
নাজমুল ইসলাম হৃদয়

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ও মহিমান্বিত মুহূর্ত, যেদিন ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর ৯ মাসের এক নদী রক্তের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হেসে উঠেছিল বিজয়ের আনন্দে।
ভোরের সূর্য যখন ঢাকার আকাশে উঁকি দিচ্ছিল। তখনো শহরের অলিগলিতে বারুদের গন্ধ। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। মানুষের চোখেমুখে এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণের ঘোর। আগের দিনগুলোতে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ‘অজেয়’ হওয়ার দম্ভ দেখিয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে সেই বাহিনীই রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাথা নিচু করে, কোমরের বেল্ট খুলে এবং কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে তাদের পরাজয় মেনে নেয়।
ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় মাপের আত্মসমর্পণ বা ‘পাবলিক সারেন্ডার’ আর দেখেনি বিশ্ব। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে যখন জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তার রিভলবারটি মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার হাতে তুলে দেন, তখন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লাখো জনতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কেবল ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়নি, বরং সেই ধ্বনি পৌঁছে গিয়েছিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত।
১৬ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন, যেদিন প্রমাণিত হয়েছিল— একটি নিরস্ত্র জাতি যখন স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, তখন পৃথিবীর কোনো পরাশক্তি বা আধুনিক সমরাস্ত্র তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। মার্কিন সপ্তম নৌ বহর বঙ্গোপসাগরের নীল জলেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সব কূটচাল ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল বাঙালির বিজয়ের তীব্রতার কাছে।
এ দিনের সকাল শুরু হয় এক চরম নাটকীয়তা ও স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। ঢাকার আকাশ তখন পুরোপুরি মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। জেনারেল নাগরা তখন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির কাছে চিরকুট পাঠান— ‘প্রিয় আব্দুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। তোমার সব খেলা শেষ। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, এখনই আত্মসমর্পণ করো এবং আমার দায়িত্ব নাও।’
এ বার্তা পাওয়ার পর জেনারেল নিয়াজির আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি মানসিকভাবে আগেই ভেঙে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে তখন এক কবরের নিস্তব্ধতা। যে জেনারেলরা কদিন আগেও দম্ভভরে বলতেন যে তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়বেন, আজ তারা প্রাণভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন।
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেননি সত্য, কিন্তু তার চোখ ছিল মৃত মানুষের মতো ভাবলেশহীন। তিনি জানতেন, পশ্চিম পাকিস্তান তাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়েছে এবং এখন ভারতীয় বাহিনীই তার একমাত্র রক্ষাকবচ।
সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষ নামতে শুরু করে। তাদের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, অনেকের হাতে ছিল ফুল। তারা মিত্রবাহিনীর কনভয়গুলোকে স্বাগত জানাচ্ছিল। রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাও দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের হাতে আর উদ্যত রাইফেল ছিল না, ছিল পরাজয়ের গ্লানি।
দুপুরের দিকে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি শুরু হয়। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছান। জেনারেল জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ের ভাষ্যমতে, তিনি যখন নিয়াজির অফিসে ঢোকেন, তখন সেখানে পিনপতন নীরবতা। জ্যাকব নিয়াজির সামনে আত্মসমর্পণের খসড়া দলিলটি রাখেন।
