আফরোজা পারভীন
তোফাজ্জল, ১৮ সেপ্টেম্বর যে ছেলেটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো বা ওই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম নামে যে ছেলেটিকে পিটিয়ে মারা হলো, তাদের নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। বলার নেই এ কারণে যে, অতীতেও এ ধরণের ঘটনায় অনেক বলেছি, অনেক লিখেছি।
আবরার মারা গেলে, তাসলিমা মারা গেলে, বিশ্বজিৎ বা মাসুদ মারা গেলে বার বার লিখেছি। কখনও ছাপা হয়েছে, কখনও হয়নি। আমার মতো আরও অনেকে লিখেছে। প্রতিকার হয়নি। প্রতিকার হলে ১৮ তারিখের এই ঘটনা দুটো ঘটতোই না।
যদি অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হত, দেশবাসী যদি সে শাস্তি দেখত তাহলে তারা বুঝতে পারত, এই জাতীয় অপরাধ করলে একই শাস্তি তারও কপালে আছে। কিন্তু তারা কোন শাস্তিই পেতে দেখেনি। এদেশে আবরারের মতো একটা মেধাবী ছাত্র ইলিশ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে শিবিরের তকমা পেল। গণপিটুনির শিকার হয়েছে সে, তাসলিমা নিজের মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ছেলেধরা তকমা পেয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছে। দুজনই মারা গেছে। কেমন আছে তসলিমার সেই মেয়েটি আমরা জানি না, রাষ্ট্র কী জানে? রাষ্ট্রের কী আর কোন কাজ নেই যে এসব জানতে হবে!
কাজেই এসব বলা-কওয়া বৃথা। তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটার এক দুর্ভাগা ছেলে! ছেলেবেলায় পিতাকে হারালো, তারপর একে একে যেন হারানোর পালা জারি হলো তার উপর। যে ভাইটি তাকে সন্তান স্নেহে লালন করত সেও চলে গেল ক্যান্সারে। মা চলে গেলেন। এলাকার চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। সে সম্পর্কও ভেঙে গেল। কিছুই রইল না তোফাজ্জলের জীবনে। রইল শুধু অনার্স আর মাস্টার্সের সার্টিফিকেট।
অথচ একসময় তোফাজ্জলের সবই ছিল । দেখতে ভাল, শুনেছি মডেলিং করত। কিছুই তখন তাকে টানল না। সার্টিফিকেট দুটো তোফাজ্জলের কাছে অর্থহীন, বাহুল্য মনে হলো। সব হারিয়ে তোফাজ্জল তখন মানসিক ভারসাম্যহীন। সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো তার মরে যায়নি। সেই ক্ষুধার তাড়নায় তাকে যেতে হত এদিক ওদিক।
ফজলুল হক হলে তার এলাকার ছাত্ররা পড়ত। তারা তোফাজ্জলকে চিনত। দেখা হলে যখন যা পারত দিত, তোফাজ্জলও চেয়ে নিত কখনওওরা তাকে খাওয়াতো। জানত ক্ষুধা নিয়েই এসেছে। ১৮ তারিখও তোফাজ্জল এসেছিল ক্ষুধার তাড়নায়। সেদিন তার সাথে এলাকার কারো দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল ছাত্র নামধারী কয়েকজন দুর্বৃত্তর সাথে। তারা তাকে মোবাইল চোর বানিয়ে ফেলল। আসলে এটা ছিল একটা কৌশল। না হলে এতদিনে জাতি জানত কার মোবাইল চুরি হয়েছে, কোথা থেকে চুরি হয়েছে, তোফাজ্জল কীভাবে চোর হল। আসলে যা চুরিই হয়নি তা নিয়ে গল্প বানাবার, বা জাতিকে কৈফিয়ৎ দেবার সময় ওদের নেই। ওরা তোফাজ্জলকে নিয়ে গেল গেস্ট রুমে। সেখানে বেধে এলোপাথাড়ি পিটালো। হাত পায়ের নখ তুলে নিলো। লাইটার জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে দিল। পা দিয়ে পিষতে লাগল, গোপন অঙ্গে বাড়ি চালালো। মার খেয়ে তোফাজ্জল এক একবার পড়ে যাচ্ছিল।
