জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ এবং নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ

মো. ইলিয়াস বিন কাশেম
আপডেট : ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২২: ১৫
মো. ইলিয়াস বিন কাশেম

গণঅভ্যুত্থান থেকে নতুন স্বপ্নের পথে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সূচনা করে। স্বৈরশাসন, নির্বাচনী কারচুপি, দুর্নীতি ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে জনসাধারণের ক্ষোভ যখন চরমে পৌঁছায়, তখন ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে একটি গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। এই আন্দোলন শুধু একটি সরকার পতনের মাধ্যমেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজ বপন করেছে—একটি গণতান্ত্রিক, ন্যায়ভিত্তিক ও নাগরিক অধিকারসম্পন্ন রাষ্ট্রের প্রত্যাশায়।

এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ফসল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি, এনসিপি)। জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে মানিক মিয়া এভিনিউতে বিশাল গণজমায়েতের মাধ্যমে এই নতুন রাজনৈতিক শক্তির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছে। এটি কেবল একটি নতুন রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে দুর্নীতি ও দমনমূলক শাসনের অবসান ঘটিয়ে জনগণকে ক্ষমতার আসনে বসানোর অঙ্গীকার করা হয়েছে।

জনগণের দল: তৃণমূলের শক্তিতে উজ্জীবিত এক নতুন আন্দোলন

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই গণমানুষের ব্যাপক সমর্থন লাভ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র-যুবক, কৃষক, শ্রমিক, পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা একত্রিত হয়ে এই দলে যোগ দিচ্ছেন। দলটির প্রতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন প্রমাণ করে যে বাংলার জনগণ ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীনদের দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায় এবং একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত।

গত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ একদলীয় শাসন, স্বৈরতন্ত্র, এবং গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের শিকার হয়েছে। বিশেষ করে ২০২৪ সালের আন্দোলনের আগে সরকার নির্বাচন কারচুপি, বিচার বিভাগের দুর্বলতা, এবং সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে একদম নিঃশেষ করে ফেলেছিল। কিন্তু জনগণের আন্দোলন এই মিথ্যার জাল ছিন্ন করেছে।

এনসিপি: ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে এক সাহসী প্রতিবাদ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক দীর্ঘকাল ধরে স্বৈরতন্ত্র, দলীয় দুর্নীতি ও পারিবারিক রাজনীতির দৌরাত্ম্য চলে আসছিল। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যবহার করা এবং বিরোধীদের দমন করা—এসবই ছিল পুরনো রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ।

কিন্তু ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এই চক্র ভেঙে দিয়েছে। জনগণ যখন রাস্তায় নেমে আসে, তখন স্বৈরাচারী সরকারের ভয়ংকর দমনপীড়নও এই জাগরণকে থামাতে পারেনি। তারই ধারাবাহিকতায়, এনসিপি গঠিত হয়েছে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য।

এনসিপি বিশ্বাস করে—বাংলাদেশের জনগণ আর কখনও কোনো স্বৈরশাসক বা একদলীয় ক্ষমতার দাসত্ব করবে না। এই দল গণতন্ত্র, সুবিচার এবং জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করবে।

এনসিপি-এর লক্ষ্য ও কর্মপরিকল্পনা

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তিনটি মূলনীতি নিয়ে কাজ করবে—

১. গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা

২. সুশাসন ও স্বচ্ছতা

৩. মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি

দলটির প্রধান কর্মপরিকল্পনা:

১. গণতন্ত্র ও সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা

স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করে মতপ্রকাশের অধিকার ফিরিয়ে আনা।

রাজনৈতিক দমন-পীড়ন বন্ধ করা এবং নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ করা।

২. অর্থনৈতিক সংস্কার ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি

শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিকায়ন করে প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা।

নতুন শিল্প ও স্টার্টআপ খাতে বিনিয়োগ করে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সবার জন্য ন্যায্য সুযোগ সৃষ্টি করা।

৩. বিচার বিভাগ ও মানবাধিকার সংরক্ষণ

স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, যাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ না থাকে।

