বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, এ কী ঘটল!

ড. মিহির কুমার রায়
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১৭: ৫৮

সম্প্রতি 'পদক-পুরস্কার বিতর্ক' শিরোনামে একটি পত্রিকায় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা আমার দৃষ্টিতে এসেছে। প্রবন্ধটি সুলিখিত, বস্তুনিষ্ঠ ও মর্মস্পর্শী এই কারণে যে এর আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। প্রবন্ধকার এই সাহিত্য পুরস্কারের মাহাত্ম্য, প্রদানের পদ্ধতি, সম্মান, স্বীকৃতি, পুরস্কারপ্রাপ্তদের মনস্তত্ত্বসহ একটি পর্যালোচনা সাহসিকতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন, যা প্রশংসনীয়।

এখানে উল্লেখ্য, দেশের অন্যতম মর্যাদাবান পুরস্কার হচ্ছে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ‘জাতির মননের প্রতীক’ স্বায়ত্তশাসিত এই প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি-লেখকদের নামের তালিকা প্রকাশ করে গত ২৩ জানুয়ারি।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনে এই পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। দেশ বরেণ্য ১০ জন কবি-সাহিত্যিকের তালিকাটি ২৫ জানুয়ারি স্থগিত করা হয়। তখন বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, নাম থাকা কারও কারও বিষয়ে ‘কিছু অভিযোগ আসায়’ তালিকাটি স্থগিত করা হলো।

এটা সবার জানা আছে, বাংলা একাডেমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যা বর্ধমান হাউজে অবস্থিত। এই প্রতিষ্ঠানের মুখ্য কাজ বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও অনুবাদ সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রতি বছরের মতো এবারও এই একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণা করে প্রচলিত নিয়ম মেনে। অমর একুশে বইমেলার উদ্বোধনী অনষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্তদের হাতে সেই পুরস্কার তুলে দেবেন সরকারপ্রধান।

কিন্তু এবার যা হলো, তাকে অনেকেই বলতে পারেন অলৌকিক ঘটনা। এ ঘটনা অবশ্যই আলোচনার দাবি রাখে। এখানে উল্লেখ্য, এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার পর থেকেই কবি-লেখকদের একাংশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। এরই মধ্যে ‘বিতর্কিত বাংলা একাডেমি পুরস্কার-২০২৪ বাতিল ও ফ্যাসিবাদ পুনর্বাসনের প্রতিবাদে’ একাডেমি ঘেরাও কর্মসূচিও ঘোষিত হয়।

সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত পুরস্কারের জন্য ঘোষিত নামের তালিকা স্থগিত করেছে বাংলা একাডেমি। অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীও এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। বিষয়টি আরও পরিষ্কার করার জন্য রোববার (২৬ জানুয়ারি) বিকেলে সচিবালয়ের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর উপস্থিতিতে সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক (ডিজি) মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কারের তালিকা প্রকাশের পর অভিযোগ ওঠায় তা স্থগিত করা হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে গণহত্যা ও জনবিরোধী রাজনীতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে পুরস্কার বাতিল করা হবে।’

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘সম্প্রতি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ঘোষিত হলেও আমরা বিভিন্ন মাধ্যম থেকে নানা ধরনের মনোভাব ও প্রতিক্রিয়া দেখেছি। আমরা পুরো ব্যাপারটা আমলে এনেছি। আমাদের ঘোষিত পুরস্কারের তালিকাটি সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা এই তালিকাটি রিভিউ করব। প্রধানত গণহত্যা ও জনবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যদি কারও সরাসরি সংশ্লিষ্টতার কোনো প্রমাণ পাই, যে অভিযোগ আমাদের সামনে এসেছে, আমরা সেটা একটু খতিয়ে দেখছি। অনুসন্ধান করছি। যদি এ ধরনের সরাসরি সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই আমরা সেটি বাতিল করব। এর পরিবর্তে সেখানে কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে আমাদের কমিটিগুলো কাজ করছে। এর পর তারা সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করছি, সেটা আমরা তিন কর্মদিবসের মধ্যেই করতে পারব।’

সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমি সংস্কারে একটি কমিটি গঠনের কথা বলেন মহাপরিচালক। জানান, বাংলা একাডেমির সার্বিক পরিস্থিতি ও পরিচালনা পদ্ধতি নিয়ে নানা পক্ষের কিছু অসন্তোষ আছে। অনেকদিন আগে আইন হয়েছে, বিধি হয়েছে, প্রবিধানমালা হয়েছে। সেগুলোর পুনঃনিরীক্ষার প্রয়োজন। এর জন্য শিগগিরই একটি সংস্কার কমিটি গঠন করা হবে।

বাংলা একাডেমির সংস্কার হবে, তা খুব ভালো কথা। কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর হঠাৎ কেন এটা স্থগিত করা হলো? বাংলা একাডেমির মতো একটা সাবালক প্রতিষ্ঠানের কি জানা ছিল না? তালিকা থেকে যাদের নাম বাদ দেওয়া হলো, তাদের সম্মানহানির মূল্য কে দেবে? বাংলা একাডেমি কি তাদের সম্মান ফিরিয়ে দিতে পারবে? কারও সম্মান-মর্যাদা নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার একাডেমিকে কে দিয়েছে?

পুরস্কারের তালিকা প্রণয়ন কমিটিতে যারা ছিলেন, তাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, কোন বিবেচনায় তারা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের তালিকা করেছেন। তা যদি না-ও করা হয়, অন্তত সরকারের উচিত তাদের নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ করা। গণমাধ্যমকর্মীরা যেন অন্তত তাদের বিবেচনাটা জানতে পারেন।

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়। প্রক্রিয়াটা খুব সহজ। বাংলা একাডেমির ফেলোদের মধ্য থেকেই একেক বছর ২০-৩০ জনকে নিয়ে একটি নির্বাচক কমিটি বানানো হয়। এই নির্বাচকমণ্ডলীর কাজ, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তত একজন করে লেখক, কবি, গবেষকসহ অন্যান্য ক্যাটাগরির লেখকদের নাম প্রস্তাব করা। প্রস্তাবিত নামগুলো আরেকটি কমিটির মাধ্যমে বাছাই করে চূড়ান্ত তালিকা তৈরি করা হয়।

গত বুধবারের (২৯ জানুয়ারি) সভায় স্থগিত করা পুরস্কারের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন— মাসুদ খান (কবিতা), শুভাশিস সিনহা (নাটক ও নাট্যসাহিত্য), সলিমুল্লাহ খান (প্রবন্ধ/গদ্য), জি এইচ হাবীব (অনুবাদ), মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া (গবেষণা), রেজাউর রহমান (বিজ্ঞান) ও সৈয়দ জামিল আহমেদ (ফোকলোর)। পুরস্কারের ঘোষিত তালিকা থেকে যে তিনজনের নাম বাংলা একাডেমি বাদ দিয়েছে তারা হলেন— মোহাম্মদ হাননান, ফারুক নওয়াজ ও সেলিম মোরশেদ। অবশ্য পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের তালিকা স্থগিতের পর সেলিম মোরশেদ ২৭ জানুয়ারি বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দেন। তাকে কথাসাহিত্যে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে সরকারি পদক-পুরস্কারের মধ্যে মর্যাদাসম্পন্ন হলো স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কার। কিন্তু এ পুরস্কারগুলোর মনোনয়ন নিয়ে বিতর্ক চলছেই। এসব পুরস্কার প্রদানের যে নীতিমালা আছে, তা থাকা আর না থাকা সমান। স্বচ্ছতারও কোনো প্রমাণ নেই। স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদক যারা পান, তারা যেন অলৌকিকভাবে পান, কঠিন বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নয়।

