
নাজমুল ইসলাম হৃদয়

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে স্বীকৃত। এতদিন যে যুদ্ধটি ছিল একটি অসম গরিলা যুদ্ধ, এ দিন বিকেলে তা সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সংযুক্তিতে এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রূপও লাভ করে।
মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৩ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার জীবনের সবচেয়ে বড় ও আত্মঘাতী জুয়াটি খেলেন। এতদিন ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলে আসছিল যে তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না, কিন্তু ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান নিজেই ভারতকে যুদ্ধের অজুহাত বা ‘ক্যাসাস বেল্লি’ (Casus Belli) উপহার দেয়।
সমরবিদদের মতে, ৩ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে এতটাই কোণঠাসা করে ফেলেছিল যে পাকিস্তানের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল— হয় আত্মসমর্পণ করা, নইলে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা। পাকিস্তান দ্বিতীয় পথটি বেছে নেয় এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিমানঘাঁটিগুলোতে অতর্কিত বিমান হামলা চালায়। এর কোডনেম ছিল ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’।
৩ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের শুরুটা ছিল নাটকীয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছিল। জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী বারবার রাওয়ালপিন্ডির সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
অবশেষে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর ও যোধপুর বিমানঘাঁটিতে একযোগে ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ এয়ার স্ট্রাইক’ বা আগাম বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মতো ভারতের বিমান বাহিনীকে মাটিতেই ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW) ও মুক্তিবাহিনী আগেই এই পরিকল্পনার আঁচ পেয়েছিল।
এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল ‘মাই ইয়ারস উইথ দ্য আইএএফ’ বইয়ে লিখেছেন, ভারতীয় বিমানগুলো আগেই কংক্রিটের হ্যাঙ্গারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে পাকিস্তানের এ হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
এ খবর যখন কলকাতায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছায়, তিনি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ অনুযায়ী, খবরটি কানে আসামাত্র তিনি ভাষণ সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত দিল্লি ফিরে যান এবং মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন।
রণাঙ্গনের চিত্রে ৩ ডিসেম্বর ছিল মিশ্র অভিজ্ঞতার দিন। তবে এ দিনটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিয়ে আসে প্রথম বিজয়ের সুসংবাদ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করেন। এটি ছিল চট্টগ্রাম জেলার প্রথম মুক্ত ভূখণ্ড।
দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে সন্দ্বীপ শহরের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও পুলিশ বাহিনীর পতন ঘটে। দ্বীপ থেকে পালাবার পথ সংকীর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষমেশ নৌ পথে সীতাকুণ্ডের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্দ্বীপ মুক্ত হওয়ার এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আকাশচুম্বী করে তোলে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে তখনো চলছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। বিশেষ করে ১১ নম্বর সেক্টরের (ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল) কামালপুর ও ৬ নম্বর সেক্টরের (রংপুর-দিনাজপুর) হিলি সীমান্তে এদিন ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কামালপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের পরিকল্পনায় (যিনি ১৪ নভেম্বর কামালপুর অভিযানের সময় আহত হয়ে পা হারিয়েছিলেন) ও উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর ঘাঁটির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস ইন্টারসেপ্ট থেকে জানা যায়, কামালপুর ঘাঁটির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ৩ ডিসেম্বর দুপুরে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠান— ‘উই আর রানিং আউট অব অ্যাম্যুনিশন... (আমাদের গুলি ফুরিয়ে আসছে)।’ এ দিন কামালপুর ঘাঁটির পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