আবার উঠছিল যখন তখন সবাই আনন্দে হাততালি দিচ্ছিল। এরপর তারা ওকে ভাত খাওয়ালো। তোফাজ্জলের পেটে তো ক্ষুধা ছিলই, তার উপর এই হাটুরে মার। খাওয়াতে খাওয়াতে ওরা জানতে চাইল, খাবার কেমন। তোফাজ্জল বলল, আল্লাহর রহমতে ভাল।
এর মধ্যেই তোফাজ্জলের ভাবিকে ফোন করে তারা দু’লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করল। থাকার মধ্যে তফাজ্জলের আছে একজন অসহায় ভাবি আর তার দুটো শিশু সন্তান। ভাবি জানালো, তার কাছে টাকা নেই। তাছাড়া তোফাজ্জল ভারসাম্যহীন। ওরা বিশ্বাস করল না। জানালো টাকা না দিলে তফাজ্জলকে মেরে ফেলেবে। এবং মেরেই ফেলল ওরা। টাকা না পেয়ে আরও মরিয়া হয়ে উঠল। হেন কোন অস্ত্র নেই যা ব্যবহার করল না। আগে জানতাম না, এখন জানি হলের ছাত্রদের কাছে হকিস্টিক থেকে শুরু করে সাইকেলের চেন পর্যন্ত অনেক কিছু থাকে। মাঝে মাঝেই কাজে লাগে। পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলল ওরা তোফাজ্জলকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খবর দিলে তারা এসে যখন তোফাজ্জলকে শাহবাগে নিয়ে গেল আর শাহবাগ থেকে হাসপাতালে তার অনেক আগেই সে মৃত।
আমার প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কী ঘুমিয়ে ছিল? এত ঘটনা ঘটে গেল কেউ কী তাদের জানায়নি? যদি জানিয়ে থাকে তারা কেন ঘটনাটা ঘটতে দিল! শুনেছি প্রশাসনের কেউ কেউ এবং সাধারণ ছাত্রদের কেউ কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওরা শোনেনি। শোনেনি ভাল কথা, পুলিশকে কেন ডাকা হয়নি শুরুতেই? তাছাড়া একজন চোর চুরি করলে প্রথমেই তো তার নামে জিডি বা এজাহার করে থানায় সোপর্দ করার কথা। তা না করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে এই গণপিটুনির অধিকার এবং ক্ষমতা এই ছাত্রদের কে দিল?
শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিরাগত আগমন বন্ধ করতে নোটিস করেছিল। ভাল কথা। তা সেভাবে মূল গেট, হলগুলোর গেটে নিরাপত্তাকর্মী রাখেনি কেন? আর যদি রেখে থাকে তারা কোথায় ছিল? তোফাজ্জল যদি পূর্বের অভ্যাসমতো হলে ঢুকে গিয়েই থাকে তাকে বের করে দেয়া হয়নি কেন? তাকে বের করে দেয়া হচ্ছিল কিন্তু সে ঢোকার জন্য জোরাজুরি করেছে এমন কোন খবর কিন্তু আমরা পাইনি। আসলে বহিরাগত কোন বিষয় না। বিষয় হচ্ছে দুই লাখ টাকা। যারা নির্মমভাবে পিটিয়েছে তাদের বেশিরভাগ নাকি ছাত্রলীগের। ভোল পালটে, পোশাক পালটে এখন সমন্বয়ক হয়েছে। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। এদের হলে পুনর্বাসন করছে কারা? হলের ছাত্র বা প্রশাসনের তো এদের চেনার কথা। চিনেও কেন চুপ করে থাকা হচ্ছে? নাকি এর পেছনেও আছে সররকারকে বেকায়দায় ফেলার প্লান? তদন্ত কমিটি, অবাঞ্ছিত ঘোষণা, দু’চারজনকে এরেস্ট, দু চারদিন পর বেরিয়ে আসা এসব অনেক দেখেছি। এসব দেখে আর উল্লসিত হই না। এটুকুই জানি, যে চলে যায় সে আর কখনই ফেরে না। ছেলেদের বহিষ্কার করায় অনেকের মন খারাপ দেখলাম! খুন হয়ে যাবার পরও এই মন খারাপ খুব অবাক করল আমাকে!
একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও লীগ কর্মী শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে। প্রান্তিক গেটের সামনে তাকে পেয়ে পিটানো শুরু হয়। পিটাতে পিটাতেই তার জীবন বায়ু বেরিয়ে যায়। অপরাধ সে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ বলে কী সে মানুষ না! তার বাঁচার অধিকার নেই। সরকার পতনের পর পরই একদিকে যেমন গত ১৫-১৬ বছরে অন্যায় অত্যাচার অনিয়ম করেছে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এমন অনেক লীগ কর্মীকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেযা হয়েছে, বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, তেমনি অনেক নিরপরাধ, সৎ, এলাকায় জনপ্রিয় মানুষকেও মারধোর করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। কোন বাছ বিচার করা হয়নি। বিএনপির সব লোক কী খারাপ কিংবা অন্য দলের? কখনই না। সব দলের ১০০ % লোক খারপ হয় না আবার ভালও হয় না। ভাল মন্দ মিলিয়ে হয়, সব দলেই থাকে। কিন্তু ঠগ বাছতে গা উজাড় করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
শামীম মারা গেলেন তার দলীয় তকমার জন্য। এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি থাকে না। এদেরও ছিল না। এরা যেভাবে মারা গেল তার পোশাকি নাম দেয়া হয়েছে ‘মব জাস্টিস’। মব বুঝলাম। কিন্তু পিটুনি কী করে জাস্টিস হয়? মব ইনজাস্টিস হলে তবু একটা কথা ছিল বা মব কিলিং! অদ্ভুত নাম! এ ঘটনার পরও দুঃখ প্রকাশ, বিচার করার প্রতিশ্রুতি বয়ে গেছে যেমন সবসময় যায় ।
এদেশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর এক শ্রেণির মানুষ ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল, প্রশিক্ষণ ছিল। তখনও দেশে শুরু হয়েছিল চরম অরাজকতা। খুন জখম লুটপাট অপহরণ বেড়ে গিয়েছিল মারাত্মকভাবে। এই ঘটনাকে নিয়ে খান আতাউর রহমান একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, ‘আবার তোরা মানুষ হ’। বিষয়টা সরকার পক্ষ ভাল চোখে নেয়নি। যে ছবিটি প্রশংসিত হতে পারত দারুণভাবে, জনগণ সেটাকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসালেও অনেক বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল নির্মাতাকে। তাকে একটা ঘরানাভুক্ত করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। ছিলেন মেধাবী, সৃজনশীল, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু যথার্থ মূল্যায়ন তিনি পাননি।
এখন দেশে সেই পরিস্থিতিই চলছে। মসজিদে মারামারি হচ্ছে, পাহাড়ে আগুন জ্বলছে, গণপিটুনিতে জীবন যাচ্ছে নির্দোষ মানুষের। ফেসবুকে যে পোস্টগুলো আসছে সেগুলোর অধিকাংশ উদ্দেশ্য প্রণোদিত । কেউ কেউ আছেন লীগ বাঁচাতে, বৈষম্যবিরোধীদের দোষী বানাতে। কেউ আছেন প্রশাসনকে বাঁচাতে। সেখানে তোফাজ্জলের জন্য সত্যিকার সহানুভূতি আমি কমই দেখছি। আরেকদল ট্রল করছেন। মৃত্যু নিয়ে ট্রল করা মোটেও ভাল রুচির পরিচয় না। ‘হাউন আঙ্কেলে’র ভাতের হোটেলের সাথে তুলনা করে বলছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাতের হোটেল’।
কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বলে লজ্জা পাচ্ছেন, কেউ কেউ পড়েননি বলে গর্ব বোধ করছেন। এসবের মধ্যে বিচার চাওয়ার ব্যাপারটা কোথায়, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপার কোথায়? প্রশাসনের ভূমিকার ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যদি ছাত্রদের ভয়ে নতজানু হয়ে থাকতে হয় তাহলে চাকরি আঁকড়ে পড়ে না থেকে ছেড়ে দিন, বন্ধ করে দিন বিশ্ববিদ্যালয়। চীনে তো বহুবছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, তাতে কী চীন পিছিয়ে আছে কোন কিছুতে? আবার কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক, সমস্ত ছাত্র এবং এলামনাইদের শাহবাগে গিয়ে মাফ চাইতে দাবি তুলছেন । কেন? সমস্ত ছাত্র, শিক্ষক এলামনাই কী ওই দুর্বত্তদের বলেছিল, তোফাজ্জল বা শামীমকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে। আর এ ঘটনা কী এবারই প্রথম ঘটল? তখন মাফ চাওয়ার দাবি তোলেননি কেন আপনারা? তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? মানুষকে দলীয় বিবেচনায় না নিয়ে মানুষ হিসেবে ভাবুন। তাহলে মনের মলিনতা কেটে যাবে। তখন তোফাজ্জল আর শামীম দুজনই আপনার ভাই হয়ে উঠবে সে যে দলেরই হোক। অত্যাচারিত, নির্যাতিত মাত্রই হবে আপনার আমার আপনজন।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক
তোফাজ্জল, ১৮ সেপ্টেম্বর যে ছেলেটিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো বা ওই দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শামীম নামে যে ছেলেটিকে পিটিয়ে মারা হলো, তাদের নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। বলার নেই এ কারণে যে, অতীতেও এ ধরণের ঘটনায় অনেক বলেছি, অনেক লিখেছি।
আবরার মারা গেলে, তাসলিমা মারা গেলে, বিশ্বজিৎ বা মাসুদ মারা গেলে বার বার লিখেছি। কখনও ছাপা হয়েছে, কখনও হয়নি। আমার মতো আরও অনেকে লিখেছে। প্রতিকার হয়নি। প্রতিকার হলে ১৮ তারিখের এই ঘটনা দুটো ঘটতোই না।
যদি অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হত, দেশবাসী যদি সে শাস্তি দেখত তাহলে তারা বুঝতে পারত, এই জাতীয় অপরাধ করলে একই শাস্তি তারও কপালে আছে। কিন্তু তারা কোন শাস্তিই পেতে দেখেনি। এদেশে আবরারের মতো একটা মেধাবী ছাত্র ইলিশ নিয়ে স্ট্যাটাস দিয়ে শিবিরের তকমা পেল। গণপিটুনির শিকার হয়েছে সে, তাসলিমা নিজের মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে ছেলেধরা তকমা পেয়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছে। দুজনই মারা গেছে। কেমন আছে তসলিমার সেই মেয়েটি আমরা জানি না, রাষ্ট্র কী জানে? রাষ্ট্রের কী আর কোন কাজ নেই যে এসব জানতে হবে!
কাজেই এসব বলা-কওয়া বৃথা। তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটার এক দুর্ভাগা ছেলে! ছেলেবেলায় পিতাকে হারালো, তারপর একে একে যেন হারানোর পালা জারি হলো তার উপর। যে ভাইটি তাকে সন্তান স্নেহে লালন করত সেও চলে গেল ক্যান্সারে। মা চলে গেলেন। এলাকার চেয়ারম্যানের মেয়ের সাথে প্রেম ছিল। সে সম্পর্কও ভেঙে গেল। কিছুই রইল না তোফাজ্জলের জীবনে। রইল শুধু অনার্স আর মাস্টার্সের সার্টিফিকেট।
