মতামত

বাংলাদেশের শুল্ক সুবিধা ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

মো. ফেরদাউস মোবারক
প্রকাশ: ০২ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ০৫

১ আগস্ট থেকে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করেছে, যা আগে প্রস্তাবিত ছিল ৩৭ শতাংশ। এই হ্রাসপ্রাপ্ত শুল্ক হার বাংলাদেশের জন্য কিছু তাৎক্ষণিক সুবিধা আনলেও ভবিষ্যতে এটি বড় ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষত দেশের পোশাক-নির্ভর অর্থনীতির জন্য।

এই নতুন শুল্ক হার ভারতের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা কিছুটা বাড়ালেও দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্র্যময় করতে হবে।

শুল্ক আরোপ সত্ত্বেও বাংলাদেশ তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের পণ্য ২৫ শতাংশ শুল্কের মুখে পড়ছে, পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের কারণে অতিরিক্ত জরিমানাও গুনতে হচ্ছে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ-সমান ২০ শতাংশ শুল্ক থাকলেও, অবৈধভাবে অন্য দেশের পণ্য নিজেদের নামে পাঠানোর অভিযোগে তাদের ওপর ৪০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক বসিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর চীনা পণ্যের ওপর ৩০ শতাংশ শুল্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা সেদিকে কম ঝুঁকছেন।

বাংলাদেশ নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানিয়েছেন, চীনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ার ফলে ক্রেতারা বাংলাদেশের দিকে ঝুঁকতে পারেন, কারণ এখানে শ্রম খরচ কম।

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অংশ ৯ শতাংশ, আর বছরে বাংলাদেশ সেদেশে ৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পণ্য রপ্তানি করে। থাইল্যান্ডের মতো দেশে যেখানে শুল্ক ৩৬ শতাংশ, সেখান থেকে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিলে বাংলাদেশ সুবিধা পেতে পারে। এই শুল্ক হ্রাস কূটনৈতিকভাবেও একটি সাফল্য, যেখানে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা মুহাম্মদ ইউনুস ট্রাম্পকে প্রকাশ্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর হতে পারে। এছাড়া তুলনামূলকভাবে মাঝারি এই শুল্ক হার বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেও সহায়ক হতে পারে, কারণ অনেক ব্র্যান্ড এখন চীনের বিকল্প খুঁজছে।

তবে কিছু বড় চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে। ২০ শতাংশ শুল্ক থাকা মানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। ফলে ওয়ালমার্টের মতো খুচরা বিক্রেতারা হয়তো এই বাড়তি খরচ নিজেরা নেবেন না, বরং তা ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন, এতে বিক্রি কমার ঝুঁকি থাকবে।

মোহাম্মদ হাতেম সতর্ক করে বলেছেন, বিশ্ববাজারে বাণিজ্য খরচ বাড়ছে, দেশের মুদ্রাস্ফীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকলে সম্ভাব্য লাভও হাতছাড়া হতে পারে।

এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশগুলোকে বাণিজ্যে বিশেষ সুবিধা দিতে পারে। ফলে বাংলাদেশ যদি বড় কৌশলগত জোটের বাইরে থেকে যায়, তাহলে সে সুবিধা পাবে না। আর যেহেতু বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ রপ্তানি পোশাক নির্ভর, তাই বাজারের ওঠানামায় বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তুলনায়, ভিয়েতনাম শুধু পোশাক নয়, ইলেকট্রনিকস আর জুতা রপ্তানি করে, আর ভারতের রপ্তানি খাত আরও বৈচিত্র্যময়—ফার্মাসিউটিক্যালস, তথ্যপ্রযুক্তি, এবং একইসঙ্গে তাদের অভ্যন্তরীণ বাজারও অনেক বড়।

শুল্ক হার ভিয়েতনামের সমান হলেও, তারা বেশি টেকসই। ভারতের রপ্তানি খাত যেমন বহুমুখী, তেমনি তারা নিজস্ব বাজার থেকেও চাহিদা সামলাতে পারে। ভিয়েতনাম শিল্পে বেশি বৈচিত্র্য এনেছে এবং বিদেশি বিনিয়োগ প্রচুর পাচ্ছে।

তবে ভিয়েতনামের ওপর আরোপিত ট্রানশিপমেন্ট জরিমানা বাংলাদেশের মতো নিয়ম মেনে চলা দেশের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে। আবার, ভারতের রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টানাপোড়েন নতুন অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। সে তুলনায় বাংলাদেশ নিরপেক্ষ কূটনীতির মাধ্যমে বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার ধরে রাখতে পেরেছে।

