আফরোজা পারভীন
নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার সম্পর্কে আগ্রহ পৃথিবীব্যাপী মানুষের। আগ্রহের প্রধান কারণ, দেশ-বিদেশের সামান্য খবর যারা রাখেন তারা প্রায়ই বিবিধ কারণে টাইমস স্কয়ার নামটি দেখতে পান। তাই সবারই মনে সুপ্ত একটা আকাঙ্খা রয়েছে, নিইউয়র্ক যেতে পারলে টাইমস স্কয়ারে যাবেন, দুচোখ মেলে দেখবেন।
নিউইয়র্ক আগেও একাধিকবার গিয়েছি। টাইসম স্কয়ারও দেখেছি। টাইসম স্কয়ার থেকেই হুডখোলা গাড়িতে চড়ে গোটা নিইউয়র্ক ঘুরেছি। কিন্তু সত্য বলতে কী, সেভাবে টাইমস স্কয়ার দেখা হয়নি। আর এটাই যদি না দেখলাম, দেখলাম কী!
এবার প্রাণভরে দেখলাম, সকালের দুপুরের আর রাতের টাইমস স্কয়ার। সময়ভেদে স্কয়ারের রূপ ভিন্ন, ভিন্ন এর পরিবেশ আর মেজাজ। প্রতিটিই মনোহর। কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি-কম নয়। চারদিনে অন্তত বারোবার যাতায়াত করলাম স্কয়ারটির উপর দিয়ে। আর কোনো আফসোস রইল না!
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, টাইমস স্কয়ার নিউইয়র্ক সিটির বুকে গড়ে ওঠা একটি চত্বর। কিন্তু এই চত্বটিই আধুনিক সভ্যতার মূর্ত প্রতীক। দিনরাত েস্রাতের মতো মানুষ আসছে যােচ্ছে এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। শহরের যে প্রাণ থাকে, প্রাণস্পন্দন থাকে এখানে এলে বোঝা যায়। শহর যে শুধু ইট কাঠ কংক্রিট-সর্বস্ব নয়, শহরেরও যে মন আছে, আত্মা আছে টাইমস স্কয়ার তা বোঝায়। মানুষ এখানে আসে নানান স্বপ্ন নিয়ে।
১৯০৪ সালে নিইউয়র্ক টাইমস পত্রিকা এই জায়গাটি তাদের নতুন ভবনের জন্য নির্বাচন করে। সেই থেকেই এলাকাটি পরিচিতি পায় ‘টাইমস স্কয়ার’ নামে। একসময় এলাকাটির নাম ছিল ‘লংএকার স্কয়ার’। সে নাম বদলে যায় সময়ের পথ পরিক্রমায়। গুরুত্বও বেড়ে যায় জায়গাটির।
এটি এখন বিশ্বের ব্যস্ততম জায়গাগুলোর একটি। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন এখানে একত্রিত হয় কেউ নিছক জায়গাটাকে দেখতে, কেউ শিল্প-সংস্কৃতির টানে, কেউ ব্যবসার প্রয়োজনে, কেউ জীবিকার তাগিদে, কেউ শুধুমাত্র শহরের প্রাণস্পন্দন শুনতে।
টাইমস স্কয়ারকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সড়কের মোড়।’ এই সড়কের দুপাশে রয়েছে বিশাল বিশাল ডিজিটাল বিলবোর্ড ও এলইডি স্ক্রিনে ঘেরা উজ্জ্বল দৃশ্যবলী। এখানে রাত হয় না। ঘুম নামে না রাতের চোখে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞাপন আর শিল্প একত্রে মিশে গড়ে তোলে এক নিখুঁত মায়াময় জগৎ।
জায়গাটার আরেকটা বড় আকর্ষণ ‘বল ড্রপ’। এটি সারা বছরের প্রতীক্ষিত আয়োজন। এটিকে ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ বল ড্রপও বলা হয়। নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে এই অনুষ্ঠান হয়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মানুষ টাইমস স্কয়ারে একত্রিত হয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টিভি ও অনলাইনে চোখ রেখে বসে থাকে। চোখ রাখে একটি অনন্য অনুষ্ঠানের অনন্য মুহূর্ত উপভোগ করতে। তারা যেন শুধু চোখ দিয়ে দেখে না, সময়কে ছুঁয়েও ফেলে।