এ দিন রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতিও ছিল অবিস্মরণীয়। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র বিবরণ অনুযায়ী, এ দিন বিকেলের পর থেকেই ঢাকার আকাশে এক ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধ্যার ঠিক পরপরই সাইরেনের গগনবিদারী শব্দে ঢাকাবাসী চমকে ওঠে। এতদিন যে ব্ল্যাকআউট বা নিষ্প্রদীপ মহড়া ছিল সতর্কতামূলক, ৩ ডিসেম্বর রাত থেকে তা বাস্তবে রূপ নেয়।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যাবার জেটগুলো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে ভারতের আগরতলার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের গোলার মুখে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
আর্চার ব্লাড তার ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ বইয়ে ওই সময়ের পরিস্থিতির বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন, ৩ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় ‘দ্য বিগ শো’ বা বড় যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা দূরে কামানের গোলার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি প্রশাসন এদিন রাতে রেডিও পাকিস্তানে ঘোষণা করে, ‘ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে’। কিন্তু ঢাকার সাধারণ মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দিকে কান পেতে ছিল আসল খবরের জন্য।
রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বলেন, ‘যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এ ঘোষণার পরপরই ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড বা ‘মিত্রবাহিনী’ গঠিত হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক।
৩ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডাররা তাদের অধীন গেরিলা ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দেন ‘অল আউট অ্যাটাক’ বা সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য। সারা দেশের বিভিন্ন পকেটে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন রাতে একযোগে পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্থাপনায় চোরাগুপ্তা হামলা বাড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে জেনারেল নিয়াজী তার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকেরকে বলেছিলেন (সিদ্দিক সালিকের বই অনুযায়ী), ‘বাকের, দ্য ওয়ার হ্যাজ জাস্ট বিগেন, বাট আই ফিল লাইক ইটস অলরেডি ওভার। দ্য লোকাল পপুলেশন ইজ আওয়ার বিগেস্ট এনিমি।’ (বাকের, যুদ্ধ মাত্র শুরু হলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয় জনগণই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।)
এ দিনটিতে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। গ্যারি জে ব্যাসের ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বই থেকে জানা যায়, ৩ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, ‘পাকিস্তান হ্যাজ অ্যাটাকড। নাও উই হ্যাভ টু টিল্ট। (পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। এখন আমাদের পক্ষপাত দেখাতে হবে।)
নিক্সন প্রশাসন ৩ ডিসেম্বর থেকেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনার তোড়জোড় শুরু করে, যেন পাকিস্তানের পতন ঠেকানো যায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের আশ্বাস দিয়ে ভারতকে এগিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দেয়।
রোয়েদাদ খানের ‘আমেরিকান পেপারস’ অনুযায়ী, ৩ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহী জাতিসংঘে এক জরুরি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি ভারতকে ‘আগ্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিন্তু বিশ্ব জনমত তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে, কারণ অপারেশন সার্চলাইটের বর্বরতা এবং ১ কোটি শরণার্থীর বোঝা বিশ্ববিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিল।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (খণ্ড ০৯, ১০ ও ১১) – হাসান হাফিজুর রহমান

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর তারিখটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে স্বীকৃত। এতদিন যে যুদ্ধটি ছিল একটি অসম গরিলা যুদ্ধ, এ দিন বিকেলে তা সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়। একই সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সংযুক্তিতে এ যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রূপও লাভ করে।
মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহর ‘বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার’ বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৩ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার জীবনের সবচেয়ে বড় ও আত্মঘাতী জুয়াটি খেলেন। এতদিন ভারত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বলে আসছিল যে তারা সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না, কিন্তু ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান নিজেই ভারতকে যুদ্ধের অজুহাত বা ‘ক্যাসাস বেল্লি’ (Casus Belli) উপহার দেয়।