অথচ একসময় তোফাজ্জলের সবই ছিল । দেখতে ভাল, শুনেছি মডেলিং করত। কিছুই তখন তাকে টানল না। সার্টিফিকেট দুটো তোফাজ্জলের কাছে অর্থহীন, বাহুল্য মনে হলো। সব হারিয়ে তোফাজ্জল তখন মানসিক ভারসাম্যহীন। সে পাগল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা তো তার মরে যায়নি। সেই ক্ষুধার তাড়নায় তাকে যেতে হত এদিক ওদিক।
ফজলুল হক হলে তার এলাকার ছাত্ররা পড়ত। তারা তোফাজ্জলকে চিনত। দেখা হলে যখন যা পারত দিত, তোফাজ্জলও চেয়ে নিত কখনওওরা তাকে খাওয়াতো। জানত ক্ষুধা নিয়েই এসেছে। ১৮ তারিখও তোফাজ্জল এসেছিল ক্ষুধার তাড়নায়। সেদিন তার সাথে এলাকার কারো দেখা হয়নি। দেখা হয়েছিল ছাত্র নামধারী কয়েকজন দুর্বৃত্তর সাথে। তারা তাকে মোবাইল চোর বানিয়ে ফেলল। আসলে এটা ছিল একটা কৌশল। না হলে এতদিনে জাতি জানত কার মোবাইল চুরি হয়েছে, কোথা থেকে চুরি হয়েছে, তোফাজ্জল কীভাবে চোর হল। আসলে যা চুরিই হয়নি তা নিয়ে গল্প বানাবার, বা জাতিকে কৈফিয়ৎ দেবার সময় ওদের নেই। ওরা তোফাজ্জলকে নিয়ে গেল গেস্ট রুমে। সেখানে বেধে এলোপাথাড়ি পিটালো। হাত পায়ের নখ তুলে নিলো। লাইটার জ্বালিয়ে মাংস পুড়িয়ে দিল। পা দিয়ে পিষতে লাগল, গোপন অঙ্গে বাড়ি চালালো। মার খেয়ে তোফাজ্জল এক একবার পড়ে যাচ্ছিল।
আবার উঠছিল যখন তখন সবাই আনন্দে হাততালি দিচ্ছিল। এরপর তারা ওকে ভাত খাওয়ালো। তোফাজ্জলের পেটে তো ক্ষুধা ছিলই, তার উপর এই হাটুরে মার। খাওয়াতে খাওয়াতে ওরা জানতে চাইল, খাবার কেমন। তোফাজ্জল বলল, আল্লাহর রহমতে ভাল।
এর মধ্যেই তোফাজ্জলের ভাবিকে ফোন করে তারা দু’লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করল। থাকার মধ্যে তফাজ্জলের আছে একজন অসহায় ভাবি আর তার দুটো শিশু সন্তান। ভাবি জানালো, তার কাছে টাকা নেই। তাছাড়া তোফাজ্জল ভারসাম্যহীন। ওরা বিশ্বাস করল না। জানালো টাকা না দিলে তফাজ্জলকে মেরে ফেলেবে। এবং মেরেই ফেলল ওরা। টাকা না পেয়ে আরও মরিয়া হয়ে উঠল। হেন কোন অস্ত্র নেই যা ব্যবহার করল না। আগে জানতাম না, এখন জানি হলের ছাত্রদের কাছে হকিস্টিক থেকে শুরু করে সাইকেলের চেন পর্যন্ত অনেক কিছু থাকে। মাঝে মাঝেই কাজে লাগে। পিটাতে পিটাতে মেরে ফেলল ওরা তোফাজ্জলকে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খবর দিলে তারা এসে যখন তোফাজ্জলকে শাহবাগে নিয়ে গেল আর শাহবাগ থেকে হাসপাতালে তার অনেক আগেই সে মৃত।
আমার প্রশ্ন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কী ঘুমিয়ে ছিল? এত ঘটনা ঘটে গেল কেউ কী তাদের জানায়নি? যদি জানিয়ে থাকে তারা কেন ঘটনাটা ঘটতে দিল! শুনেছি প্রশাসনের কেউ কেউ এবং সাধারণ ছাত্রদের কেউ কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওরা শোনেনি। শোনেনি ভাল কথা, পুলিশকে কেন ডাকা হয়নি শুরুতেই? তাছাড়া একজন চোর চুরি করলে প্রথমেই তো তার নামে জিডি বা এজাহার করে থানায় সোপর্দ করার কথা। তা না করে আইন নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে এই গণপিটুনির অধিকার এবং ক্ষমতা এই ছাত্রদের কে দিল?
