভূমিকা রাখতে পারে।”

চুল ও ত্বকের ক্ষেত্রেও ত্রিফলার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। ত্রিফলা খেলে যেমন শরীরের ভেতরের পুষ্টির ভারসাম্য ঠিক থাকে, তেমনি বাইরে থেকে ব্যবহার করলে তা ত্বকের ব্রণ, দাগছোপ কমাতে সাহায্য করে। অনেকে ত্রিফলা গুঁড়ো জল মিশিয়ে মুখে মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করেন। এটি প্রাকৃতিক স্ক্রাবারের মতো কাজ করে। ত্রিফলার অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল বৈশিষ্ট্য ত্বকের ইনফেকশন প্রতিরোধে সাহায্য করে।

আধুনিক জীবনে মানসিক চাপ বা স্ট্রেস একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ড. রাজেশ মেহতা বলেন—“ত্রিফলা মস্তিষ্কের অস্থিরতা কমাতে পারে। এটি ঘুম ভালো করতে সাহায্য করে, এবং যারা ইনসমনিয়ায় ভোগেন, তাঁদের জন্যও উপকারী।” গবেষণায় দেখা গেছে, ত্রিফলায় থাকা অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান মস্তিষ্কের স্নায়ুকে শান্ত করে।

অবশ্যই বলা দরকার, ত্রিফলা সব রোগের যাদুকাঠি নয়। যাঁদের ডায়রিয়া বা অতিরিক্ত পাতলা পায়খানার সমস্যা আছে, তাঁদের জন্য ত্রিফলা কখনো কখনো বিরূপ হতে পারে। এছাড়া গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও ত্রিফলা ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ত্রিফলা পাউডার, ক্যাপসুল, ট্যাবলেট—বিভিন্ন রূপে পাওয়া যায়। তবে খাঁটি গুঁড়ো আকারেই এটি সবচেয়ে কার্যকর বলে মনে করেন বহু আয়ুর্বেদ চিকিৎসক।

ত্রিফলা আসলে একধরনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী। এটি শরীরকে শুধু রোগমুক্ত রাখে না, শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন নিজের স্বাভাবিক ছন্দে কাজ করে, সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। তাই বহু শতাব্দী পার হয়ে গেলেও ত্রিফলা আজও প্রাসঙ্গিক, কার্যকর ও শ্রদ্ধেয় হয়ে রয়েছে আয়ুর্বেদের জগতে। আধুনিক বিজ্ঞান আর প্রাচীন জ্ঞান যখন হাত মেলায়, তখনই তো সত্যিকারের চিকিৎসা জন্ম নেয়—ত্রিফলা যেন তারই এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

ad
ad

খবরাখবর থেকে আরও পড়ুন

রবীন্দ্রনাথের গানে বরষা

তাঁর বর্ষার গানগুলোতে প্রকৃতি নিজেই যেন একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের আকাশ, মাঠে জমে থাকা জল, ছায়া মাখানো পথঘাট, ঝরঝর বৃষ্টি, পলিফাটা মেঘ—সবই যেন তাঁর গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব কেবল চিত্রায়ন নয়, বরং এগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান মানুষের গভীর অনুভব, ভালোবাসা, নির্জনতা ও চিরপ্রত্

১ দিন আগে

কাঁচা কলার স্বাস্থ্যগত উপকারিতা কী কী?

কাঁচা কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ। এই আঁশ হজমে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষ দিনের পর দিন ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ নিয়মিত কাঁচা কলা খেলে তারা অনেকটা স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, কাঁচা কলা প্রাকৃতিকভাবে হজম শক্তি বাড়ায়।

২ দিন আগে

বাংলা ও দিল্লি সালতানাতের যুদ্ধ: ইতিহাসের এক অস্থির অধ্যায়

দিল্লি সালতানাতের শাসকরা—বিশেষত গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খিলজি, এবং পরবর্তী কালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ও স্বাধিকার দাবি দিল্লির কর্তৃত্বকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনার পেছনে শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না, বরং বাংলা

২ দিন আগে

হার্ট সুস্থ রাখতে কী করবেন?

হার্ট ভালো রাখার মূল মন্ত্র হলো—নিয়মিত রক্তচাপ ও রক্তের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেশার এবং বেশি এলডিএল কোলেস্টেরল ধমনীর ভেতরে প্লাক জমিয়ে রাখে, যার ফলে হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোক হতে পারে। এ ছাড়া ব্লাড সুগার লেভেল বেশি থাকলে বা ডায়াবেটিস হলে হার্টের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

২ দিন আগে