বিরোধী মত দমন বন্ধ করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।

রাষ্ট্রীয় নির্যাতন ও দুর্নীতির বিচার করা।

পুরনো বনাম নতুন: এনসিপি বনাম পুরনো রাজনৈতিক শক্তি

জাতীয় নাগরিক পার্টির উত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে দিচ্ছে। এখন পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলগুলোর মূল শক্তি ছিল দুর্নীতির উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রশাসন, পুলিশ ও আমলাতন্ত্রের দাসত্ব। তারা জনগণকে প্রতারণা করে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।

কিন্তু এনসিপি এসেছে এই প্রতারণার রাজনীতি ভেঙে দিতে। এনসিপি-এর উত্থান রাজনৈতিক প্রবীণদের সামনে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। কারণ এই দল কারো স্বার্থ রক্ষা করতে নয়, বরং দেশের প্রকৃত মালিক—জনগণের জন্য কাজ করতে চায়।

এনসিপি-এর সামনে সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

সম্ভাবনা

✅ যুবসমাজ ও শিক্ষিত জনগণের ব্যাপক সমর্থন।

✅ দেশব্যাপী সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

✅ জনগণের কাছে জবাবদিহির এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সুযোগ।

✅ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে গণতন্ত্রপন্থী সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা।

চ্যালেঞ্জ

⚠ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক বাধা: ক্ষমতাসীনরা প্রশাসন ব্যবহার করে JNP-এর পথ রুদ্ধ করতে চাইবে।

⚠ গণমাধ্যম দমন: স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলতে পারে।

⚠ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র: পুরনো দলগুলো এই নতুন শক্তিকে দমন করতে নানা ষড়যন্ত্র করবে।

⚠ দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা: একটি নতুন দলে ঐক্য ধরে রাখা ও আদর্শ বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের নতুন ভোরের যাত্রা

জাতীয় নাগরিক পার্টির জন্ম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি কেবল একটি দল নয়, এটি জনগণের আন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি।

স্বৈরতন্ত্রের দিন শেষ। জনগণই এখন দেশের মালিক, তাদের ইচ্ছাই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

জাতীয় নাগরিক পার্টি এখন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের প্রধান শক্তি। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রাম এক নতুন ভোরের পথ দেখাচ্ছে—একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, স্বচ্ছ, ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে।

এখন প্রশ্ন পরিবর্তন আসবে কি না, তা নয়—বরং, কত দ্রুত আসবে?

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টাকে পাঠানো ছয় মানবাধিকার সংগঠনের চিঠিতে যা আছে

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় সাইডলাইনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে সাক্ষাতের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি পাঠানো হয়, যার মধ‍্যে সরকারের জন্য অস্বস্তিকর কিছু বিষয় রয়েছে।

১৯ দিন আগে

‘জুলাই সনদ প্রশ্নবিদ্ধ’

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এমন শব্দচয়নের বিরোধিতা করে তাঁর এই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। পাশাপাশি প্রশ্নবিদ্ধ জুলাই জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে খুব শিগগিরই একটি আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা প্রকাশের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।

২১ দিন আগে

শান্তিতে নোবেল নিয়ে এত বিতর্ক কেন?

অনেকে বলছেন, এবারও পুরস্কারটি যেন পশ্চিমা শক্তি ও মার্কিন নীতির সমর্থনে বিতরণ করা হয়েছে। ভেনেজুয়েলার অর্থনীতি, দেশটির বিপুল তেল মজুদ, সাধারণ জনগণের কষ্ট—সবকিছুই এক জটিল চিত্র তৈরি করেছে।

২৩ দিন আগে

জিপিএ ৫ নাকি গুণগত শিক্ষা— গুরুত্ব কোথায়?

ইতিবাচক দিকে জিপিএ-৫ কমে যাওয়ার অর্থ ‘গ্রেড ইনফ্লেশনে’র লাগাম টানা। এতে মেধা বাছাই তুলনামূলক নিরপেক্ষ হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন জিপিএর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা, রচনা, প্রজেক্ট, পোর্টফোলিও ও সাক্ষাৎকারের ওপর জোর দিতে পারবে।

২৩ দিন আগে