শোনা যাচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বহিরাগত আগমন বন্ধ করতে নোটিস করেছিল। ভাল কথা। তা সেভাবে মূল গেট, হলগুলোর গেটে নিরাপত্তাকর্মী রাখেনি কেন? আর যদি রেখে থাকে তারা কোথায় ছিল? তোফাজ্জল যদি পূর্বের অভ্যাসমতো হলে ঢুকে গিয়েই থাকে তাকে বের করে দেয়া হয়নি কেন? তাকে বের করে দেয়া হচ্ছিল কিন্তু সে ঢোকার জন্য জোরাজুরি করেছে এমন কোন খবর কিন্তু আমরা পাইনি। আসলে বহিরাগত কোন বিষয় না। বিষয় হচ্ছে দুই লাখ টাকা। যারা নির্মমভাবে পিটিয়েছে তাদের বেশিরভাগ নাকি ছাত্রলীগের। ভোল পালটে, পোশাক পালটে এখন সমন্বয়ক হয়েছে। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। এদের হলে পুনর্বাসন করছে কারা? হলের ছাত্র বা প্রশাসনের তো এদের চেনার কথা। চিনেও কেন চুপ করে থাকা হচ্ছে? নাকি এর পেছনেও আছে সররকারকে বেকায়দায় ফেলার প্লান? তদন্ত কমিটি, অবাঞ্ছিত ঘোষণা, দু’চারজনকে এরেস্ট, দু চারদিন পর বেরিয়ে আসা এসব অনেক দেখেছি। এসব দেখে আর উল্লসিত হই না। এটুকুই জানি, যে চলে যায় সে আর কখনই ফেরে না। ছেলেদের বহিষ্কার করায় অনেকের মন খারাপ দেখলাম! খুন হয়ে যাবার পরও এই মন খারাপ খুব অবাক করল আমাকে!
একই দিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গণপিটুনিতে মেরে ফেলা হয়েছে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ও লীগ কর্মী শামীম আহমেদ ওরফে শামীম মোল্লাকে। প্রান্তিক গেটের সামনে তাকে পেয়ে পিটানো শুরু হয়। পিটাতে পিটাতেই তার জীবন বায়ু বেরিয়ে যায়। অপরাধ সে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ বলে কী সে মানুষ না! তার বাঁচার অধিকার নেই। সরকার পতনের পর পরই একদিকে যেমন গত ১৫-১৬ বছরে অন্যায় অত্যাচার অনিয়ম করেছে সম্পদের পাহাড় গড়েছে এমন অনেক লীগ কর্মীকে নির্মমভাবে মেরে ফেলা হয়েছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেযা হয়েছে, বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, তেমনি অনেক নিরপরাধ, সৎ, এলাকায় জনপ্রিয় মানুষকেও মারধোর করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। কোন বাছ বিচার করা হয়নি। বিএনপির সব লোক কী খারাপ কিংবা অন্য দলের? কখনই না। সব দলের ১০০ % লোক খারপ হয় না আবার ভালও হয় না। ভাল মন্দ মিলিয়ে হয়, সব দলেই থাকে। কিন্তু ঠগ বাছতে গা উজাড় করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে।
শামীম মারা গেলেন তার দলীয় তকমার জন্য। এদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি থাকে না। এদেরও ছিল না। এরা যেভাবে মারা গেল তার পোশাকি নাম দেয়া হয়েছে ‘মব জাস্টিস’। মব বুঝলাম। কিন্তু পিটুনি কী করে জাস্টিস হয়? মব ইনজাস্টিস হলে তবু একটা কথা ছিল বা মব কিলিং! অদ্ভুত নাম! এ ঘটনার পরও দুঃখ প্রকাশ, বিচার করার প্রতিশ্রুতি বয়ে গেছে যেমন সবসময় যায় ।
এদেশে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পর এক শ্রেণির মানুষ ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠেছিল। তাদের হাতে অস্ত্র ছিল, প্রশিক্ষণ ছিল। তখনও দেশে শুরু হয়েছিল চরম অরাজকতা। খুন জখম লুটপাট অপহরণ বেড়ে গিয়েছিল মারাত্মকভাবে। এই ঘটনাকে নিয়ে খান আতাউর রহমান একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন, ‘আবার তোরা মানুষ হ’। বিষয়টা সরকার পক্ষ ভাল চোখে নেয়নি। যে ছবিটি প্রশংসিত হতে পারত দারুণভাবে, জনগণ সেটাকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসালেও অনেক বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল নির্মাতাকে। তাকে একটা ঘরানাভুক্ত করে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। ছিলেন মেধাবী, সৃজনশীল, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কিন্তু যথার্থ মূল্যায়ন তিনি পাননি।