সমরবিদদের মতে, ৩ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীকে এতটাই কোণঠাসা করে ফেলেছিল যে পাকিস্তানের সামনে দুটি পথ খোলা ছিল— হয় আত্মসমর্পণ করা, নইলে যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দিয়ে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ কামনা করা। পাকিস্তান দ্বিতীয় পথটি বেছে নেয় এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় বিমানঘাঁটিগুলোতে অতর্কিত বিমান হামলা চালায়। এর কোডনেম ছিল ‘অপারেশন চেঙ্গিস খান’।
৩ ডিসেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের শুরুটা ছিল নাটকীয়। মেজর সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এক অদ্ভুত অস্থিরতা বিরাজ করছিল। জেনারেল নিয়াজি ও রাও ফরমান আলী বারবার রাওয়ালপিন্ডির সঙ্গে যোগাযোগ করছিলেন।
অবশেষে বিকেল ৫টা ৪০ মিনিটে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর ও যোধপুর বিমানঘাঁটিতে একযোগে ‘প্রিঅ্যাম্পটিভ এয়ার স্ট্রাইক’ বা আগাম বিমান হামলা চালায়। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মতো ভারতের বিমান বাহিনীকে মাটিতেই ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW) ও মুক্তিবাহিনী আগেই এই পরিকল্পনার আঁচ পেয়েছিল।
এয়ার চিফ মার্শাল পিসি লাল ‘মাই ইয়ারস উইথ দ্য আইএএফ’ বইয়ে লিখেছেন, ভারতীয় বিমানগুলো আগেই কংক্রিটের হ্যাঙ্গারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ফলে পাকিস্তানের এ হামলা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়।
এ খবর যখন কলকাতায় সফররত ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছায়, তিনি ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ’৭১’ অনুযায়ী, খবরটি কানে আসামাত্র তিনি ভাষণ সংক্ষিপ্ত করে দ্রুত দিল্লি ফিরে যান এবং মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন।
রণাঙ্গনের চিত্রে ৩ ডিসেম্বর ছিল মিশ্র অভিজ্ঞতার দিন। তবে এ দিনটি চট্টগ্রামবাসীর জন্য নিয়ে আসে প্রথম বিজয়ের সুসংবাদ। বীর মুক্তিযোদ্ধারা দ্বীপ উপজেলা সন্দ্বীপ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত করেন। এটি ছিল চট্টগ্রাম জেলার প্রথম মুক্ত ভূখণ্ড।
দীর্ঘদিন ধরে সন্দ্বীপের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের কোণঠাসা করে রেখেছিলেন। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে সন্দ্বীপ শহরের প্রধান কেন্দ্রগুলোতে পাকিস্তানি মিলিশিয়া ও পুলিশ বাহিনীর পতন ঘটে। দ্বীপ থেকে পালাবার পথ সংকীর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানিরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং শেষমেশ নৌ পথে সীতাকুণ্ডের দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সন্দ্বীপ মুক্ত হওয়ার এ ঘটনা মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল আকাশচুম্বী করে তোলে।
দেশের উত্তরাঞ্চলে তখনো চলছে রক্তক্ষয়ী লড়াই। বিশেষ করে ১১ নম্বর সেক্টরের (ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল) কামালপুর ও ৬ নম্বর সেক্টরের (রংপুর-দিনাজপুর) হিলি সীমান্তে এদিন ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কামালপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক দুর্ভেদ্য ঘাঁটি। ৩ ডিসেম্বর সকাল থেকেই সেক্টর কমান্ডার মেজর আবু তাহেরের পরিকল্পনায় (যিনি ১৪ নভেম্বর কামালপুর অভিযানের সময় আহত হয়ে পা হারিয়েছিলেন) ও উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুর ঘাঁটির ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়্যারলেস ইন্টারসেপ্ট থেকে জানা যায়, কামালপুর ঘাঁটির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিক ৩ ডিসেম্বর দুপুরে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে বার্তা পাঠান— ‘উই আর রানিং আউট অব অ্যাম্যুনিশন... (আমাদের গুলি ফুরিয়ে আসছে)।’ এ দিন কামালপুর ঘাঁটির পতনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
এ দিন রাজধানী ঢাকার পরিস্থিতিও ছিল অবিস্মরণীয়। জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’র বিবরণ অনুযায়ী, এ দিন বিকেলের পর থেকেই ঢাকার আকাশে এক ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা নেমে আসে। সন্ধ্যার ঠিক পরপরই সাইরেনের গগনবিদারী শব্দে ঢাকাবাসী চমকে ওঠে। এতদিন যে ব্ল্যাকআউট বা নিষ্প্রদীপ মহড়া ছিল সতর্কতামূলক, ৩ ডিসেম্বর রাত থেকে তা বাস্তবে রূপ নেয়।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর স্যাবার জেটগুলো তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে ভারতের আগরতলার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গানের গোলার মুখে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয়।
