ঈদুল ফিতর: কোরআন ও হাদিসের আলোকে গুরুত্ব

আ. ছালাম খান

ঈদুল ফিতর ইসলামের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যা পবিত্র রমজান মাসের সমাপ্তির পর শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে উদযাপিত হয়। এটি মুসলমানদের জন্য আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে এবং তাকওয়া, সংযম ও আত্মশুদ্ধির প্রতিদানস্বরূপ আল্লাহ প্রদত্ত এক মহান নেয়ামত। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়।

ঈদুল ফিতরের ধর্মীয় গুরুত্ব

রমজানের পূর্ণতা ও আল্লাহর অনুগ্রহ

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, "আর তোমরা যেন গণনা পূর্ণ কর এবং তোমরা যেন আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর, তিনি তোমাদের যা দান করেছেন তার জন্য, এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার।" (সুরা আল-বাকারাহ: ১৮৫)

রমজানের সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানরা সংযম ও তাকওয়ার শিক্ষা লাভ করে, আর ঈদুল ফিতর সেই তাকওয়ার পুরস্কারস্বরূপ আসে।

সদকাতুল ফিতর ও দানশীলতার গুরুত্ব

হাদিসে এসেছে, ইবনে উমর (রা.) বলেন, “আল্লাহর রাসুল (সা.) রোজাদারদের পবিত্র করার জন্য এবং দরিদ্রদের খাদ্যের সংস্থান করার জন্য সদকাতুল ফিতর ফরজ করেছেন।” (বুখারি ও মুসলিম)

ঈদুল ফিতরের আগেই প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য সদকাতুল ফিতর প্রদান করা বাধ্যতামূলক, যাতে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীও আনন্দ-উৎসবে শামিল হতে পারে।

ঈদের নামাজ ও তাকবিরের তাৎপর্য

ঈদের নামাজ ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই ঈদের দিন মুসলমানদের জন্য আনন্দ ও খুশির দিন।” (আবু দাউদ)

ঈদের রাতে ও সকালবেলা তাকবির বলা সুন্নত:

“আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।”

ঈদুল ফিতরের সামাজিক ও মানবিক তাৎপর্য

ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ়করণ

ঈদুল ফিতরের অন্যতম প্রধান শিক্ষা হলো পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও সামাজিক ঐক্য। এদিন মুসলমানরা একত্রিত হয়ে ঈদের নামাজ আদায় করে, একে অপরের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে এবং আত্মীয়-স্বজন ও দরিদ্রদের সহায়তা করে।

সাম্য ও সহানুভূতির আদর্শ

ইসলাম সাম্যের ধর্ম। ঈদুল ফিতরের দিন সবাই নতুন পোশাক পরে, সুগন্ধি ব্যবহার করে, সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। এটি ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলের জন্য আনন্দের দিন।

ক্ষমা ও পুনর্মিলনের শিক্ষা

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রথমে সালাম দেয়, সে অহংকার মুক্ত।” (বায়হাকি)

ঈদুল ফিতরের অন্যতম বার্তা হলো পুরোনো মনোমালিন্য দূর করা, পারস্পরিক ক্ষমা প্রদর্শন এবং নতুনভাবে সম্পর্ক স্থাপন।

ঈদুল ফিতরের বিশেষ আমল ও সুন্নতসমূহ

১. ঈদের আগের রাতে ইবাদতে মশগুল থাকা।

২. ঈদের দিনে পবিত্রতা রক্ষা করা, সুগন্ধি ব্যবহার করা।

৩. ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে খেজুর বা মিষ্টান্ন খাওয়া।

৪. পৃথক পথে ঈদের নামাজে যাওয়া ও আসা।

৫. পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নেওয়া।

ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক ও মানবিক প্রভাব

অর্থনৈতিক গতিশীলতা বৃদ্ধি

ঈদুল ফিতর উপলক্ষে বাজারে কেনাকাটার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, যা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হয় এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়।

দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা

সদকাতুল ফিতর এবং অন্যান্য দান-সদকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে। অনেক সংগঠন ও ব্যক্তি এসময় মানবিক সহায়তা প্রদান করে।

নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চর্চা

ইসলাম উদযাপনে মধ্যপন্থা ও সংযমের শিক্ষা দেয়। ঈদের আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি আমাদের উচিত নৈতিকতা বজায় রাখা ও অতিরিক্ত অপচয় পরিহার করা।

ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জন্য শুধু একটি আনন্দোৎসব নয়, বরং এটি তাকওয়া, কৃতজ্ঞতা, দানশীলতা এবং সামাজিক সংহতির প্রতীক। এই দিন আমাদের উচিত গরিব-দুঃখীদের সহায়তা করা, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিজেদের নিয়োজিত করা।

আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈদুল ফিতরের প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণ করে তা বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: আ. ছালাম খান, মহাপরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশন

[email protected]

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

সবার মুখে ফেব্রুয়ারিতে ভোট, বিরোধ জুলাই সনদ ঘিরে

তবে হঠাৎ করেই ঘুরে গেছে হাওয়া। বদলে গেছে সবার সুর। সবার মুখে মুখে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। কেউ বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতেই হবে। তবে সংস্কার নিয়ে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন দলের অবস্থান ভিন্

৪ দিন আগে

টেলিগ্রাফের হেডিং— ডাস ক্যাপিটাল

এই সেপ্টেম্বরেই ১৫৮ বছরে পা দিলো সেই বই, যার নাম থেকে এই হেডলাইনের খেলা— কার্ল মার্ক্সের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’।

১৮ দিন আগে

জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং বিকেন্দ্রীকরণ

একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি তার জনশক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা (Demographic Stability) অর্জন করা এখন আর কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অং

১৮ দিন আগে

জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধ হলে কার লাভ, কার ক্ষতি

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকায় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বিএনপির প্রতিপক্ষ এখন জামায়াতে ইসলামি। জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ করা গেলে জামায়াত তখন বিএনপির শক্ত বা সবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি অন্যান্য ইসলামি দলগুলো সঙ্গে নিয়ে জামায়াত দরকষাকষির সর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে পারে।

১৯ দিন আগে