সংক্ষিপ্ত মেয়াদে বাংলাদেশের পোশাক বাজারে অংশীদারিত্ব বাড়তে পারে, তবে একটি মাত্র খাতে অতিরিক্ত নির্ভরতা ঝুঁকির বিষয়। তাই নতুন পণ্য ও নতুন বাজারে প্রবেশ করা জরুরি, যাতে টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের উচিত উচ্চমূল্যের টেক্সটাইল পণ্য—যেমন টেকনিক্যাল ফেব্রিক, টেকসই উপাদান ও হোম ফার্নিশিংস—এ নজর দেওয়া, কারণ এগুলো পশ্চিমা ভোক্তাদের চাহিদার সঙ্গে মেলে। চামড়া ও জুতার খাতেও বড় সম্ভাবনা আছে, যদি বাংলাদেশ ভিয়েতনামের মতো রপ্তানি সফলতা অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি হালকা ইলেকট্রনিক্স ও মোবাইল অ্যাসেম্বলিং খাতেও সুযোগ রয়েছে, কারণ অনেক প্রতিষ্ঠান চীনের বাইরে উৎপাদন স্থান খুঁজছে। ওষুধ শিল্পও দ্রুত বাড়ছে—স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ইতিমধ্যে ৩০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি করছে।

এসব খাতকে এগিয়ে নিতে হলে দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতিতে বিনিয়োগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রযুক্তি স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি করা দরকার—যেমনটা ভিয়েতনাম স্যামসাংয়ের সঙ্গে করছে। বাংলাদেশ যদি নিজেকে একটি টেকসই উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারে, তাহলে তা বিশ্ব জলবায়ু লক্ষ্য অর্জনের দিকেও ভূমিকা রাখবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ খরচ কমাবে এবং পরিবেশ বান্ধব উৎপাদনের ধারণার সঙ্গে মানিয়ে নেবে।

বাজার বৈচিত্র্যও সমান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ চীন, ভারত এবং আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য জোরদার করতে পারে। পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা—বিশেষত সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব ও নাইজেরিয়ায় সস্তা পোশাকের চাহিদা বাড়ছে।

বাংলাদেশের উচিত ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ (ইবিএ) সুবিধাকে ২০২৯ সাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ কাজে লাগানো এবং এরপর ‘জিএসপি প্লাস’ স্কিমে নির্বিঘ্নে রূপান্তরের প্রস্তুতি নেওয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ বছরে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার গ্রহণ করে।

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

জুলাই ঘোষণা ও নির্বাচন ঘিরে আশা-নিরাশা

গণঅভ্যুত্থানের প্রারম্ভে যে গণআকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে প্রথমত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ও পরবর্তীকালে রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, সুশীল সমাজ ও সর্বস্তরের জনসাধারণের পক্ষ থেকে, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো যে যথাযথভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গ্রাহ্য করেনি, এই

৪ দিন আগে

নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা— শেষ, নাকি সাময়িক বিরতি?

বিএনপি, যাদের এক দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল, তারা চাইছিল ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হোক, যাতে তারা নিজেদের অবস্থান ফের শক্ত করতে পারে। তবে এনসিপি ও জামায়াত মনে করে, আগে সংবিধান সংস্কার ও নির্বাচন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন দরকার—তারপরেই জাতীয় নির্বাচন দেওয়া যেতে পার

৪ দিন আগে

৩৬ জুলাইয়ের আলো কি মেঘে ঢাকা পড়ছে?

দিনটি এখন ইতিহাসে খোদাই হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়— এটা কি কেবল রোমাঞ্চকর এক স্মৃতি, নাকি বদলে দিয়েছে দেশের ভবিষ্যৎগতি? যে আগুন জ্বলে উঠেছিল সেদিন, তা কি এখনও দীপ্ত? নাকি ঢেকে যাচ্ছে নতুন হতাশার ছায়ায়?

৬ দিন আগে

পুঁজিবাজারের সম্ভাবনা কাজে লাগানোর এখনই সময়

তবে বহু বছর পর ব্যাংক ও বীমা খাত একসঙ্গে ধনাত্মক ধারায় প্রবেশ করেছে। এর কৃতিত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দাবি করতেই পারেন। তিনি ধারাবাহিকভাবে ব্যাংক খাতে নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে গেছেন এবং আমানতকারীদের আস্থা ধরে রেখেছেন।

৮ দিন আগে