আর্চার ব্লাড তার ‘দ্য ক্রুয়েল বার্থ অব বাংলাদেশ’ বইয়ে ওই সময়ের পরিস্থিতির বিশ্লেষণে উল্লেখ করেছেন, ৩ ডিসেম্বর রাতে ঢাকায় ‘দ্য বিগ শো’ বা বড় যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের ছাদে দাঁড়িয়ে বিদেশি সাংবাদিকরা দূরে কামানের গোলার ঝলকানি দেখতে পাচ্ছিলেন। পাকিস্তানি প্রশাসন এদিন রাতে রেডিও পাকিস্তানে ঘোষণা করে, ‘ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করেছে’। কিন্তু ঢাকার সাধারণ মানুষ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দিকে কান পেতে ছিল আসল খবরের জন্য।
রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। বলেন, ‘যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ এ ঘোষণার পরপরই ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড বা ‘মিত্রবাহিনী’ গঠিত হয়। তবে মাঠ পর্যায়ে এর প্রভাব ছিল তাৎক্ষণিক।
৩ ডিসেম্বর রাতেই মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডাররা তাদের অধীন গেরিলা ইউনিটগুলোকে নির্দেশ দেন ‘অল আউট অ্যাটাক’ বা সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য। সারা দেশের বিভিন্ন পকেটে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা এ দিন রাতে একযোগে পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্প ও স্থাপনায় চোরাগুপ্তা হামলা বাড়িয়ে দেয়।
পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করে জেনারেল নিয়াজী তার চিফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকেরকে বলেছিলেন (সিদ্দিক সালিকের বই অনুযায়ী), ‘বাকের, দ্য ওয়ার হ্যাজ জাস্ট বিগেন, বাট আই ফিল লাইক ইটস অলরেডি ওভার। দ্য লোকাল পপুলেশন ইজ আওয়ার বিগেস্ট এনিমি।’ (বাকের, যুদ্ধ মাত্র শুরু হলো, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে সব শেষ হয়ে গেছে। স্থানীয় জনগণই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু।)
এ দিনটিতে আন্তর্জাতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপটও ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত। গ্যারি জে ব্যাসের ‘দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম’ বই থেকে জানা যায়, ৩ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বলেন, ‘পাকিস্তান হ্যাজ অ্যাটাকড। নাও উই হ্যাভ টু টিল্ট। (পাকিস্তান আক্রমণ করেছে। এখন আমাদের পক্ষপাত দেখাতে হবে।)
নিক্সন প্রশাসন ৩ ডিসেম্বর থেকেই জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনার তোড়জোড় শুরু করে, যেন পাকিস্তানের পতন ঠেকানো যায়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের আশ্বাস দিয়ে ভারতকে এগিয়ে যাওয়ার সবুজ সংকেত দেয়।
রোয়েদাদ খানের ‘আমেরিকান পেপারস’ অনুযায়ী, ৩ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহী জাতিসংঘে এক জরুরি চিঠি পাঠান, যেখানে তিনি ভারতকে ‘আগ্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। কিন্তু বিশ্ব জনমত তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে, কারণ অপারেশন সার্চলাইটের বর্বরতা এবং ১ কোটি শরণার্থীর বোঝা বিশ্ববিবেকের কাছে পরিষ্কার ছিল।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র (খণ্ড ০৯, ১০ ও ১১) – হাসান হাফিজুর রহমান

ছোট ও বড় পর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। এই অভিনেত্রী ও তার ভাই আলিসান চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন ঢাকার একটি আদালত। পারিবারিক ব্যবসার পার্টনার হিসেবে রাখার বিনিময়ে ২৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ, হুমকি-ধামকি এবং ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে করা মামলায় এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
১৭ দিন আগে
হত্যাচেষ্টা, মারধর ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে সাবেক স্ত্রী রিয়া মনির রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় করা মামালায় জামিন পেয়েছেন আলোচিত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম।
১৮ দিন আগে
বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান। ক্যারিয়ারে কোটি কোটি ভক্তের পাশাপাশি নাম-যশ-খ্যাতি কি নেই তার! বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নায়কও বলা হয় তাকে। এবার এই বলিউড সুপারস্টারের নামে দুবাইয়ে তৈরি হচ্ছে একটি আকাশচুম্বী টাওয়ার। এটি নির্মাণ করছে দুবাইয়ের রিয়েল এস্টেট সংস্থা ‘দানিউব’।
১৮ দিন আগে
গ্রেপ্তার হয়েছেন কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও অভিনেতা আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম। শনিবার (১৫ নভেম্বর) দুপুরে স্ত্রী রিয়া মনির দায়ের করা মামলায় হাতিরঝিল থানার পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
১৮ দিন আগে