প্রচলিত আছে, যারা অগে বিভিন্ন সময়ে এ সব পুরস্কার পেয়েছেন প্রায় সবাই রাজনৈতিক বিবেচনায় পেয়েছেন। এ কথা একেবারেই অসত্যও নয় । সারা পৃথিবীর যেকোনো পুরস্কার নিয়েই বিতর্ক আছে। আমাদের দেশেও তা হয়ে থাকে। আর পুরস্কার সবসময় যে যোগ্যদের হাতে যায়, তা-ও নয়। তবে যে কারণ দেখিয়ে পুরস্কার বাতিল করা হয়েছে, তা আপত্তিকর।

আমাদের প্রতিবেশী দেশে ভারতেও সম্মানজনক পদ্মভূষন ও পদ্মশ্রী পুরস্কার দেওয়া হয়। কিন্তু এতো বিতর্কের কথা সচরাচর শোনা যায় না। তবে বাংলাদেশে মনে হয় বিতর্ক তৈরির কারখানা রয়েছে, যেখান থেকে এগুলো সরবরাহ করা হয়। এর একটি কারণ, সবাই পুরস্কার পেতে চান। ফলে তদবির, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার ইত্যাদি একটি সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে, যা কাম্য নয়। কারণ পুরস্কারের জন্য কেউ কাজ করে না। সৃজনশীল কাজ হলে পুরস্কার তার পেছনে ধাওয়া করবে, সেটাই নিয়ম।

পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মরণোত্তর শব্দটিও বাংলাদেশে বহুল পরিচিত এবং সম্ভবত মৃত ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পান। এ নিয়েও অনেক সমালোচনা হয়েছে। এসব বিষয়ের নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। তাই স্বাধীনতার ৫৩ বছরের পরও সংস্কার কথাটি প্রাধান্য পাচ্ছে, যা বাংলা একাডেমির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে প্রতীয়মান হয়। তাই দলপ্রীতি, গোষ্ঠীপ্রীতি, স্বজনপ্রীতি থেকে এই সম্মানজনক পুরস্কার ও পদকগুলোকে ঊর্ধ্বে রেখে নীতিমালার ভিত্তিতে সবকিছু পরিচালিত হওয়া উচিত। না হলে এই পুরস্কারগুলো বিতর্কিত হয়ে তাদের হারানো গৌরব আর ফিরে পাবে না।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি); সাবেক পরিচালক, বার্ড (কুমিল্লা); সাবেক ডিন (ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ) ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

ad
ad

মতামত থেকে আরও পড়ুন

রক্তাক্ত বাংলাদেশ: ১৯৭১ থেকে ২০২৫

২০০৮ থেকে ২০২৪। বাংলাদেশে শুরু হলো এক রক্তঝরানোর অধ্যায়। হত্যা, খুন, গুম, আয়নাঘর— বিরোধী দলের নেতাদের ওপর অমানুষিক, নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার। মানবতা বিসর্জন দিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে নিজের দেশের

৪ দিন আগে

সবার মুখে ফেব্রুয়ারিতে ভোট, বিরোধ জুলাই সনদ ঘিরে

তবে হঠাৎ করেই ঘুরে গেছে হাওয়া। বদলে গেছে সবার সুর। সবার মুখে মুখে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। কেউ বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতেই হবে। তবে সংস্কার নিয়ে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন দলের অবস্থান ভিন্

৫ দিন আগে

টেলিগ্রাফের হেডিং— ডাস ক্যাপিটাল

এই সেপ্টেম্বরেই ১৫৮ বছরে পা দিলো সেই বই, যার নাম থেকে এই হেডলাইনের খেলা— কার্ল মার্ক্সের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’।

১৮ দিন আগে

জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা, সুশাসন এবং বিকেন্দ্রীকরণ

একটি জাতির উন্নয়নের ভিত্তি তার জনশক্তির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশে, জনসংখ্যাগত স্থিতিশীলতা (Demographic Stability) অর্জন করা এখন আর কেবল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের একটি কৌশল নয়, বরং এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সুশাসনের এক অবিচ্ছেদ্য অং

১৯ দিন আগে