নিয়াজি দলিলটি পড়ে দেখেন। তিনি চেয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি যেন গোপনে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হয়। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব ছিলেন অনড়। তিনি নিয়াজির চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘জেনারেল, আত্মসমর্পণ হবে প্রকাশ্যে, রেসকোর্স ময়দানে। আর যদি আপনি এতে রাজি না হন, তবে আমি আপনার এবং আপনার পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারব না। কারণ, বাইরে মুক্তিপাগল জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করছে। তারা আপনাদের ছিঁড়ে ফেলবে।’
জ্যাকবের এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ বা ‘ব্ল্যাকমেইল’ কাজ করে। নিয়াজি বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণে রাজি হন। ঠিক করা হয়, বিকেল ৪টায় এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটবে, রেসকোর্স ময়দানে।
বিকেল গড়াতেই ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরী। হাজার হাজার মানুষ রেসকোর্স ময়দানের দিকে ছুটছে। তাদের অনেকের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, কিন্তু চোখেমুখে বিজয়ের দীপ্তি। বিকেল ৪টার দিকে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, তার স্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (উপ-সেনাপ্রধান) হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
জেনারেল অরোরাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন পরাজিত জেনারেল নিয়াজি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিয়াজিকে তখন অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। বিমানবন্দরে ভিড় করা জনতা নিয়াজির দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল এবং অনেকে গালিগালাজ করছিল। ভারতীয় সৈন্যরা মানবপ্রাচীর তৈরি করে নিয়াজিকে রক্ষা করে।
এরপর তারা জিপে করে রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা হন। রাস্তার দুপাশে তখন লাখো মানুষের ঢল। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে তখন কান পাতা দায়। রেসকোর্স ময়দানে একটি সাধারণ কাঠের টেবিল ও দুটি চেয়ার পাতা হয়েছিল। এই অনাড়ম্বর মঞ্চেই রচিত হতে যাচ্ছিল ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, কিন্তু বাংলার আকাশে উদিত হচ্ছে নতুন সূর্য। রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল অরোরা সেই টেবিলের সামনে বসেন। দলিলের ওপর প্রথমে সই করেন জেনারেল নিয়াজি, এরপর জেনারেল অরোরা। সইয়ের পর নিয়াজি তার কোমরের বেল্ট খোলেন এবং নিজের রিভলবারটি জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন। এটি ছিল সামরিক রীতি অনুযায়ী চূড়ান্ত পরাজয় মেনে নেওয়া। এরপর তিনি তার কাঁধের র্যাংক ব্যাজ খুলে ফেলেন।
এ দৃশ্য দেখে রেসকোর্সের জনসমুদ্র উল্লাসে ফেটে পড়ে। অনেকে ব্যারিকেড ভেঙে মঞ্চের দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা চাইছিল এই জল্লাদ নিয়াজিকে হাতের কাছে পেতে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিয়াজিকে বেষ্টন করে রাখে এবং তাকে দ্রুত জিপে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
দলিলে সইয়ের মধ্য দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম আত্মসমর্পণ। এ দলিলে সইয়ের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী সিলেটে অবস্থান করায় এবং প্রটোকলজনিত জটিলতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননিনি, যা নিয়ে পরে কিছু বিতর্ক হলেও মূল সত্য হলো— এই বিজয় ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ফসল।
আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতির কথা লিখতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
তিনি লিখেছেন, ‘আজ ১৬ ডিসেম্বর। আমার রুমির স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। কিন্তু রুমি নেই। সারা ঢাকা আজ রাস্তায়। অচেনা মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। রিকশাওয়ালারা আজ ভাড়া নিচ্ছে না। মিষ্টির দোকানগুলো সব খালি হয়ে গেছে, মানুষ যে যা পারছে বিলিয়ে দিচ্ছে।’
ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে তখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তখন বাজছে— বিজয় নিশান উড়ছে ওই। এতদিন যারা বাংকারে বা মাটির গর্তে লুকিয়ে ছিল, তারা আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সৈন্য, যারা এতদিন দোর্দণ্ড প্রতাপে মানুষ খুন করেছে, আজ তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। ঢাকার রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রাকগুলো যখন যাচ্ছিল, তখন মানুষ তাদের ওপর ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছিল। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি তখন বাঙালির কাছে বীরত্বের সমার্থক।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ১৬ ডিসেম্বর ছিল এক চূড়ান্ত ফয়সালার দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে, তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠিয়েও পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব নয়। বঙ্গোপসাগরে ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ যখন নিশ্চল দাঁড়িয়ে, তখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নামিয়ে ফেলেছে। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে।
বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, একটি দরিদ্র ও নিরস্ত্র জাতি কীভাবে কেবল মনোবল আর দেশপ্রেমের জোরে একটি সুশৃঙ্খল ও আধুনিক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত তাদের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের এই বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল, কিন্তু মূল যুদ্ধটি করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা, যারা ৯ মাস ধরে খেয়ে না খেয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ছিল তাদেরই দিন।
তবে বিজয়ের এই আনন্দের মাঝেও ছিল স্বজন হারানোর গভীর বেদনা। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলেই মানুষ জানতে শুরু করে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমির কথা। বিজয়ের ঠিক দুই দিন আগে আল-বদররা যে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার ক্ষত তখনো দগদগে। অনেক পরিবার যখন রাস্তায় বিজয়োল্লাস করছে, তখন অন্য অনেক পরিবার বধ্যভূমিতে গিয়ে তাদের প্রিয়জনের বিকৃত লাশ খুঁজছে।
এই আনন্দ ও বেদনার মিশ্রণই ১৬ ডিসেম্বরকে অনন্য করে তুলেছে। ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা ছিল অত্যন্ত চড়া মূল্যের। রেসকোর্স ময়দানে যখন নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন হয়তো কোনো এক শহিদ জননী তার সন্তানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলেন। এই অশ্রু আর রক্তই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কেবল একটি যুদ্ধের সমাপ্তি ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির পুনর্জন্ম। ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছিল মাত্র কয়েক মিনিটের একটি সইয়ের মাধ্যমে। পাকিস্তানি বাহিনী চেয়েছিল ধর্ম আর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে, কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল, বাঙালির ধমনিতে আছে বিদ্রোহের রক্ত।
রেসকোর্সের সেই কাঠের টেবিলটি আজ হয়তো নেই, কিন্তু সেই টেবিলে বসে যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তা হাজার বছর ধরে বাঙালির হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ১৬ ডিসেম্বরে তার পূর্ণতা পেয়েছিল। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায় যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ন্যায়ের কাছে তাকে মাথা নত করতেই হয়।
১৬ ডিসেম্বরের সূর্যাস্ত যখন নামছিল, তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামক ভূখণ্ডটি চিরতরে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং বিশ্বমানচিত্রে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল ‘বাংলাদেশ’। নিয়াজির কাঁপা হাত আর অবনত মস্তক ছিল সেই সত্যের স্বীকৃতি—‘বাঙালিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’।
তথ্যসূত্র

একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ও মহিমান্বিত মুহূর্ত, যেদিন ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর ৯ মাসের এক নদী রক্তের বিনিময়ে বিশ্বমানচিত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হেসে উঠেছিল বিজয়ের আনন্দে।
ভোরের সূর্য যখন ঢাকার আকাশে উঁকি দিচ্ছিল। তখনো শহরের অলিগলিতে বারুদের গন্ধ। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। মানুষের চোখেমুখে এক অবিশ্বাস্য স্বপ্নপূরণের ঘোর। আগের দিনগুলোতে যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ‘অজেয়’ হওয়ার দম্ভ দেখিয়েছিল, ১৬ ডিসেম্বরের পড়ন্ত বিকেলে সেই বাহিনীই রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাথা নিচু করে, কোমরের বেল্ট খুলে এবং কাঁপা হাতে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে তাদের পরাজয় মেনে নেয়।