এখন দেশে সেই পরিস্থিতিই চলছে। মসজিদে মারামারি হচ্ছে, পাহাড়ে আগুন জ্বলছে, গণপিটুনিতে জীবন যাচ্ছে নির্দোষ মানুষের। ফেসবুকে যে পোস্টগুলো আসছে সেগুলোর অধিকাংশ উদ্দেশ্য প্রণোদিত । কেউ কেউ আছেন লীগ বাঁচাতে, বৈষম্যবিরোধীদের দোষী বানাতে। কেউ আছেন প্রশাসনকে বাঁচাতে। সেখানে তোফাজ্জলের জন্য সত্যিকার সহানুভূতি আমি কমই দেখছি। আরেকদল ট্রল করছেন। মৃত্যু নিয়ে ট্রল করা মোটেও ভাল রুচির পরিচয় না। ‘হাউন আঙ্কেলে’র ভাতের হোটেলের সাথে তুলনা করে বলছেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাতের হোটেল’।
কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন বলে লজ্জা পাচ্ছেন, কেউ কেউ পড়েননি বলে গর্ব বোধ করছেন। এসবের মধ্যে বিচার চাওয়ার ব্যাপারটা কোথায়, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপার কোথায়? প্রশাসনের ভূমিকার ব্যাখ্যা চাওয়া হচ্ছে কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যদি ছাত্রদের ভয়ে নতজানু হয়ে থাকতে হয় তাহলে চাকরি আঁকড়ে পড়ে না থেকে ছেড়ে দিন, বন্ধ করে দিন বিশ্ববিদ্যালয়। চীনে তো বহুবছর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল, তাতে কী চীন পিছিয়ে আছে কোন কিছুতে? আবার কেউ কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষক, সমস্ত ছাত্র এবং এলামনাইদের শাহবাগে গিয়ে মাফ চাইতে দাবি তুলছেন । কেন? সমস্ত ছাত্র, শিক্ষক এলামনাই কী ওই দুর্বত্তদের বলেছিল, তোফাজ্জল বা শামীমকে পিটিয়ে মেরে ফেলতে। আর এ ঘটনা কী এবারই প্রথম ঘটল? তখন মাফ চাওয়ার দাবি তোলেননি কেন আপনারা? তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? মানুষকে দলীয় বিবেচনায় না নিয়ে মানুষ হিসেবে ভাবুন। তাহলে মনের মলিনতা কেটে যাবে। তখন তোফাজ্জল আর শামীম দুজনই আপনার ভাই হয়ে উঠবে সে যে দলেরই হোক। অত্যাচারিত, নির্যাতিত মাত্রই হবে আপনার আমার আপনজন।
লেখক: কথাশিল্পী, গবেষক
প্যানেল আলোচনায় যুদ্ধের ভয়াবহতা ও ক্ষয়ক্ষতি তুলে ধরার পাশাপাশি সবার সম্মিলিত সহায়তায় কীভাবে রাশিয়াকে যুদ্ধে পর্যুদস্ত করা যায় সেসব বিষয় উঠে আসে। ন্যাটোর তত্ত্বাবধানে সমরাস্ত্র ও তহবিল সংগ্রহ, এমনকি সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী পাঠানোর সম্ভাব্যতা নিয়েও আলোচনা চলছিল বলে রাষ্ট্রদূতদের অবহিত করা হয়।
৪ দিন আগে২০০৮ থেকে ২০২৪। বাংলাদেশে শুরু হলো এক রক্তঝরানোর অধ্যায়। হত্যা, খুন, গুম, আয়নাঘর— বিরোধী দলের নেতাদের ওপর অমানুষিক, নির্মম, নিষ্ঠুর অত্যাচার। মানবতা বিসর্জন দিয়ে রক্তের হোলি খেলায় মেতেছিল ফ্যাসিস্ট সরকার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে গুলির নির্দেশ দিয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে নিজের দেশের
৫ দিন আগেতবে হঠাৎ করেই ঘুরে গেছে হাওয়া। বদলে গেছে সবার সুর। সবার মুখে মুখে এখন ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন। কেউ বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে ভোট হতেই হবে। তবে সংস্কার নিয়ে ৮৪টি বিষয়ে ঐকমত্য হলেও জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে এখনো ঐকমত্যে আসতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। এ নিয়ে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি তিন দলের অবস্থান ভিন্
৬ দিন আগেএই সেপ্টেম্বরেই ১৫৮ বছরে পা দিলো সেই বই, যার নাম থেকে এই হেডলাইনের খেলা— কার্ল মার্ক্সের যুগান্তকারী গ্রন্থ ‘ডাস ক্যাপিটাল’।
১৯ দিন আগে