১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো টাইমস স্কয়ার বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে একটি আলোকোজ্জ্বল বল ধীরে ধীরে নিচে নামানো হয়। শুরু হয় নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার এই অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য। যা আজও একইভাবে চলছে। ব্যতিক্রম ঘটে কেবল ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে নতুন বছর উদযাপন করা হয়েছিল এই দুই বছর।
বর্তমানের বলটি রীতিমতো বিস্ময়। অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তিতে নির্মিত। বলটি ১২ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট, তৈরি হয়েছে ‘ওয়াটার ফোল্ড ক্রিস্টাল আই এলইডি’ আলো দিয়ে। এতে আছে প্রায় ৩২ হাজার রঙিন আলো, এবং এটি প্রায় ১২ হাজার পাউন্ড ওজনের। এটি নান্দনিকতার দিক থেকেও এক অসাধারণ শিল্পকর্ম।
৩১ ডিসেম্বর রাতে ঘড়ির কাঁটা রাত ১১:৫৯:০০-এ পৌঁছালে, টাইমস স্কয়ারের ওপরে স্থাপিত এই বল ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে। ৬০ সেকেন্ডে এটি পৌঁছায় নিচে, সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের পাতায় যুক্ত হয় নতুন একটি দিন, নতুন বছর। মানুষ আনন্দে কাঁপে হাসে, কেঁদেও ফেলে আবেগে। তাদের হৃদয় স্পন্দিত হয় নতুন আশা প্রেরণা আর প্রতিজ্ঞায়। ‘বল ড্রপ’ আমাদের শেখায়, সময় চলে যায়, মানুষ থেকে যায় আশায়, নতুন এক ভোরের অপেক্ষায়। এই এক মিনিট পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে আবাহনের, বরণ করে নেয়ার। এই উৎসবে বাজি, সঙ্গীত, কনফেটি বর্ষণ, হাজারো আলোকরশ্মি থাকে।
এখানে চলে সারাক্ষণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পথের ধারে মিকিমাউস, মিনিমাউস, ব্যাটম্যান, জাদুকর, গায়ক, জীবন্ত ভাস্কর্য, স্পাইডারম্যান এমনকি স্ট্যাচু অব লিবার্টিও পাবেন! তাঁরা নারারকম ভাবভঙ্গি করে, খেলা দেখায়, নাচে। আপনি চাইলে এদের সাথে ছবিও তুলতে পারবেন। এরা আপনাকে আনন্দ দেবে, বিনিময়ে আপনি তাদের একটু প্রশংসা করবেন আর দেবেন সামান্য পারিশ্রমিক। মনে রাখবেন, এটাই এদের জীবিকা। কাজেই বেড়াতে এসে যত্রতত্র অজস্র খরচ করবেন কিন্তু এদের ঠকাবেন, এমনটা করবেন না। এরা শ্রমজীবী। এদের দিতে কার্পণ্য করবেন না।
গোটা পৃথিবীর নাট্যকর্মী আর নাট্যপ্রেমীদের ভালবাসার জায়গা ‘ব্রডওয়ে থিয়েটার জোন’ রয়েছে এখানে। ৪০টিরও বেশি থিয়েটার রয়েছে এলাকাটিতে। তাই এটি সৃজনশীলতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মঞ্চনাটক, মিউজিক্যাল ড্রামা, কমেডি সবই মঞ্চস্থ হয় হলগুলিতে। প্রতিদিন মঞ্চস্থ হয় শেক্সপিয়র। যে যেমনটা পছন্দ করেন দেখতে পাবেন। সবার রুচি অনুযায়ী আয়োজন রয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায়, হলভর্তি দর্শক প্রাণভর শো দেখে। প্রাণে ভরে নেয় আত্মার খোরাক।
বর্তমানে আমরা বাস করি ভার্চুয়াল জগতে। কখনো কখনো বাস্তবতা আর ভার্চূয়ালের দ্বন্দ্বে ভুগি। টাইমস স্কয়ার আমাদের বলে দেয়, বাস্তবতার মধ্যে থেকেও বিজ্ঞাপন, বিনোদন আর মানুষের মিলনে ভার্চুয়ালকে অতিক্রম করা যায়। এই চত্বরে দাঁড়ালে মনে হয়, দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর কেন্দ্রে।