ইতিহাস সাক্ষী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এত বড় মাপের আত্মসমর্পণ বা ‘পাবলিক সারেন্ডার’ আর দেখেনি বিশ্ব। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে যখন জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি তার রিভলবারটি মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার হাতে তুলে দেন, তখন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লাখো জনতার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে কেবল ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়নি, বরং সেই ধ্বনি পৌঁছে গিয়েছিল রাওয়ালপিন্ডি থেকে ওয়াশিংটন পর্যন্ত।
১৬ ডিসেম্বর ছিল সেই দিন, যেদিন প্রমাণিত হয়েছিল— একটি নিরস্ত্র জাতি যখন স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়, তখন পৃথিবীর কোনো পরাশক্তি বা আধুনিক সমরাস্ত্র তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। মার্কিন সপ্তম নৌ বহর বঙ্গোপসাগরের নীল জলেই থমকে দাঁড়িয়েছিল। আর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সব কূটচাল ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল বাঙালির বিজয়ের তীব্রতার কাছে।
এ দিনের সকাল শুরু হয় এক চরম নাটকীয়তা ও স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। ঢাকার আকাশ তখন পুরোপুরি মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটের দিকে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা ও কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। জেনারেল নাগরা তখন পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজির কাছে চিরকুট পাঠান— ‘প্রিয় আব্দুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। তোমার সব খেলা শেষ। আমি তোমাকে পরামর্শ দিচ্ছি, এখনই আত্মসমর্পণ করো এবং আমার দায়িত্ব নাও।’
এ বার্তা পাওয়ার পর জেনারেল নিয়াজির আর কোনো উপায় ছিল না। তিনি মানসিকভাবে আগেই ভেঙে পড়েছিলেন। পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে তখন এক কবরের নিস্তব্ধতা। যে জেনারেলরা কদিন আগেও দম্ভভরে বলতেন যে তারা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়বেন, আজ তারা প্রাণভয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন।
ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ে লিখেছেন, নিয়াজি যখন আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেননি সত্য, কিন্তু তার চোখ ছিল মৃত মানুষের মতো ভাবলেশহীন। তিনি জানতেন, পশ্চিম পাকিস্তান তাকে ‘বলির পাঁঠা’ বানিয়েছে এবং এখন ভারতীয় বাহিনীই তার একমাত্র রক্ষাকবচ।
সকাল থেকেই ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষ নামতে শুরু করে। তাদের হাতে ছিল বাংলাদেশের পতাকা, অনেকের হাতে ছিল ফুল। তারা মিত্রবাহিনীর কনভয়গুলোকে স্বাগত জানাচ্ছিল। রাস্তায় রাস্তায় পাকিস্তানি সেনাও দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের হাতে আর উদ্যত রাইফেল ছিল না, ছিল পরাজয়ের গ্লানি।
দুপুরের দিকে আত্মসমর্পণের চূড়ান্ত নাটক মঞ্চস্থ করার প্রস্তুতি শুরু হয়। ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছান। জেনারেল জ্যাকবের ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা’ বইয়ের ভাষ্যমতে, তিনি যখন নিয়াজির অফিসে ঢোকেন, তখন সেখানে পিনপতন নীরবতা। জ্যাকব নিয়াজির সামনে আত্মসমর্পণের খসড়া দলিলটি রাখেন।
নিয়াজি দলিলটি পড়ে দেখেন। তিনি চেয়েছিলেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানটি যেন গোপনে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে হয়। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব ছিলেন অনড়। তিনি নিয়াজির চোখে চোখ রেখে বলেন, ‘জেনারেল, আত্মসমর্পণ হবে প্রকাশ্যে, রেসকোর্স ময়দানে। আর যদি আপনি এতে রাজি না হন, তবে আমি আপনার এবং আপনার পরিবারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারব না। কারণ, বাইরে মুক্তিপাগল জনতা এবং মুক্তিযোদ্ধারা অপেক্ষা করছে। তারা আপনাদের ছিঁড়ে ফেলবে।’
জ্যাকবের এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ বা ‘ব্ল্যাকমেইল’ কাজ করে। নিয়াজি বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণে রাজি হন। ঠিক করা হয়, বিকেল ৪টায় এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটবে, রেসকোর্স ময়দানে।
বিকেল গড়াতেই ঢাকা পরিণত হয় উৎসবের নগরী। হাজার হাজার মানুষ রেসকোর্স ময়দানের দিকে ছুটছে। তাদের অনেকের গায়ে জামা নেই, পায়ে জুতো নেই, কিন্তু চোখেমুখে বিজয়ের দীপ্তি। বিকেল ৪টার দিকে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেফট্যানেন্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, তার স্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (উপ-সেনাপ্রধান) হেলিকপ্টারে করে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
