একবিংশ শতকেও বস্ত্রহরণের শিকার ‘দ্রৌপদীরা’

জান্নাতুল বাকেয়া কেকা

‘দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ’ নিছক প্রবাদ বাক্য নয়। এটি ভারতবর্ষের মহাকাব্যিক এক উপাখ্যান। সনাতন ধর্মের পঞ্চম বেদস্বরূপ ধর্মগ্রন্থ মহাভারতে উল্লিখিত এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র দ্রৌপদী। কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব রচিত, মূলত সংস্কৃত ভাষায় লিখিত, প্রাচীন ভারতের অন্যতম বৃহৎ মহাকাব্য মহাভারত। একে সংহিতা তথা সংগ্রহগ্রন্থ ও ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই মহাকাব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রয়েছেন পঞ্চপাণ্ডব যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, নকুল ও সহদেব এবং তাদের স্ত্রী দ্রৌপদী। আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এই দ্রৌপদী।

গত শনিবার দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক এক চত্বরে নারীর প্রতিকৃতিতে সহিংসতা প্রদর্শনের ঘটনায় বাকরুদ্ধ হয়েছি। ফিরে গেছি গুপ্তযুগের সেই ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। বহু আন্দোলন, সংগ্রাম ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্য’ রাজু স্মারকের পাদদেশে ঘটে গেল নারীর প্রতিকৃতি ঘিরে সহিংসতার সেই মহাউৎসব!

তার সূত্র ধরেই মনে পড়ে গেল মহাভারতের পৌরাণিক আখ্যানের সেই দ্রৌপদী ও তার বস্ত্রহরণের কাহিনী। আধুনিক গবেষণা বলছে, দ্রৌপদীর ওই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে তাকে রক্ষা করেছিল ঢাকার মসলিন শাড়ি! একজন চিরায়ত নারীর শালীনতা রক্ষায় ঢাকায় তৈরি মসলিনের বহু প্যাঁচই হয়ে উঠেছিল দ্রৌপদীর রক্ষাকবচ।

দ্রৌপদীকে যখন রাজসভায় টেনে আনা হয়েছিল, তখন তিনি ছিলেন শতাধিক প্যাঁচে জড়ানো মসলিনে আবৃত। গুপ্তযুগে রাজকন্যা ও রাজবধূ দ্রৌপদী যখন জনসমক্ষে বস্ত্রহরণের শিকার হন, তখন দুঃশাসনের হাতে ধরা পড়লেও তিনি সম্পূর্ণ নিরাবরণ হননি। সেই মসলিনের অতিসূক্ষ্ম অথচ দীর্ঘ প্যাঁচ তাকে রক্ষা করেছিল। দ্রৌপদীর আর্তনাদে এবং তার অসম্মানে কেঁপে উঠেছিল প্রকৃতি ও সমাজ।

একবিংশ শতকের এই ঢাকায়, সেই ঐতিহ্যবাহী মসলিনের শহরে আবারও যেন ফিরে এলো দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের উপাখ্যান। প্রযুক্তির কল্যাণে সেই দৃশ্য এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। দুঃখজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, নারীর প্রতিকৃতিকে অবমাননার ঘটনায় অংশ নিয়েছে নারীরাও, যারা ফ্যাসিস্ট মনোভাব নিয়ে এমন ঘটনার পক্ষে জোর সুর তুলেছেন। এ যেন ফিরে যাওয়া ৪০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, দ্রৌপদীর সেই অপমানের মুহূর্তে।