টাইমস স্কয়ার খুব কোলাহলপূর্ণ জায়গা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হেচ্ছ, প্রচণ্ড হইচই কোলাহলের মধ্যেও এখানে একধরণের নিরবতা আছে। একাকীত্ব আছে। এখানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।
টাইমস স্কয়ার আজ শুধুমাত্র পর্যটনের কেন্দ্র নয়, এটি আধুনিক বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির সম্মিলনকেন্দ্র।
টাইমস স্কয়ারের দেয়া বিজ্ঞাপনগুলো বিশ্বে সবচেয়ে ব্যবয়বহুল। তবু এখানেই বিশ্বের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন রয়েছে। কারণ এখানে বিজ্ঞাপন দিলে ব্যবসার প্রসার হয়। বিশালাকার ডিজিটাল বিলবোর্ডে যেসব বিজ্ঞাপন চলে, সেগুলোতে মাসে কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। গুগল, অ্যাপল, কোকাকোলা, ডিজনিসহ গোটা বিশ্বের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডই টাইমস স্কয়ারে তাদের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। জানাচ্ছে তাদের উপস্থিতি। কারণ প্রতিদিন এখানে আসে লাখ লাখ মানুষ। তারা কেনাকাটা করে, ব্যবসা বাণিজ্য করে, বিনোদন চায়। আর বছর শেষে ‘বল ড্রপ’ অনুষ্ঠান তো আছেই। এই একদিনেই হয় কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা।
টাইমস স্কয়ার হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ড ভিশিবিলিটি ও গ্লোবাল মার্কেটিং-এর প্রধানতম হাব। এখানকার নান্দনিক বিজ্ঞাপনগুলো একইসাথে পণ্যের প্রচার ও শৈল্পিক সৌন্দর্য বিতরণ করে। লোকে বারবার তাকিয়ে দেখে বিজ্ঞাপনগুলো। এর সবকিছুর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক লক্ষ্য। সেটাও অর্জিত হয়।
নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটার বা টাইমস স্কয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম শুধুই বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি ব্যবসায়িক সফলতার এক বড় ক্ষেত্র। ব্রডওয়ে শিল্প থেকে বছরে বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব পায় নিউইয়র্ক সিটি। শত শত অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক, টেকনিশিয়ানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক সৃজনশীল অর্থনীতির ধারা।
টাইমস স্কয়ারে প্রতিবছর প্রায় ৬ কোটি পর্যটককের আগমন ঘটে। এসব পর্যটকদের থাকা খাওয়া কেনাকাটা বিনোদনের জন্য এলাকাটিতে রয়েছে প্রচুর হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান, মিউজিয়াম। সবই দুর্মূল্য। তারপরও এগুলোর সবই জমজমাট। পর্যটন মানে শুধু ছবি তোলা নয়, পর্যটনের সাথে জড়িত থাকে অর্থনীতি।
টাইমস স্কয়ার মিউজিক্যাল শো, লাইভ পারফরম্যান্স, স্ট্রিট আর্টিস্ট, থিম ক্যাফে, ব্র্যান্ড স্টোর সবাই ব্যবসা করে। অর্থের লেনদেন হয়। সে অর্থের পরিমাণ বিশাল। এখানে যেমন আছে স্থায়ী চাকরি, ব্যবসা, তেমনই আছে অস্থায়ী নানান রোজগারের সুযোগ। সব মিলে তৈরি হয়েছে আয়ের এক মহাসূত্র। এখানে পর্যটন, সংস্কৃতি ও ব্যবসা একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, টিকিয়ে রাখছে একটি অপরটিকে।