জেনারেল অরোরাকে স্বাগত জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন পরাজিত জেনারেল নিয়াজি। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, নিয়াজিকে তখন অত্যন্ত বিমর্ষ ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছিল। বিমানবন্দরে ভিড় করা জনতা নিয়াজির দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল এবং অনেকে গালিগালাজ করছিল। ভারতীয় সৈন্যরা মানবপ্রাচীর তৈরি করে নিয়াজিকে রক্ষা করে।
এরপর তারা জিপে করে রেসকোর্স ময়দানের দিকে রওনা হন। রাস্তার দুপাশে তখন লাখো মানুষের ঢল। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে তখন কান পাতা দায়। রেসকোর্স ময়দানে একটি সাধারণ কাঠের টেবিল ও দুটি চেয়ার পাতা হয়েছিল। এই অনাড়ম্বর মঞ্চেই রচিত হতে যাচ্ছিল ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
বিকেল ৪টা ৩১ মিনিট। সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ছে, কিন্তু বাংলার আকাশে উদিত হচ্ছে নতুন সূর্য। রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে জেনারেল নিয়াজি ও জেনারেল অরোরা সেই টেবিলের সামনে বসেন। দলিলের ওপর প্রথমে সই করেন জেনারেল নিয়াজি, এরপর জেনারেল অরোরা। সইয়ের পর নিয়াজি তার কোমরের বেল্ট খোলেন এবং নিজের রিভলবারটি জেনারেল অরোরার হাতে তুলে দেন। এটি ছিল সামরিক রীতি অনুযায়ী চূড়ান্ত পরাজয় মেনে নেওয়া। এরপর তিনি তার কাঁধের র্যাংক ব্যাজ খুলে ফেলেন।
এ দৃশ্য দেখে রেসকোর্সের জনসমুদ্র উল্লাসে ফেটে পড়ে। অনেকে ব্যারিকেড ভেঙে মঞ্চের দিকে ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা চাইছিল এই জল্লাদ নিয়াজিকে হাতের কাছে পেতে। কিন্তু মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিয়াজিকে বেষ্টন করে রাখে এবং তাকে দ্রুত জিপে তুলে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
দলিলে সইয়ের মধ্য দিয়ে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৃহত্তম আত্মসমর্পণ। এ দলিলে সইয়ের সময় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার উপস্থিত ছিলেন। তবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী সিলেটে অবস্থান করায় এবং প্রটোকলজনিত জটিলতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননিনি, যা নিয়ে পরে কিছু বিতর্ক হলেও মূল সত্য হলো— এই বিজয় ছিল সমগ্র বাঙালি জাতির এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের ফসল।
আত্মসমর্পণের খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শহিদ জননী জাহানারা ইমাম তার ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে ১৬ ডিসেম্বরের অনুভূতির কথা লিখতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
তিনি লিখেছেন, ‘আজ ১৬ ডিসেম্বর। আমার রুমির স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। কিন্তু রুমি নেই। সারা ঢাকা আজ রাস্তায়। অচেনা মানুষ একে অপরকে জড়িয়ে ধরছে। কেউ হাসছে, কেউ কাঁদছে। রিকশাওয়ালারা আজ ভাড়া নিচ্ছে না। মিষ্টির দোকানগুলো সব খালি হয়ে গেছে, মানুষ যে যা পারছে বিলিয়ে দিচ্ছে।’
ঢাকার প্রতিটি বাড়ির ছাদে তখন বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তখন বাজছে— বিজয় নিশান উড়ছে ওই। এতদিন যারা বাংকারে বা মাটির গর্তে লুকিয়ে ছিল, তারা আজ মুক্ত বিহঙ্গের মতো রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানি সৈন্য, যারা এতদিন দোর্দণ্ড প্রতাপে মানুষ খুন করেছে, আজ তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে আশ্রয় নিয়েছে। ঢাকার রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রাকগুলো যখন যাচ্ছিল, তখন মানুষ তাদের ওপর ফুল ছিটিয়ে দিচ্ছিল। ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি তখন বাঙালির কাছে বীরত্বের সমার্থক।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ১৬ ডিসেম্বর ছিল এক চূড়ান্ত ফয়সালার দিন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারে, তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠিয়েও পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব নয়। বঙ্গোপসাগরে ‘ইউএসএস এন্টারপ্রাইজ’ যখন নিশ্চল দাঁড়িয়ে, তখন ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্র নামিয়ে ফেলেছে। জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবগুলো তখন অর্থহীন হয়ে পড়ে।