দ্রৌপদী ছিলেন পঞ্চপাণ্ডবের সহধর্মিণী, দ্রুপদের কন্যা। তিনি পাঞ্চালী ও যাজ্ঞসেনী নামেও পরিচিত। ধর্মনিষ্ঠা, সাহসিকতা ও প্রজ্ঞায় তিনি ছিলেন অতুলনীয়। মহাভারতের অন্যতম কাহিনী হস্তিনাপুরের রাজসভায় পাশা খেলা। সেই খেলায় যুধিষ্ঠির হারান সব—রাজ্য, সম্পদ, এমনকি দ্রৌপদীকেও। দ্রৌপদীকে রাজসভায় আনা হয়, যেখানে দুঃশাসন তার বস্ত্রহরণের চেষ্টা করে। তবে শ্রীকৃষ্ণের ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপে তার সম্মান রক্ষা পায়। এ ঘটনাই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সূত্রপাত করে।

আধুনিক গবেষণায় জানা যায়, দ্রৌপদীর পরনে ছিল ঢাকার মসলিনের বহু প্যাঁচে জড়ানো শাড়ি, যা তাঁকে বাঁচায় বেআব্রু হওয়া থেকে। সেই মসলিনের অতিসূক্ষ্ম বুননের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা তাকে দেয় লজ্জা রক্ষার আচ্ছাদন। এটি কেবল পৌরাণিক উপাখ্যান নয়, বরং নারীর শালীনতা রক্ষার এক প্রতীকও বটে।

আজকের ঢাকায়, দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের চত্বরে প্রকাশ্যে একজন নারীর প্রতিকৃতি ঘিরে সহিংসতার এই নাটক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সেই পুরাণের দ্রৌপদীকে। তখনকার রাজসভা আর এখনকার রাজপথের ফারাক কোথায়? যারা বলেন, এটি পূর্বপরিকল্পিত বা পুরোনো ঘটনা, তাদের বলি— এতে কিছু যায় আসে না। বরং নারীর প্রতি এই প্রতীকী সহিংসতা এক ক্ষমাহীন অপরাধ। একবিংশ শতকেও দ্রৌপদীরা বস্ত্রহরণের শিকার হন— এ কথা আজও সত্য।

নারীকে অসম্মান করা মানেই সমাজ ও রাষ্ট্রকে অপমান করা। তাই আজকের তারুণ্য, বিদ্রোহ ও দ্রোহের কণ্ঠে আমরা যেন আবার উচ্চারণ করি—

বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

স্লোগানের স্বরূপ: নান্দনিকতা, সহিংসতা ও অশ্লীলতা

স্লোগান বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক অবিছ্ছেদ্য অংশ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগানের ব্যবহার ছিল। “ব্রিটিশ হটাও, দেশ বাঁচাও”; “বিদেশি পণ্য বর্জন করো, দেশি পণ্য ব্যবহার করো”; “তুমি আমি স্বদেশি, স্বদেশি স্বদেশি” “আমরা লড়ব, আমরা জিতব” ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে এরূপ অনেক স্লোগানই রাজনৈতিক সচেতন

৪ দিন আগে

প্রধান শিক্ষক : দশম গ্রেড প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি

২২ জুলাই প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এ নিয়ে একটি প্রস্তাবনা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে । তাতে প্রধান শিক্ষকরা আগে কত টাকা বেতন ও ভাতা পেতেন, আর দশম গ্রেড বাস্তবায়ন হলে কত পাবেন—তা নিয়ে পরিপূর্ণ হিসাব রয়েছে ।

৫ দিন আগে

ভারত এবং গ্লোবাল সাউথ

ভিওজিএসএস হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর উদ্বেগ, স্বার্থ ও অগ্রাধিকারসমূহের বিষয়ে আলোচনা করা, ধারণা ও সমাধান বিনিময় করা, এবং উন্নয়ন সমাধান বিনির্মাণে কণ্ঠ ও উদ্দেশ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য একটি অভিন্ন মঞ্চ প্রদানের লক্ষ্যে ভারতের প্রচেষ্টা।

৫ দিন আগে

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েন দূর হোক

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেই খাজা সলিমুল্লাহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, আল্লামা ইকবাল, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করেন যে, ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হবে। অন্যথায় ভারতবর্ষের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকবে। রা

৯ দিন আগে