টাইমস স্কয়ার বহুসংস্কৃতি ও বহুজাতির মিলনমেলা। এখানে এসে মানুষ তাদের অধিকারের কথাও বলে। কথা বলে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। এটি এখন বিভিন্ন আন্দোলনের প্রতীকী মঞ্চ। এখানে যেমন কনসার্ট, জনসভা, ফ্ল্যাশ মব কিংবা থিমভিত্তিক শো হয় তেমনি বিভিন্ন দেশিরা তাদের নিজস্ব উৎসবসমূহের আয়োজনও এখানে করে থাকে। যেমন বাংলাদেশিরা এই স্কয়ারে তাদের বর্ষবরণ, বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান করে।
তাই টাইমস স্কয়ার গোটা বিশ্বের প্রাণস্পন্দন বললেও ভুল হবে না। এখানে একই সাথে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা আর সৃজনশীলতার চাষ হয়। এমনটি পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে। একই সাথে অর্থ বিনোদন এবং বহুসংস্কৃতির যুথবদ্ধতায় টাইমস স্কয়ার অনন্য। তাই এটি বার বার দেখার জায়গা, ফিরে ফিরে দেখার জায়গা।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক
নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ার সম্পর্কে আগ্রহ পৃথিবীব্যাপী মানুষের। আগ্রহের প্রধান কারণ, দেশ-বিদেশের সামান্য খবর যারা রাখেন তারা প্রায়ই বিবিধ কারণে টাইমস স্কয়ার নামটি দেখতে পান। তাই সবারই মনে সুপ্ত একটা আকাঙ্খা রয়েছে, নিইউয়র্ক যেতে পারলে টাইমস স্কয়ারে যাবেন, দুচোখ মেলে দেখবেন।
নিউইয়র্ক আগেও একাধিকবার গিয়েছি। টাইসম স্কয়ারও দেখেছি। টাইসম স্কয়ার থেকেই হুডখোলা গাড়িতে চড়ে গোটা নিইউয়র্ক ঘুরেছি। কিন্তু সত্য বলতে কী, সেভাবে টাইমস স্কয়ার দেখা হয়নি। আর এটাই যদি না দেখলাম, দেখলাম কী!
এবার প্রাণভরে দেখলাম, সকালের দুপুরের আর রাতের টাইমস স্কয়ার। সময়ভেদে স্কয়ারের রূপ ভিন্ন, ভিন্ন এর পরিবেশ আর মেজাজ। প্রতিটিই মনোহর। কোনটার চেয়ে কোনটা বেশি-কম নয়। চারদিনে অন্তত বারোবার যাতায়াত করলাম স্কয়ারটির উপর দিয়ে। আর কোনো আফসোস রইল না!
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, টাইমস স্কয়ার নিউইয়র্ক সিটির বুকে গড়ে ওঠা একটি চত্বর। কিন্তু এই চত্বটিই আধুনিক সভ্যতার মূর্ত প্রতীক। দিনরাত েস্রাতের মতো মানুষ আসছে যােচ্ছে এখানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। শহরের যে প্রাণ থাকে, প্রাণস্পন্দন থাকে এখানে এলে বোঝা যায়। শহর যে শুধু ইট কাঠ কংক্রিট-সর্বস্ব নয়, শহরেরও যে মন আছে, আত্মা আছে টাইমস স্কয়ার তা বোঝায়। মানুষ এখানে আসে নানান স্বপ্ন নিয়ে।
১৯০৪ সালে নিইউয়র্ক টাইমস পত্রিকা এই জায়গাটি তাদের নতুন ভবনের জন্য নির্বাচন করে। সেই থেকেই এলাকাটি পরিচিতি পায় ‘টাইমস স্কয়ার’ নামে। একসময় এলাকাটির নাম ছিল ‘লংএকার স্কয়ার’। সে নাম বদলে যায় সময়ের পথ পরিক্রমায়। গুরুত্বও বেড়ে যায় জায়গাটির।
এটি এখন বিশ্বের ব্যস্ততম জায়গাগুলোর একটি। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রতিদিন এখানে একত্রিত হয় কেউ নিছক জায়গাটাকে দেখতে, কেউ শিল্প-সংস্কৃতির টানে, কেউ ব্যবসার প্রয়োজনে, কেউ জীবিকার তাগিদে, কেউ শুধুমাত্র শহরের প্রাণস্পন্দন শুনতে।