বিশ্ববাসী অবাক হয়ে দেখল, একটি দরিদ্র ও নিরস্ত্র জাতি কীভাবে কেবল মনোবল আর দেশপ্রেমের জোরে একটি সুশৃঙ্খল ও আধুনিক সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত তাদের কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে বাংলাদেশের এই বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছিল, কিন্তু মূল যুদ্ধটি করেছিল বাংলার দামাল ছেলেরা, যারা ৯ মাস ধরে খেয়ে না খেয়ে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়েছে। ১৬ ডিসেম্বর ছিল তাদেরই দিন।
তবে বিজয়ের এই আনন্দের মাঝেও ছিল স্বজন হারানোর গভীর বেদনা। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলেই মানুষ জানতে শুরু করে রায়েরবাজার ও মিরপুরের বধ্যভূমির কথা। বিজয়ের ঠিক দুই দিন আগে আল-বদররা যে বুদ্ধিজীবী হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার ক্ষত তখনো দগদগে। অনেক পরিবার যখন রাস্তায় বিজয়োল্লাস করছে, তখন অন্য অনেক পরিবার বধ্যভূমিতে গিয়ে তাদের প্রিয়জনের বিকৃত লাশ খুঁজছে।
এই আনন্দ ও বেদনার মিশ্রণই ১৬ ডিসেম্বরকে অনন্য করে তুলেছে। ৩০ লাখ শহিদের রক্ত ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা ছিল অত্যন্ত চড়া মূল্যের। রেসকোর্স ময়দানে যখন নিয়াজি আত্মসমর্পণ করছিলেন, তখন হয়তো কোনো এক শহিদ জননী তার সন্তানের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফেলছিলেন। এই অশ্রু আর রক্তই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত্তি।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ কেবল একটি যুদ্ধের সমাপ্তি ছিল না, এটি ছিল একটি জাতির পুনর্জন্ম। ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনা আর অপমানের ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটেছিল মাত্র কয়েক মিনিটের একটি সইয়ের মাধ্যমে। পাকিস্তানি বাহিনী চেয়েছিল ধর্ম আর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে, কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল, বাঙালির ধমনিতে আছে বিদ্রোহের রক্ত।
রেসকোর্সের সেই কাঠের টেবিলটি আজ হয়তো নেই, কিন্তু সেই টেবিলে বসে যে ইতিহাস রচিত হয়েছিল, তা হাজার বছর ধরে বাঙালির হৃদয়ে অমলিন হয়ে থাকবে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি ১৬ ডিসেম্বরে তার পূর্ণতা পেয়েছিল। এই দিনটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্যায় যত শক্তিশালীই হোক না কেন, ন্যায়ের কাছে তাকে মাথা নত করতেই হয়।
১৬ ডিসেম্বরের সূর্যাস্ত যখন নামছিল, তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামক ভূখণ্ডটি চিরতরে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং বিশ্বমানচিত্রে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল ‘বাংলাদেশ’। নিয়াজির কাঁপা হাত আর অবনত মস্তক ছিল সেই সত্যের স্বীকৃতি—‘বাঙালিকে আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’।
তথ্যসূত্র

পরাশক্তিদের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও প্রবাসী সরকার ছিল অটল। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১২ ডিসেম্বর এক বেতার ভাষণে বলেন, ‘সপ্তম নৌ বহর আমাদের স্বাধীনতা আটকাতে পারবে না। প্রয়োজনে আমরা ১০০ বছর যুদ্ধ করব, তবু বিদেশিদের কাছে মাথা নত করব না।’
৪ দিন আগে
কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা প্যারাট্রুপারদের পথ দেখিয়ে পুংলি ব্রিজের দিকে নিয়ে যায় এবং ব্রিজটি দখল করে নেয়। এর ফলে ময়মনসিংহ ও জামালপুর থেকে পিছু হটা পাকিস্তানি ৯৩ ব্রিগেডের সৈন্যরা ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে আটকা পড়ে।
৫ দিন আগে
ঢাকার চারপাশের বৃত্ত বা ‘লুপ’ ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে পুরোপুরি সম্পন্ন হয়ে যায়। উত্তরে ময়মনসিংহ মুক্ত হওয়ার পর মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে ছুটছে, পূর্বে মেঘনা পাড় হয়ে নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে বিশাল বহর, আর পশ্চিমে পদ্মার পাড়ে চলছে তুমুল প্রস্তুতি।
৬ দিন আগে
পাকিস্তানি জেনারেলরা তাদের তথাকথিত ‘ফোর্ট্রেস ডিফেন্স’ বা দুর্গ রক্ষা কৌশলের ওপর যে অন্ধ বিশ্বাস রেখেছিল, তা তখন অন্ধের মতোই তাদের হোঁচট খাওয়াচ্ছিল। একদিকে বিশ্বরাজনীতির দাবার বোর্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সপ্তম নৌ বহর পাঠানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের উত্তাপ ছড়াচ্ছিল, অন্যদিকে বাংলার
৭ দিন আগে