টাইমস স্কয়ারকে বলা হয় ‘পৃথিবীর সড়কের মোড়।’ এই সড়কের দুপাশে রয়েছে বিশাল বিশাল ডিজিটাল বিলবোর্ড ও এলইডি স্ক্রিনে ঘেরা উজ্জ্বল দৃশ্যবলী। এখানে রাত হয় না। ঘুম নামে না রাতের চোখে। প্রযুক্তি, বিজ্ঞাপন আর শিল্প একত্রে মিশে গড়ে তোলে এক নিখুঁত মায়াময় জগৎ।
জায়গাটার আরেকটা বড় আকর্ষণ ‘বল ড্রপ’। এটি সারা বছরের প্রতীক্ষিত আয়োজন। এটিকে ‘নিউ ইয়ার্স ইভ’ বল ড্রপও বলা হয়। নতুন বছরের আগমনকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর ৩১ ডিসেম্বর রাতে এই অনুষ্ঠান হয়। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মানুষ টাইমস স্কয়ারে একত্রিত হয়, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টিভি ও অনলাইনে চোখ রেখে বসে থাকে। চোখ রাখে একটি অনন্য অনুষ্ঠানের অনন্য মুহূর্ত উপভোগ করতে। তারা যেন শুধু চোখ দিয়ে দেখে না, সময়কে ছুঁয়েও ফেলে।
১৯০৭ সালে প্রথমবারের মতো টাইমস স্কয়ার বিল্ডিংয়ের ওপর থেকে একটি আলোকোজ্জ্বল বল ধীরে ধীরে নিচে নামানো হয়। শুরু হয় নববর্ষকে বরণ করে নেওয়ার এই অবিচ্ছেদ্য ঐতিহ্য। যা আজও একইভাবে চলছে। ব্যতিক্রম ঘটে কেবল ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে আলো নিভিয়ে নিঃশব্দে নতুন বছর উদযাপন করা হয়েছিল এই দুই বছর।
বর্তমানের বলটি রীতিমতো বিস্ময়। অত্যন্ত জটিল প্রযুক্তিতে নির্মিত। বলটি ১২ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট, তৈরি হয়েছে ‘ওয়াটার ফোল্ড ক্রিস্টাল আই এলইডি’ আলো দিয়ে। এতে আছে প্রায় ৩২ হাজার রঙিন আলো, এবং এটি প্রায় ১২ হাজার পাউন্ড ওজনের। এটি নান্দনিকতার দিক থেকেও এক অসাধারণ শিল্পকর্ম।
৩১ ডিসেম্বর রাতে ঘড়ির কাঁটা রাত ১১:৫৯:০০-এ পৌঁছালে, টাইমস স্কয়ারের ওপরে স্থাপিত এই বল ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে থাকে। ৬০ সেকেন্ডে এটি পৌঁছায় নিচে, সাথে সাথে ক্যালেন্ডারের পাতায় যুক্ত হয় নতুন একটি দিন, নতুন বছর। মানুষ আনন্দে কাঁপে হাসে, কেঁদেও ফেলে আবেগে। তাদের হৃদয় স্পন্দিত হয় নতুন আশা প্রেরণা আর প্রতিজ্ঞায়। ‘বল ড্রপ’ আমাদের শেখায়, সময় চলে যায়, মানুষ থেকে যায় আশায়, নতুন এক ভোরের অপেক্ষায়। এই এক মিনিট পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনকে আবাহনের, বরণ করে নেয়ার। এই উৎসবে বাজি, সঙ্গীত, কনফেটি বর্ষণ, হাজারো আলোকরশ্মি থাকে।
এখানে চলে সারাক্ষণ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। পথের ধারে মিকিমাউস, মিনিমাউস, ব্যাটম্যান, জাদুকর, গায়ক, জীবন্ত ভাস্কর্য, স্পাইডারম্যান এমনকি স্ট্যাচু অব লিবার্টিও পাবেন! তাঁরা নারারকম ভাবভঙ্গি করে, খেলা দেখায়, নাচে। আপনি চাইলে এদের সাথে ছবিও তুলতে পারবেন। এরা আপনাকে আনন্দ দেবে, বিনিময়ে আপনি তাদের একটু প্রশংসা করবেন আর দেবেন সামান্য পারিশ্রমিক। মনে রাখবেন, এটাই এদের জীবিকা। কাজেই বেড়াতে এসে যত্রতত্র অজস্র খরচ করবেন কিন্তু এদের ঠকাবেন, এমনটা করবেন না। এরা শ্রমজীবী। এদের দিতে কার্পণ্য করবেন না।
গোটা পৃথিবীর নাট্যকর্মী আর নাট্যপ্রেমীদের ভালবাসার জায়গা ‘ব্রডওয়ে থিয়েটার জোন’ রয়েছে এখানে। ৪০টিরও বেশি থিয়েটার রয়েছে এলাকাটিতে। তাই এটি সৃজনশীলতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মঞ্চনাটক, মিউজিক্যাল ড্রামা, কমেডি সবই মঞ্চস্থ হয় হলগুলিতে। প্রতিদিন মঞ্চস্থ হয় শেক্সপিয়র। যে যেমনটা পছন্দ করেন দেখতে পাবেন। সবার রুচি অনুযায়ী আয়োজন রয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায়, হলভর্তি দর্শক প্রাণভর শো দেখে। প্রাণে ভরে নেয় আত্মার খোরাক।
বর্তমানে আমরা বাস করি ভার্চুয়াল জগতে। কখনো কখনো বাস্তবতা আর ভার্চূয়ালের দ্বন্দ্বে ভুগি। টাইমস স্কয়ার আমাদের বলে দেয়, বাস্তবতার মধ্যে থেকেও বিজ্ঞাপন, বিনোদন আর মানুষের মিলনে ভার্চুয়ালকে অতিক্রম করা যায়। এই চত্বরে দাঁড়ালে মনে হয়, দাঁড়িয়ে আছি পৃথিবীর কেন্দ্রে।
টাইমস স্কয়ার খুব কোলাহলপূর্ণ জায়গা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হেচ্ছ, প্রচণ্ড হইচই কোলাহলের মধ্যেও এখানে একধরণের নিরবতা আছে। একাকীত্ব আছে। এখানে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়।
টাইমস স্কয়ার আজ শুধুমাত্র পর্যটনের কেন্দ্র নয়, এটি আধুনিক বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শিল্প-সংস্কৃতির সম্মিলনকেন্দ্র।
টাইমস স্কয়ারের দেয়া বিজ্ঞাপনগুলো বিশ্বে সবচেয়ে ব্যবয়বহুল। তবু এখানেই বিশ্বের সব বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন রয়েছে। কারণ এখানে বিজ্ঞাপন দিলে ব্যবসার প্রসার হয়। বিশালাকার ডিজিটাল বিলবোর্ডে যেসব বিজ্ঞাপন চলে, সেগুলোতে মাসে কোটি ডলার পর্যন্ত খরচ হয়। গুগল, অ্যাপল, কোকাকোলা, ডিজনিসহ গোটা বিশ্বের প্রায় সব শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডই টাইমস স্কয়ারে তাদের বিজ্ঞাপন দিয়েছে। জানাচ্ছে তাদের উপস্থিতি। কারণ প্রতিদিন এখানে আসে লাখ লাখ মানুষ। তারা কেনাকাটা করে, ব্যবসা বাণিজ্য করে, বিনোদন চায়। আর বছর শেষে ‘বল ড্রপ’ অনুষ্ঠান তো আছেই। এই একদিনেই হয় কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা।
টাইমস স্কয়ার হয়ে উঠেছে ব্র্যান্ড ভিশিবিলিটি ও গ্লোবাল মার্কেটিং-এর প্রধানতম হাব। এখানকার নান্দনিক বিজ্ঞাপনগুলো একইসাথে পণ্যের প্রচার ও শৈল্পিক সৌন্দর্য বিতরণ করে। লোকে বারবার তাকিয়ে দেখে বিজ্ঞাপনগুলো। এর সবকিছুর মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক লক্ষ্য। সেটাও অর্জিত হয়।
নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটার বা টাইমস স্কয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম শুধুই বিনোদনের মাধ্যম নয়, এটি ব্যবসায়িক সফলতার এক বড় ক্ষেত্র। ব্রডওয়ে শিল্প থেকে বছরে বিলিয়ন ডলারের বেশি রাজস্ব পায় নিউইয়র্ক সিটি। শত শত অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক, টেকনিশিয়ানের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এক সৃজনশীল অর্থনীতির ধারা।
টাইমস স্কয়ারে প্রতিবছর প্রায় ৬ কোটি পর্যটককের আগমন ঘটে। এসব পর্যটকদের থাকা খাওয়া কেনাকাটা বিনোদনের জন্য এলাকাটিতে রয়েছে প্রচুর হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকান, মিউজিয়াম। সবই দুর্মূল্য। তারপরও এগুলোর সবই জমজমাট। পর্যটন মানে শুধু ছবি তোলা নয়, পর্যটনের সাথে জড়িত থাকে অর্থনীতি।
টাইমস স্কয়ার মিউজিক্যাল শো, লাইভ পারফরম্যান্স, স্ট্রিট আর্টিস্ট, থিম ক্যাফে, ব্র্যান্ড স্টোর সবাই ব্যবসা করে। অর্থের লেনদেন হয়। সে অর্থের পরিমাণ বিশাল। এখানে যেমন আছে স্থায়ী চাকরি, ব্যবসা, তেমনই আছে অস্থায়ী নানান রোজগারের সুযোগ। সব মিলে তৈরি হয়েছে আয়ের এক মহাসূত্র। এখানে পর্যটন, সংস্কৃতি ও ব্যবসা একে অপরের সাথে জড়িয়ে আছে, টিকিয়ে রাখছে একটি অপরটিকে।
টাইমস স্কয়ার বহুসংস্কৃতি ও বহুজাতির মিলনমেলা। এখানে এসে মানুষ তাদের অধিকারের কথাও বলে। কথা বলে জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকারসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। এটি এখন বিভিন্ন আন্দোলনের প্রতীকী মঞ্চ। এখানে যেমন কনসার্ট, জনসভা, ফ্ল্যাশ মব কিংবা থিমভিত্তিক শো হয় তেমনি বিভিন্ন দেশিরা তাদের নিজস্ব উৎসবসমূহের আয়োজনও এখানে করে থাকে। যেমন বাংলাদেশিরা এই স্কয়ারে তাদের বর্ষবরণ, বর্ষবিদায় অনুষ্ঠান করে।
তাই টাইমস স্কয়ার গোটা বিশ্বের প্রাণস্পন্দন বললেও ভুল হবে না। এখানে একই সাথে কোটি কোটি ডলারের ব্যবসা আর সৃজনশীলতার চাষ হয়। এমনটি পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই আছে। একই সাথে অর্থ বিনোদন এবং বহুসংস্কৃতির যুথবদ্ধতায় টাইমস স্কয়ার অনন্য। তাই এটি বার বার দেখার জায়গা, ফিরে ফিরে দেখার জায়গা।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক
নাশপাতির মধ্যে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যেগুলো শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে। এই ফলটিতে রয়েছে উচ্চমাত্রার ফাইবার, ভিটামিন সি , পটাশিয়াম , এবং নানা ধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। নাশপাতিতে ফ্যাট বা চর্বি একেবারেই নেই বললেই চলে, আর ক্যালোরিও কম, তাই যাঁরা ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখত
১৯ ঘণ্টা আগেতাঁর বর্ষার গানগুলোতে প্রকৃতি নিজেই যেন একটি জীবন্ত চরিত্র হয়ে ওঠে। শ্রাবণ-ভাদ্র মাসের আকাশ, মাঠে জমে থাকা জল, ছায়া মাখানো পথঘাট, ঝরঝর বৃষ্টি, পলিফাটা মেঘ—সবই যেন তাঁর গানের অনুষঙ্গ। কিন্তু এসব কেবল চিত্রায়ন নয়, বরং এগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পান মানুষের গভীর অনুভব, ভালোবাসা, নির্জনতা ও চিরপ্রত্
২০ ঘণ্টা আগেকাঁচা কলায় রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার বা আঁশ। এই আঁশ হজমে সাহায্য করে এবং পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। অনেক সময় দেখা যায়, কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা মানুষ দিনের পর দিন ওষুধ খাচ্ছেন। অথচ নিয়মিত কাঁচা কলা খেলে তারা অনেকটা স্বস্তি পেতে পারেন। কারণ, কাঁচা কলা প্রাকৃতিকভাবে হজম শক্তি বাড়ায়।
২ দিন আগেদিল্লি সালতানাতের শাসকরা—বিশেষত গিয়াসউদ্দিন বলবন, জালালউদ্দিন খিলজি, এবং পরবর্তী কালে ফিরোজ শাহ তুঘলক—বাংলার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছেন। বাংলা থেকে বিদ্রোহ ও স্বাধিকার দাবি দিল্লির কর্তৃত্বকে একাধিকবার চ্যালেঞ্জ করেছে। এই সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনার পেছনে শুধু ক্ষমতার প্রশ্ন ছিল না, বরং বাংলা
২ দিন আগে